সাধন সরকার

  ২২ মে, ২০১৯

মুক্তমত

পাহাড়কে পাহাড়ের মতো থাকতে দিন

চলছে বর্ষা দুর্যোগের মৌসুম। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন দুর্যোগ বর্ষা আসার সঠিকক্ষণ জানাও মুশকিল! পুরো বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোর পাহাড়ে বা পাহাড়ের কোলঘেঁষে বসবাসকারী পরিবারগুলোর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে। বর্ষা মৌসুম আসে আর পাহাড়ধস নিয়ে আলোচনা হয়, সরকার ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরও প্রতি বছর পাহাড়ধসে জানমালের কমবেশি ক্ষতি হয়ে যায়। আর এর অন্যতম কারণ, পাহাড়কে পাহাড়ের মতো করে থাকতে না দেওয়া। পাহাড় কেটে পাহাড়ের পাদদেশে গরিব গৃহহীন মানুষের বসতি স্থাপনের মাধ্যমে বেশ কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠী পাহাড়ের স্থায়ী ক্ষতি করে চলেছে। পাহাড় কেটে সমতল ভূমিতে রূপান্তরিত করে পাহাড়ের পাদদেশে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। প্রভাবশালী গোষ্ঠী পাহাড় কেটে একদিকে অর্থ কামিয়ে নিচ্ছে অন্যদিকে পাহাড়ধসকে ত্বরান্বিত করছে। এসব গোষ্ঠী পাহাড় কেটে প্রকৃতি ও পাহাড়ের সৌন্দর্য নষ্ট করার পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। পাহাড়ের সৌন্দর্য বিনষ্ট হওয়ার ফলে পর্যটনের প্রতি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

তাই এখনই পাহাড়ধসের স্থায়ী সমাধানের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১১-১২ ভাগ পাহাড়ি এলাকা। বলা যায়, পাহাড়সহ আমাদের দেশের সামগ্রিক এলাকা পাললিক শিলা দ্বারা গঠিত। পাললিক শিলা বিভিন্ন স্তরে স্তরে গঠিত হওয়ায় বিভিন্ন সময় এর ভূভাগের ক্ষয় ও অপসারণ হয়ে থাকে। দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়গুলো সাধারণত বেলেপাথর, কর্দমপাথর ও বালুসমৃদ্ধ। ফলে বর্ষা মৌসুমে একটানা বৃষ্টিতে বেলেপাথর ও বালুসমৃদ্ধ পাহাড়ের মাটির বন্ধন আলগা ও দুর্বল হয়ে পাহাড়ধসের অবস্থা তৈরি হয়। এক তথ্যমতে, পৃথিবীর চার ভাগের এক ভাগ লোক কোনো না কোনোভাবে পাহাড়-পর্বতের প্রত্যক্ষ উপকারভোগী। দেশের পাহাড়গুলোতে দীর্ঘদিন ধরে অপরিকল্পিত বনায়ন করা হয়েছে। পাহাড়ের বন উজাড় করা হয়েছে এবং হচ্ছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের আশ্রয়ে থাকা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণেও ব্যাপকভাবে বনভূমি উজাড় হচ্ছে, পাহাড়ের ক্ষতি হচ্ছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসবাস যত স্থায়ী হবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পাহাড়, বন, জীববৈচিত্র্য তথা সার্বিক পরিবেশের ক্ষতি তত ত্বরান্বিত হবে! বিভিন্ন বছর পাহাড় কাটা ও বন উজাড়ের ফলে বর্ষা মৌসুমে একের পর এক পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বেশ কিছু শহর পাহাড়ের কোলঘেঁষে অবস্থিত হলেও সেসব স্থানে পাহাড়ধসের ঘটনা খুব একটা শোনা যায় না। আমাদের অপর বাংলায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দার্জিলিং ও গ্যাংটক শহর দুটি পাহাড়ের (পাহাড়ের ধরন ও গঠন আমাদের পাহাড়ের মতোই) একবারে শীর্ষে অবস্থিত হলেও সেখানে পাহাড়ধসের ঘটনা হয় না বললেই চলে!

বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে ‘প্রাচ্যের রানী’ বলা হয়। ‘বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার’খ্যাত এ শহরের অপরূপ সৌন্দর্যের অন্যতম উপাদান হচ্ছে পাহাড়। পাহাড়ের সঙ্গে রয়েছে এ শহর ও অঞ্চলের আত্মিক বন্ধন। পাহাড় ধ্বংস করা হলে এ শহরের ভৌগোলিক চরিত্রও বদলে যেতে পারে। প্রকৃতির এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে ও প্রশান্তির পরশ পেতে বিভিন্ন সময় মানুষ ছুটে যায় এ পাহাড়ের কাছে। কিন্তু কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্রের লোভ ও লালসা পাহাড়ের এ সৌন্দর্য নষ্ট করছে। দিনে ও রাতের আঁধারে সংঘবদ্ধ চক্রের পাহাড় কাটা থেমে নেই! বেলেমাটির পাহাড় একটু কাটা হলেই বাকি অংশও ধসে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। জানা যায়, ১৯৭৫ সাল থেকে পাহাড়ে অবৈধ দখল শুরু হয়। তারও আগ থেকে কমবেশি পাহাড় কাটার সূত্রপাত হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাহাড় কাটা বৃদ্ধি পাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের সংখ্যা যেমন বেড়েছে; তেমনি পাহাড়ে বসবাসকারী জনবসতির সংখ্যাও দিনে দিনে বেড়েছে। তথ্যমতে, দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়গুলোর ধরন, আকৃতি ও জায়গার নাম অনুসারে স্থানীয় বিভিন্ন নামে পাহাড়গুলোর নামকরণ করা হয়েছে।

বিভিন্ন সময়ের পাহাড়ধসের চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০০৭ সালে পাহাড়ধসে নিহত হয় প্রায় ১২৭ জন, ২০০৮ সালে ১৪, ২০১১ সালে ১৭, ২০১২ সালের ২৮, ২০১৩ সালে ২, ২০১৭ সালে প্রায় ১৫০ জন। সামনের বছরগুলোতে পাহাড়ধস আবারও যে মৃত্যুর কারণ হবে না; তার কোনো নিশ্চয়তা নেই! সহজ কথায় পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে সব ধরনের বসতি উচ্ছেদ করতে হবে। ২০০৭ সালে পাহাড়ধসে প্রাণহানির পর গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি পাহাড়ধসের ২৮টি কারণ চিহ্নিত করে পাহাড়ধস বন্ধে কিছু সুপারিশ করেছিল। বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে আজ পাহাড়ধস নামক দুর্যোগ নিয়ে এত চিন্তিত হতে হতো না! পাহাড়ে অপরিকল্পিত ও ঝুঁকিপূর্ণ বসতি তৈরি, বন উজাড়, যত্রতত্র অবকাঠামো নির্মাণ, পাহাড় কাটা পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেখা যায়, পাহাড়ধস বন্ধে পুরো পাহাড়ের চারপাশে পাথর ও সিমেন্টের ব্লক তৈরি করা হয়। পাশাপাশি পানি নিষ্কাশনের জন্য রাখা হয় পৃথক ব্যবস্থা। বাংলাদেশেও এখন এ প্রযুক্তিতে পাহাড় রক্ষার কৌশল কাজে লাগানো হচ্ছে। পাহাড়ধস বন্ধে এ ব্যবস্থাপনায় এ দেশের বেশ কিছু পাহাড় সংরক্ষণ করে দেখা যেতে পারে। পাহাড়গুলো আমাদের সম্পদ, প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা যায় না! ধারাবাহিকভাবে পাহাড়ের ক্ষতি করে চললে পাহাড়ও একসময় তার প্রতিশোধ নেবে! পাহাড়কে নিজেদের স্বার্থে কোনো গোষ্ঠী বা চক্র যেন ব্যবহার করতে না পারে, সেদিকে নজর দিতে হবে। গরিব মানুষের গৃহহীন থাকার সুযোগ নিয়ে কোনো গোষ্ঠী যেন তাদেরকে ব্যবহার করতে না পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। পাহাড় সবার জন্য নিরাপদ হোক। জীববৈচিত্র্য রক্ষা, পরিবেশের সার্বিক ভারসাম্য রক্ষা ও পর্যটনের বিকাশে পাহাড় রক্ষা করতেই হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close