মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে রণসজ্জা শুরু করেছেন। ইরানকে লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ প্রস্তুতিই এর প্রমাণ। বিভিন্ন সময়ে আমেরিকা ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন সময় যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দেয়। তবে এবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প বিভিন্ন উপায়ে ইরানের ওপর যুদ্ধের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি ঘটনায় তা উপমেয়।

সম্প্রতি আমেরিকা তার বিমানবাহিনী রণতরী ইউএস আব্রাহামকে পারস্য উপসাগরে পাঠায়। সেটি মিসরের সুয়েজ খাল অতিক্রম করে ইরানের উদ্দেশে চলে গেছে বলে জানিয়েছে সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে কাতার ও ইউনাইটেড আরব আমিরাতের মার্কিন বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করেছে পরমাণু অস্ত্রবাহী বিমান বি-৫২। মূলত

আমেরিকার এই দুই সামরিক পরিকল্পনার কারণেই সৃষ্টি হয়েছে চরম উত্তেজনা। তবে চুপ নেই ইরানও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রমকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, মাত্র একটি ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি নৌফ্লিটকে ধ্বংস করে দেওয়া যাবে। দুই দেশের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ও কার্যক্রমে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। তবে কি যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে?

যদি তাই হয়, তা হলে অর্থনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় ইরান শক্তিধর কয়েকটি দেশের সরাসরি সহযোগিতা পাবে। এর মধ্যে রাশিয়া, চীন, তুরস্ক ও পাকিস্তানের ভূমিকা থাকবে উল্লেখযোগ্য। কারণ এশিয়ার অর্থনীতি সচল রাখতে ইরান বড় ভূমিকা পালন করে। ইরানে যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করলে পার্শ^বর্তী দেশ হিসেবে রাশিয়া, চীন, তুরস্ক ও পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে রাশিয়া ও চীন। ফলে শক্তিধর এই চার দেশ ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। আর সেই কাজটি তুরস্ক ও পাকিস্তান এরই মধ্যে শুরু করেছে। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে থাকা সব ঘাঁটি যুদ্ধের জন্য ব্যবহারের চেষ্টা করবে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু পুরোপুরিভাবে সেই ঘাঁটিগুলো ব্যবহার করতে ব্যর্থ হবে তারা। এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ও আরবীয় কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্রের সহযোগিতা পাবে আমেরিকা। এর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, আরব-আমিরাত, বাহরাইন ও মিসর। এ ছাড়াও আরবের কয়েকটি রাষ্ট্র (ইসরায়েল, মিসর, লেবানন, কাতার, ওমান, কুয়েত, জর্ডান, ইরাক ও ইয়েমেনে) থাকা ঘাঁটি সরাসরি ব্যবহার করতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু মিত্র দেশগুলোর কাছ থেকে আমেরিকা কোনো রকম সহযোগিতা পাবে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধ হলে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইসরায়েল। আর ইসরায়েল ক্ষতিগ্রস্ত হোক, যুক্তরাষ্ট্র সেটি চায় না। যে কারণে আপাতত যুদ্ধ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার পেলোসির কথায় আরো প্রমাণিত তারা এখনি ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ লিপ্ত হতে চায় না।

২০১৫ সালের ১৪ জুলাই অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় পরমাণু শক্তিধর পাঁচ দেশের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষর করে ইরান। চুক্তির ফলে সেই সময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে বিরাজমান উত্তেজনা কমে যায়। কিন্তু বিপত্তি ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি থেকে সরে আসায়। গত বছর চুক্তি থেকে একতরফাভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প। একই সঙ্গে ট্রাম্প সরকার ইরানের ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বিশেষ করে তেলের বাজার সংকুচিত করতে সচেষ্ট হয় যুক্তরাষ্ট। তবে সেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র তেমনভাবে সফল হতে পারেনি। এদিকে ইরানও যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি দিয়ে রেখেছে। ইরানের তেল রফতানিতে যুক্তরাষ্ট্র বাধা হয়ে দাঁড়ালেও তারা কৌশলগতভাবে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেবে। মূলত হরমুজ প্রণালি দিয়েই মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ তেলবাহী জাহাজ ইউরোপ ও আমেরিকায় যায়। এসব ঘটনার মধ্য দিয়েই এগোচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ।

বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। এই পরিস্থিতিতে গত ৮ মে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে পরমাণু চুক্তি থেকে আংশিক বেরিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, ইরান এই চুক্তি থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে না গেলেও চুক্তির কিছু শর্ত আর তারা মানবে না। কিন্তু গত বছরের ৮ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডেনাল্ট ট্রাম্প এ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেয়। অন্যদিকে ইরান এই চুক্তি থেকে খানিকটা সরে এলেও পুরোপুরি আসেনি। তবে ইরান বিশ^শক্তিগুলোকে হুমকি দিয়ে রেখেছে। ইরান ঘোষণা দিয়েছে, বিশ^ শক্তিগুলো ৬০ দিনের মধ্যে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থেকে ইরানের অর্থনীতিকে রক্ষা না করলে উচ্চমাত্রার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের পথে যাবে। পরমাণু চুক্তি অনুযায়ী কম সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদনের কথা ছিল ইরানের। এ ক্ষেত্রে সীমা ধরা হয়েছিল ৩০০ কেজি। এ ছাড়াও ইরানকে ১৩০ টনের মতো ভারী পানির মজুদ রাখার সুযোগ দেয় চুক্তিভুক্ত পক্ষগুলো। তবে এই চুক্তি অমান্য করা শুরু করেছে ইরানও। ফলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের এই সিদ্ধান্ত যুদ্ধের আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

আমরা সবাই আমেরিকা ও ইরানের মধ্যকার সামরিক কিংবা পরমাণু শক্তি সম্পর্কে অবহিত। শক্তির বিচারে নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে থাকে। তবে কিছু কৌশলগত কারণে ইরানের শক্তিকে সমীহ করতে হয় যুক্তরাষ্ট্রকে। আট লক্ষাধিক রিজার্ভ সেনার দেশ ইরান। যার মধ্যে ‘কুদুস’ নামে আড়াই লক্ষাধিক সেনা সার্বক্ষণিক ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। তা হলে উপমেয় ইরান সব অবস্থাতেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকে। ‘কুদুস’ বাহিনীর মূল শক্তি হচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্র। এ ছাড়াও সাবমেরিন ক্ষমতা, দ্রুতগতির সামরিক স্পিডবোডসহ ইরানের আছে শক্তিশালী নৌশক্তি। এ ছাড়াও যুদ্ধ হলে পার্শ^বর্তী কয়েকটি শক্তিধর দেশকে পাশে পাবে ইরান। সব মিলে মনস্তাত্ত্বিক ও মাঠের যুদ্ধে দুই দেশের সক্ষমতা প্রায় কাছাকাছি। তবে বিশ^বাসী আর যুদ্ধের দামামা চায় না। চায় না হিরোশিমা ও নাগাশাকির মতো ভয়াবহতা। তাই যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের বৈরিতা কথার লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ থাকুকÑ এটাই বিশ^বাসী প্রত্যাশা করে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"