অলোক আচার্য

  ২০ মে, ২০১৯

পর্যালোচনা

উন্নয়নের সর্বত্রই কৃষকের ঘাম

আদিকাল থেকেই বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে পরিচিত। কৃষি, কৃষক আর কৃষকের উৎপাদন করা সোনার ফসলের চিত্রই এ দেশের চিরায়ত রূপ। এসব নিয়েই চিত্রকর ছবি আঁকেন, কবি কবিতা লেখেন। এ দেশের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যে কৃষি ও কৃষকের কথা অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত হলেও সেই আদিকাল থেকে কৃষকদের অবহেলা করা হয়েছে। যারা দিন-রাত রোদে-বৃষ্টিতে ভিজে ঘেমে ফসল উৎপাদন করেছেন তাদের সেই কষ্টের ফসল কখনো চলে গেছে জমিদারের গোলায়, কখনো মাঠের ধান মাঠেই শুকিয়েছে। জমিদারের পাইক-পেয়াদার দাপটে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন কৃষকরা। মানুষের মুখের আহার জোগানোর ব্যবস্থা করলেও তাদের সন্তানরা থেকেছেন অভুক্ত। তাদের ছেলেদের চাষা বলে উপহাস ব্যঙ্গ করা হয়েছে। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস! সোনার বাংলাকে যারা সোনা দিয়ে মুড়ে রেখেছেন, তাদের অঙ্গে কোনো দিন সোনা উঠেনি।

আজ সেই রাজা জমিদারদের যুগ নেই। কিন্তু কৃষকদের অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। প্রতিদিন পত্রপত্রিকা খুললেই দেখা যায় কৃষকরা তাদের ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই কাঠফাটা রোদে চড়া পারিশ্রমিকে শ্রমিক নিয়ে ফসল কেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড়িয়ে ফসল বিক্রি করে ফসলের উৎপাদন খরচই ওঠে না; অন্যদিকে আড়তদার, দালালদের পকেট ফুলে ফেঁপে ঢোলগবিন্দ হয়ে যায়। ন্যায্যমূল্যের জন্য কৃষককে রাস্তায় দাঁড়াতে হয়। অন্যদিকে সেই ফসল থেকেই চাল মোটা দামে বিক্রি হয়। ফসলের ন্যায্যমূল্য পেতে আজও তাদের রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যমতে, কৃষক ন্যায্যমূল্য না পেয়ে তার ফসল খেতেই পুড়িয়ে দিয়েছেন। কতটা দুরবস্থা হলে নিজের উৎপাদন করা সোনার ফসল নিজ হাতেই পুড়িয়ে দেওয়া যায়। কৃষক আর ভোক্তার মাঝখানে দালাল, ফড়িয়া, মধ্যস্বত্বভোগী কতজন এসে দাঁড়ায়। এত সব সুবিধাবাদীর ভিড়ে কৃষকরা তাদের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

লেখাপড়া শিখে সবাই অফিসার, ডাক্তার, ব্যারিস্টার কত বড় বড় টাকাওয়ালা মানুষ হতে চান। কিন্তু কেউ শখ করে কৃষক হতে চান না। বড় বড় বিশ^বিদ্যালয় থেকে পাস করে কেউ মাঠে গিয়ে চাষবাস করতে চান না। ওই কাজটা আজও সেই চাষাভুষাদের জন্য তুলে রাখা! কিন্তু এসব চাষাভুষা যদি ঘাম ঝরিয়ে ফসল উৎপাদন না করতেন, তা হলে সুটেড-বুটেড বাবুরা খালি পেট নিয়ে কতক্ষণ এসির হাওয়া খেয়ে বাঁচবেন, এটা কেউ ভাবেননি কখনো। হাওয়া খেয়ে মন ভরলেও দেহশক্তির চাহিদা মেটে না। তবে দিন শেষে সেই মানুষদেরই আমরা ভুলে যাই। তাই চলমান সময়ে সামাজিক নিষ্পেষণে পিষ্ট একজন কৃষক চান তার সন্তানকে যেন আর তার মতো কষ্টকর এবং অবহেলার জীবন কাটাতে না হয়। মানুষ কষ্ট সহ্য করে তখন, যখন সেখানে সম্মান পাওয়া যায়। কিন্তু যেখানে সম্মান থাকে না, সেখানে আগ্রহ কমতে থাকে। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও এটা হচ্ছে। কৃষিতে আগ্রহ কমছে। কৃষিকে আজও সমাজের নিচু শ্রেণির কাজ বলেই ধরে নেওয়া হয়। বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে বিদ্যান হয়ে সবাই চাকরির পেছনে ছোটেন। তাদের লক্ষ্য থাকে চাকরি করা। কিন্তু এমন কেউ আছে কি যে কৃষিকাজ করে জীবন চালাতে চান। এ রকম একজনকেও সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না। একজন সফল কৃষক এ রকম বহু বড় বড় চাকরিজীবীর থেকে উত্তম।

কাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেমন শিক্ষিত এবং দক্ষ মানুষ দরকার, তেমনি কৃষি ক্ষেত্রেও ঠিক সে রকম শিক্ষিত এবং দক্ষ কৃষকের প্রয়োজন। কৃষি ক্ষেত্রেই দরকার সবচেয়ে বেশি প্রশিক্ষিত মানুষ। কারণ আমাদের দেশের কৃষিজমি কমছে। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অ্যাকশনএইড ও খানির জরিপ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের ৬৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ কৃষক নানা সময় অন্য পেশায় চলে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। এ ছাড়া কৃষক পরিবারগুলোর মধ্যে ৮৩ দশমিক ১৫ শতাংশ বলেছেন, তাদের খামারের আয় তাদের পারিবারিক চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। দেশের ১১টি অঞ্চলের ১৪ উপজেলার ৮৬ গ্রামের ৮৯৯ জন কৃষকের কাছ থেকে গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করা হয়। বাস্তব জীবনে কৃষকরা প্রকৃত সম্মান না পেলেও কবির কবিতায়, সাহিত্যে কৃষককে মর্যাদার আসন দেওয়া হয়েছে। বিখ্যাত উক্তি, ‘দধিচি কি তাহার চেয়ে সাধক ছিল বড়?’ পৃথিবীর কোনো সাধকের সঙ্গেই কি তার তুলনা দেওয়া চলে। দধিচি তার অস্থি দিয়ে অস্ত্র বানিয়ে দেবতাদের যুদ্ধে বিজয় লাভে সহায়তা করেছিলন। আর কৃষক তার অস্থি চর্ম সবটুকু কাজে লাগিয়ে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে মানবজাতিকে সাহায্য করে যাচ্ছে প্রতিদিন। রোদ ঝড় বৃষ্টিতে পুড়ে যারা আমাদের অন্ন জোগায় আমরা কেবল টাকা দিয়ে তা কিনেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করি। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে কৃষিকে এগিয়ে নিতে হবে। আর কৃষি বাঁচাতে হলে কৃষককে বাঁচাতে হবে। কোনোভাবেই কৃষকের স্বার্থ ক্ষুণœ করা চলবে না। কৃষকের ফলানো ফসল যারা উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো সিন্ডিকেট বানিয়ে মোটা টাকা নিজেদের পকেটে ভরে নেন তাদের হাত থেকে কৃষককে রক্ষা করতে হবে।

দেশে নাগরিকের শ্রেণিবিভাগ করা হলে যে বা যারা বড় বড় চাকরি করেন তাদের ভাগ্যেই জোটে প্রথম শ্রেণির নাগরিক বা দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির খেতাব। মাস শেষে বেতন পেয়ে নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করেন। যারা বড় বড় ব্যবসায়ী তারা কৃষকের উৎপাদন করা ফসল নিয়েই পয়সাওয়ালা হয়ে যান। বিপরীতে যারা প্রান্তিক কৃষক তারা দাম না পেয়ে হতাশ হয়ে যান। একজন নাগরিক যার চাষযোগ্য জমি রয়েছে, সেও চাইছেন তার সন্তান বড় কোনো চাকরি করুক। কারণ তিনি চান না তার মতো তার সন্তানকে অনিশ্চিত জীবনযাপন করতে হোক। বীজ বোনা থেকে শুরু করে সার দেওয়া, আগাছা পরিষ্কার করা, সেচ দেওয়া, নিয়মিত পরিচর্যা করাÑ এত সব করার পর যখন ফসল ঘরে ওঠে, তখন সন্তান পাওয়ার মতোই আনন্দ থাকে কৃষকের মনে। বাবা যেমন সন্তানকে পরম যতেœ বড় করে তোলেন, কৃষক তেমনি আদরে ফসল ফলান। এরপর সেই ফসলের দাম না পেলে, ফসল উৎপাদনের জন্য সমাজে সম্মান না পেলে, তার তো খারাপ লাগারই কথা। কৃষক তো আর এসি গাড়ি করে ঘোরার সুযোগ পান না। অথচ যারা এসি গাড়ি করে রাস্তায় ঘুরে বেড়ান, রাত পোহালেই তাদের দরকার হয় কৃষকের উৎপাদন করা ফসল। না হলে সবই বৃথা। তাই নাগরিকের শ্রেণিবিভাগের প্রথম কাতারেই কৃষকের জায়গাই থাকা উচিত। তারপর সবাই।

বেকার সমস্যা ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে আমাদের দেশে। এদিকে কৃষিতে আগ্রহ কমার ফলে এই চাপ বাড়ছে অন্য কাজের ক্ষেত্রগুলোতে। অথচ প্রাচীনকাল থেকেই কৃষি, কাজের বড় একটি ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ কৃষিকাজে নিয়োজিত। শিল্পায়নের সময়েও কৃষিই ছিল কাজের অন্যতম বৃহৎ ক্ষেত্র। কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণে চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে কৃষি ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারীর সংকট দেখা দেবে। শিক্ষিত তরুণদের এ ক্ষেত্রে আগ্রহ না থাকায় আজও কৃষি কেবল অশিক্ষিত মানুষের পেশাই রয়ে গেছে! শিক্ষিত মানুষের অংশ বৃদ্ধি পেলে কৃষির চেহারাও বদলে যাবে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহারসহ আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের বিষয়টি আরো সহজ হবে। ফলে ফসল উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেটের প্রভাব কমবে। কারণ একজন শিক্ষিত মানুষকে বোকা বানানো তুলনামূলক কঠিন। উন্নত বিশে^ কৃষির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। ফলে সেখানে কৃষি কেবল গ্রামের অশিক্ষিত মানুষের পেশা নয়। বরং আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণিও এ পেশায় নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ে তুলছেন। ন্যায্যমূল্যের সঙ্গে সঙ্গে যদি শিক্ষিত শ্রেণি এ পেশায় আসে, তা হলে একসময় কৃষি পেশার প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close