রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২০ মে, ২০১৯

মুক্তমত

নির্বিঘ্ন ঈদযাত্রায় সুব্যবস্থা জরুরি

প্রতি বছর ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ে লাখো মানুষ। প্রতি বছর ঈদযাত্রায় পুনরাবৃত্তি হয় একই ঘটনার। বেহাল সড়ক, দীর্ঘ যানজট, রুগ্ণ পরিবহন ব্যবস্থা, নিয়ন্ত্রণহীন ভাড়া বৃদ্ধি আর প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা এর সঙ্গে টিকিট কালোবাজারি তো আছেই। এসব বিবেচনা মাথায় রেখেই ঈদযাত্রায় নিরাপদ প্রস্তুতি জরুরি। ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য কারো মধ্যেই যেন চেষ্টা ও আন্তরিকতার অভাব দেখা যায় না। নাড়ির টানে মানুষ ছুটে চলে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। বাড়ি ফেরার সে যে কী আগ্রহ ও ব্যাকুলতা বলে বোঝানো কঠিন। মানুষ ছুটে চলে তার আপন ঠিকানায়, আপন সত্তায় মাটির টানে, নিজ ঠিকানায়। আর এই আনন্দের যাত্রায় কিছু সঠিক পরিকল্পনার প্রয়োগ আপনার যাত্রাকে করতে পারে আরো উপভোগ্য। হোক ট্রেন, বাস বা লঞ্চ; গাদাগাদি করে চড়তে যাবেন না। অতিরিক্ত ভার বহন করতে যাওয়াটা বেশ ঝুঁকির। ঈদযাত্রা নিরাপদ ও নির্বিঘœ করাটাই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। বিশেষ করে ঈদযাত্রায় সড়ক-মহাসড়কে যানজট চরম আকার ধারণ করে। এ নিয়ে মানুষের দুর্ভোগের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার এখন থেকেই।

ঈদযাত্রা নির্বিঘœ করতে সবার আগে সড়ক-মহাসড়ক সংস্কার করতে হবে। বেপরোয়া গাড়ি চালনা, মহাসড়কের পাশে দোকান বসানো, ট্রেনের টিকিটের কালোবাজারিÑ এসব বন্ধ করতে হবে। যানজট, যানবাহন ছাড়ার সময়সূচি, লক্কড়ঝক্কড় গাড়ির চলাচল, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও যাত্রী তোলাÑ এসব দিকেও নজর দিতে হবে। এ ছাড়া ঈদের সময় অতিরিক্ত ব্যবসা করার জন্য লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি, এমনকি নছিমনও হাইওয়েতে চলাফেরা করে। গাড়ির কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ফলে যানজট লেগেই থাকে। ঈদের আগে ও পরের তিন দিন হাইওয়েতে ট্রাক ও লরি বন্ধ রাখতে হবে। ট্রেনের বগি ও বাসের সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে। অনলাইনে টিকিট কেনার সুযোগ ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশে নিয়ে আসতে হবে। সব রকম অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হাইওয়ে পুলিশকে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দিতে হবে।

মানুষ আপনজনের সঙ্গে ঈদ করতে নিরাপদে ঘরে ফিরবেÑ এটাই আমাদের চাওয়া। সব ভাঙা ও অকেজো রাস্তা ঈদের আগে মেরামত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পাহারায় রাখতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও অদক্ষ ড্রাইভারকে বাদ দিতে হবে। যত্রতত্র বাজার ও পার্কিং বন্ধ করতে হবে। মানুষের বিবেক সবচেয়ে বড় আদালতÑ এটা মনে রাখতে হবে ও মানতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ সিগন্যালগুলোয় ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার জন্য দিনের বেলায় কার্গো গাড়ি, ট্রাক, পিকআপ, কাভার্ড ভ্যানÑ এসবের চলাচল সীমিত করতে হবে। ঈদে ঘরমুখো মানুষ যেন কোনোভাবে হয়রানির শিকার না হয়; সেদিকে প্রশাসনের সজাগ দৃষ্টি রাখাই হবে এ সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

হাইওয়ে পুলিশ ঈদযাত্রা নির্বিঘœ করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে। ট্রেন ও বিভিন্ন গাড়ির টিকিট যেন কেউ ব্ল্যাকে বিক্রি করতে না পারে, তার জন্য সতর্কবার্তা জারি করতে হবে। সারা বছর চেষ্টা না করে শুধু ঈদের আগে তাড়াহুড়া করে রাস্তা মেরামতে নজর দিয়ে লাভ হবে না। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। অদক্ষ গাড়িচালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধ করতে হবে। লেন মেনে গাড়ি চালাতে হবে। এজন্য হাইওয়েতে সাইকেল ও মোটরসাইকেল যেন সঠিক নিয়মে চলে, সেজন্য তদারকির প্রয়োজন। এমনকি মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। রাস্তা সংস্কার করতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। ঈদের যাত্রায় বাস, ট্রেন ও নৌপথে বগি ও গাড়ি বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সতর্ক থাকতে হবে। এবার যেহেতু ঈদে ছুটি কম, তাই ছুুটি বৃদ্ধি করেও যানজট নিরসন করা সম্ভব। এ ছাড়াও জল ও স্থলপথে সার্ভে করে ত্রুটি চিহ্নিত করা জরুরি। ঈদের আগেই সব পথ চলাচল উপযোগী করার ব্যবস্থা নিতে হবে। সব রাস্তার খানাখন্দ, ফেরিঘাট মেরামতের কাজ সম্পন্ন করতে হবে; মালিকদের সঙ্গে জরুরি সভা করে স্টিমার, লঞ্চ, বাস প্রভৃতির মেরামতকাজ শেষ করার তাগিদ দিতে হবে; লঞ্চ ও বাস পরিদর্শন করে দেখতে হবে সেগুলো নিরাপদ চলাচলের উপযোগী কি না।

এ ছাড়াও টিকিটপ্রাপ্তি থেকে শুরু করে ঘরে পৌঁছানো পর্যন্ত পদে পদে বিড়ম্বনা সইতে হয় ঘরমুখো মানুষকে। বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের সংস্কারকাজ দ্রুততার সঙ্গে করতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভাঙাচোরা সড়ক-মহাসড়ক মেরামতের কাজ শেষ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। ঈদে মহাসড়কে যানজট ও ভোগান্তি রোধে পুলিশ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং স্থানীয় প্রশাসনকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। ঈদের আগে এবং পরে অন্তত এক সপ্তাহ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সব সড়কে উন্নয়নকাজ স্থগিত রাখতে হবে। যান চলাচল নির্বিঘœ করতে সড়ক দখলমুক্ত করতে হবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ব্যাপারে তৎপর হবে বলে আশা করি। গত বছর ট্রেনের টিকিটের জন্য জমায়েত লোকদের পত্রিকায় ছাপানো ছবি দেখে মনে হচ্ছিল কোনো জনসভায় আগত ব্যক্তিদের ছবি। ঈদযাত্রা পুরোপুরি নির্বিঘœ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কর্তৃপক্ষ চাইলে অনেকটাই নিরাপদ করতে পারে বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে। ঈদ আসে আর মানুষের বিড়ম্বনা বাড়ে, এ যেন নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। নাড়ির টানে বাড়ি ফেরার অমানবিক কষ্টের মধ্যেও মানুষকে পড়তে হচ্ছে অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি ও ছিনতাইকারীদের কবলে। ছিনতাইকারীরা ছিনতাই কাজে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কার ব্যবহার করছে। তারা ধরা পড়ছে, সাময়িক শাস্তি হচ্ছে, আবার বের হয়ে বর্ধিত আকারে তাদের কাজ করে যাচ্ছে। এর থেকে নিস্তার পেতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একমাত্র ভরসা। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে দৃঢ় পদক্ষেপের মাধ্যমে এদের নির্মূল করতে পারলেই ঈদযাত্রা নির্বিঘœ করা সম্ভব।

উল্লেখ্য, ঈদের সাত দিন আগে থেকেই যানজট শুরু হয়ে যায়। এতে জনগণের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। এজন্য মহাসড়কের দিকে সর্বদাই নজর রাখতে হবে। সড়ক ভালো রাখার জন্য প্রয়োজনে বিভিন্ন জায়গায় নির্দিষ্ট কমিটি গঠন করতে হবে। তা হলে সব সড়কের অবস্থাই ভালো থাকবে। এতে ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাতায়াতে কোনো ধরনের বাধা থাকবে না। রাস্তা ভালো হলে যানজট হবে না। বাংলাদেশে সবচেয়ে নিরাপদ ও আরামদায়ক ভ্রমণ হলো রেল। আর সড়কপথগুলোতে ট্রাফিক জ্যামের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসে বসে থাকতে হয়। তাই সড়কপথগুলো ঈদের ছুটির আগে মেরামত করার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি কোনো চালক ট্রাফিক আইন মেনে না চলে, তা হলে তার বিরুদ্ধে ট্রাফিক আইনের যা শাস্তির কথা বলা আছে, সেটির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি রেলপথে বাড়তি ট্রেন সংযুক্ত করতে হবে। যাতে ঈদে ঘরমুখো মানুষ নিরাপদে বাড়িতে যেতে পারে। সব যাত্রীকে মনে রাখতে হবে, হকারদের কাছ থেকে কোনো জিনিস কেনাকাটা ও খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে মানুষ বাড়িতে যাবেই, এটা যেমন সত্য; সড়কপথ এত অল্প সময়ে নির্বিঘœ করা যাবে না, তা-ও মেনে নিতে হবে। ঈদের সময় যেহেতু চাপ বাড়ে, মহাসড়কের মেরামতের কাজ এত দ্রুত সম্ভব নয়। এ বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। শৃঙ্খলা বজায় রাখলে যাত্রা নির্বিঘœ করা সহজ হবে। এ বিষয়ে প্রশাসনের বড় ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। র‌্যাবের যে তৎপরতা চলছে, এটা যেন অব্যাহত থাকে। আর এ ব্যাপারে সরকার ও প্রশাসনের সরাসরি তদারকি দরকার। পরিশেষে বলব, নিরাপদ হোক সবার পথযাত্রা এবং ঈদ হোক আনন্দের।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close