ইমানুল সোহান

  ১৯ মে, ২০১৯

শিক্ষা

বৈষম্যের লাগাম টানতে হবে

একটি রাষ্ট্রের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখেন শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত। তবে একটি রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়ন তখনই নিশ্চিত হয় যখন রাষ্ট্রের মধ্যে বৈষম্যের হার হ্রাস পায়। নতুবা রাষ্ট্রের মধ্যে বিভাজনের চিত্র ফুটে ওঠে। সৃষ্টি হতে থাকে বহুবিধ সমস্যা। ঠিক এমন সমস্যার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার পরতে পরতে এখন বৈষম্য। যে বৈষম্যের কারণে দেশে বাড়ছে বেকারত্বের হার।

আমাদের শিক্ষা বহুধাবিভক্ত। বিভক্তির এই শিক্ষাব্যবস্থায় এখন যোগ হয়েছে বৈষম্য। গ্রাম-শহরের শিক্ষায় এখন বৈষম্য, বৈষম্য ধনী-দরিদ্রের শিক্ষালাভের সুযোগে। ফলে শিক্ষা পরিণত হয়েছে দামি পণ্যে। বৈষম্যের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রামীণ, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা। যে শিক্ষা তাদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তা রুজি-রুটির কোনোটারই নিশ্চয়তা দিতে পারছে না, মর্যাদার প্রশ্ন সেখানে একেবারে অবান্তর।

তিন স্তরে বিভক্ত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। যার মধ্যে রয়েছে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা তথা বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়। প্রথমত, মাধ্যমিক পর্যায়ে লক্ষ করা যাক। একজন শিশুর মেধাশক্তি বিকাশের যাত্রা শুরু হয় এ পর্যায় থেকে। কিন্তু দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ে বৈষম্যের হার প্রকট আকার ধারণ করেছে। সেটা বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়। এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো নি¤œবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য। কারণ সচেতন অভিভাবকেরা মনে করছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানসম্মত পাঠদান দেওয়া হয় না। কথাটি নিতান্তই সত্য। যার ফলে অভিভাবকেরা ছুটছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে। আর সেখানেই সৃষ্টি হচ্ছে বৈষম্য।

একটি পরিসংখ্যানের দিকে চোখ বুলানো যাক, ঢাকা মহানগরীতে প্রায় ৩০০ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে অবকাঠামো, খেলার মাঠ, শিক্ষকসহ অন্যান্য সকল সুবিধা থাকার পরও সেখানে অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের ভর্তি করাতে চান না। মূলত এসব স্কুলে নি¤œবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা পড়ালেখা করে। অন্যদিকে ঢাকা মহানগরীতে ৩২১টি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। যার সবই শুরু হয় প্রথম শ্রেণি থেকে। এর মধ্যে ২০ থেকে ২৫টি নামিদামি স্কুল। এসব প্রতিষ্ঠানে অভিভাবকেরা তাদের সন্তানকে ভর্তি করাতে সর্ব্বোচ চেষ্টা করে থাকেন। এরকমভাবে ঢাকার বাহিরে বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোর একই অবস্থা।

দ্বিতীয়ত উচ্চমাধ্যমিক। সম্প্রতি এসএসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। সেই ফলের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের ভর্তি হতে হবে উচ্চমাধ্যমিকে। যেসব শিক্ষার্থী মেধার স্বাক্ষর রেখে জিপিএ-৫ পেয়েছে তারা ভালো কলেজে ভর্তির সুযোগ পাবে। বিষয়টি স্বাভাবিক। যারা ভালো ফল করতে পারেনি তাদের কপালে ভালো কলেজে পড়ার সুযোগও নেই। আমার কথাটি ঠিক এই জায়গায়। তাহলে যারা খারাপ ফল করেছে তারা কোথায় গিয়ে ভালো শিক্ষা গ্রহণ করবে। এ জায়গাটি দিনের পরিক্রমায় শিক্ষাব্যবস্থা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। প্রথা হচ্ছে, ভালোরা ভালোই করবে খারাপরা হারিয়ে যাবে। কারণ তাদের অর্থ নেই ভালো স্কুলে পড়ার। তাহলে অর্থের মানদন্ডে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এগিয়ে যাচ্ছে।

দেখা যায়, শহরের নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর হার অনেক বেশি। এক প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ কিংবা তারও অধিক জিপিএ-৫ পাওয়ার খবর পত্র-পত্রিকায় পাওয়া যায়। এসব প্রতিষ্ঠানে কাদের সন্তানেরা পড়ালেখা করে? নিশ্চয়ই সবাই জানেন। সুযোগ হয়েছিল এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কিছুদিন কাজ করার। সেই সুবাধে কীভাবে খুব সহজে জিপিএ-৫ পাওয়া যায়, সেটা দেখেছি। পাবলিক পরীক্ষার সময় এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা কেন্দ্রের এক কক্ষে বসানো হয়। যাতে সবাই ভালো ফল করতে পারে। দিনশেষে তা-ই হয়। কারণ পাঁচ থেকে ১০ জন মেধাবীর হাতে নামেমাত্র সার্টিফিকেটে জিপিএ-৫ যোগ হচ্ছে শত শিক্ষার্থীর। তা সম্ভব হচ্ছে নামকরা প্রতিষ্ঠানে পড়ার কারণে। তবে সব প্রতিষ্ঠান এমন তা কিন্তু নয়। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের চরিত্র এমনই। ফলে রেজাল্ট বৈষম্যের শিকার হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা।

তবে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মুখোস উন্মোচিত হয় পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষার সময়। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে যে হারে জিপিএ-৫ আসে, সে হারে পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে চান্স পায় না। কারণ কী? অর্থের মানদন্ডে অর্জিত শিক্ষা দিনশেষে হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় এসে। ঠিক এ জায়গাটি থেকে আমাদের অভিভাবক ও শিক্ষকদের বেরিয়ে আসতে হবে। নতুবা দিনশেষে শূন্য হাতে সবাইকে ফিরে আসতে হবে।

তৃতীয়ত, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সর্বশেষ স্তর উচ্চশিক্ষা তথা বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়। উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে দেশের লাখো শিক্ষার্থী ভর্তি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়। এই পর্যায়ে এসে একজন শিক্ষার্থীকে বেশ কষ্ট করতে হয়। বিশেষ করে নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবার থেসে উঠে আসা শিক্ষার্থীদের। কারণ বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে বৈষম্যের চিত্রটি আরো প্রকট। শিক্ষা গ্রহণে তেমন বৈষম্য না হলেও রয়েছে থাকা ও খাওয়ার বৈষম্য। ছাত্র রাজনীতি না করলে হলে ছিট হয় না। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অনেক হলে শিক্ষার্থীদের বারান্দায় থাকতে দেখা যায়। অথচ ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতারা চারজনের ছিটে একজন থাকেন। ফলে নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের থাকতে হয় হলের বারান্দায়। যে দলই ক্ষমতায় আসে ঠিক সেই দলের ছাত্র সংগঠনগুলো এ কাজটি করে থাকে। এভাবে দেশের সব পাবলিক বিদ্যালয়গুলোতে বৈষম্যের শিকার হন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আর সাধারণ শিক্ষার্থী বলতে নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান।

চতুর্থত চাকরিতে আসা যাক। এখন সরকারি চাকরিকে সোনার হরিণ বলা হয়। কারণ যোগ্যতা, মেধার সঙ্গে অর্থ ও রাজনীতির মানদন্ডে ভাগ্যে জুটছে সরকারি চাকরি। যাতে বিত্তবানরা বরাবরে এগিয়ে আছেন। মেধায় নিয়োগ হচ্ছে না এমনটি নয়। কিন্তু সেটি সংখ্যায় অপ্রতুল। দেশের বিশ^বিদ্যালয়গুলোর নিয়োগ প্রক্রিয়ার দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। যেখানে মেধার বিপরীতে দলীয় বিবেচনা, ভিসিপন্থি নিয়োগ, স্বজনপ্রীতিসহ কতিপয় উপায়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হচ্ছেন মেধাবীরা। যথার্থ পাঠগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। ২০১৬ সালে ১৩টি পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের ওপর টিআইবির করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, আটটি বিশ^বিদ্যালয়েই প্রভাষক নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। এ পদে নিয়োগে ৩ লাখ থেকে সর্ব্বোচ ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে। এছাড়াও ইচ্ছামতো নিয়োগ বোর্ড গঠন, সুবিধামতো যোগ্যতা পরিবর্তন বা শিথিল করা, জবাবদিহি না থাকার মাধ্যমে এই অনিয়মের শুরু। আর ১৩টির মধ্যে ১২টি বিশ^বিদ্যালয়ে নিয়োগ বোর্ড গঠনে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব ঘটানোর সুযোগ বিদ্যমান। তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়াল। মেধাবী হলেই হবে না নেতা ও টাকাওয়ালা হতে হবে। বর্তমান সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়ার অবস্থা আরো নাজুক। প্রায়ই বিভিন্ন পত্রিকায় শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের অডিও ফাঁসসহ টাকা লেনদেনের বিষয়টি ওঠে আসে। কিন্তু কে করবে কার প্রতিকার। ফলে অদক্ষ আর যোগ্যহীন ব্যক্তিরাই জাতির মেরুদন্ড তৈরির আসনে বসে যাচ্ছেন। এ থেকে অচিরেই আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। নতুবা দেশে শিক্ষিতদের হার বাড়বে একই সঙ্গে বাড়বে বেকারের হার।

এই বৈষম্যগুলো ঘুচাতে হলে দেশের কর্তাব্যক্তিদের কয়েকটি সমস্যার সমাধানে আসতে হবে। তন্মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। একইসঙ্গে বিদ্যালয়গুলোতে সরকারি মনিটরিং বাড়াতে হবে। যাতে করে শিক্ষকরা পাঠদানে ফাঁকি দিতে না পারেন। গ্রামাঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে বাড়তি নজর দিতে হবে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষাবাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। নতুবা উপরোক্ত সমস্যাগুলোর সমাধান সাধিত হবে না। আর এসব সমস্যার সমাধান করতে না পারলে দিনের পরিক্রমায় দেশে শিক্ষিতদের হার বাড়বে কিন্তু বেকারত্বের হার কমবে না। বেকারত্বের হার কমাতে হলে শিক্ষায় বৈষম্য হ্রাস করতে হবে। এখনই শিক্ষায় বৈষম্যের লাগাম টেনে না ধরতে পারলে এক সময় শিক্ষা অর্থের মানদন্ডে উপমিত হবে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে অভিভাবক ও শিক্ষদের সহযোগিতা করতে হবে। কেননা আভিজাত্যের বশবর্তীতে অর্থের মানদন্ডে সন্তানদের শিক্ষিত করার চেয়ে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সর্বোপরি আগামীর বাংলাদেশ হবে মেধায় ভর করে বৈষম্যের করাঘাতে মুক্ত একটি দেশ।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close