মোহাম্মদ আবু নোমান

  ০৯ মে, ২০১৯

বিশ্লেষণ

বিপ্লবের অনুসরণীয় বিপ্লবী দৃষ্টান্ত

মাঝেমধ্যে আমাদের প্রিয় দেশটাকে নিয়ে হতাশ ও নিরাশ হতে হয়। কতিপয় শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত, ধনকুবের দ্বারাও যখন দুর্নীতি, নৈতিক অবক্ষয় ও রাষ্ট্রীয় তহবিল তছরুপের খবর আমরা দেখে থাকি, শুনে থাকি; তখন মনবেদনা নিয়েও ভাবতে হয়, পৃথিবীর সর্বত্র যখন এগিয়ে যাচ্ছে, আর আমরা তখনো পিছিয়ে যাচ্ছি! কিন্তু না! সারা দেশ যখন ‘ফণীর’ ভয়ংকর ছোবলের আতঙ্কে আতঙ্কিত ছিল, এর মাঝেই আমাদের আশা ও আলো দেখিয়েছেন, ‘দেশ বিপ্লবের’ সমূহ সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছেন রাজশাহীর আড়ানীর হোটেল ব্যবসায়ী বিপ্লব সরকার নামের এক যুবক।

বিপ্লবের এসএসসি পরীক্ষাটা দেওয়া হয়নি। লেখাপড়া না করে কী ভুল করেছেন, এখন তিনি বুঝতে পারেন। এজন্য যে বাচ্চারা লেখাপড়া শিখছে, তারা যেন শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে পারে, তার জন্য তিনি তার সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পারছেন, সহযোগিতা করছেন।

গায়ে স্কুল ড্রেস আর পকেটে পাঁচটি টাকা থাকলেই বিপ্লবের হোটেলে দুপুরে ডাল-ভাত খাওয়া যায়। শুধু স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য দুপুরে ভাত খাওয়ার এই ‘পাঁচ টাকার প্যাকেজ’ তিন বছর ধরে চালু রেখেছেন বিপ্লব সরকার। শ্যামল সরকারের ছেলে বিপ্লবের বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানি পূর্বপাড়া মহল্লায়। ‘অন্নপূর্ণা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’ নামে আড়ানী বাজারের তালতলায় বড়াল নদের ধারে বিপ্লব সরকারের হোটেল। আড়ানী মনোমোহিনী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই হোটেলে পাঁচ টাকায় দুপুরের খাবার সেরে নেয়। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সঞ্জয় কুমার এই পাঁচ টাকার প্যাকেজ সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, তিনি তার স্কুলের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শোনার পরে এক দিন দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি দেখে অবাক হয়েছেন।

অনেক অনেক ধন্যবাদ, সাধুবাদ, স্যালুট, বিপ্লব সরকারকে। বিপ্লবরা আজও আছে বলেই পৃথিবীটা এখনো এত সুন্দর। কে বলেছে বিপ্লব শিক্ষিত নয়? রবং স্বশিক্ষায় শিক্ষিত বিপ্লবের কর্ম, জ্ঞান, অনেক অনেক ডিগ্রি ও ডক্টরেটধারীদের থেকেও উন্নত। আমাদের মানসিকতা বিপ্লবের পর্যায়ে পৌঁছতে পারলে দেশের অনেক কঠিন সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। বিপ্লব বলেন, ‘মনের আনন্দেই এটা করছি, সেবার মানসিকতা থেকে করছি।’ রেয়ার হলেও পিওর সাদামনের নিঃস্বার্থ ভালো মনের মানুষ এখনো পৃথিবীতে আছে। যাদের কারণেই হয়তো পাপ আর পাপিতে পূর্ণ এই দুনিয়ার অস্তিত্ব এখনো আছে! মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো মানবতার অন্যান্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী বিপ্লবের প্রতি তার কর্মগুণেই শ্রদ্ধা চলে আসে। ব্যাপক ধন-দৌলতধারী মানুষ অপেক্ষা বড় মনের মানুষই উত্তম, বিপ্লবই তার উদাহরণ।

এ দেশের তথাকথিত অভিজাত ভদ্রলোক, কোটিপতিদের মানসিকতা যদি এ রকম হতো, তা হলে কতই না ভালো হতো! বিপ্লবই তো সত্যিকারের একজন দেশপ্রেমিক, শিক্ষানুরাগী, অনুকরণীয়, অনুসরণীয়, মানবিক ও আদর্শিক দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী মানুষপ্রেমী সাহসী যুবক। যারা নীরবে-নিভৃতে, উদার মানসিকতা নিয়ে মহৎ কাজ করে চলেছেন। বিপ্লবের সামর্থ্য কম, কিন্তু ইচ্ছা, চেষ্টা, বাসনা পাহাড়সম। একজন সাধারণ মানুষ কীভাবে অসাধারণ হয়ে ওঠে, বিপ্লব তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

বিপ্লব সরকার বলেন, গ্রামের অধিকাংশ বাচ্চাই বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে আসে না। অনেকের বেশি টাকা দিয়ে হোটেলে দুপুরের খাবার কিনে খাওয়ার মতো সামর্থ্যও নেই। তারা স্কুলে এসে টিফিনের সময় আশপাশের দোকান থেকে মুখরোচক কিছু একটা কিনে খায়। এগুলো স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। অথচ দুপুরে এক প্লেট ভাত খেতে পারলে তাদের শরীরটা ভালো থাকে। এই চিন্তা থেকেই বাবার অগোচরে পাঁচ বছর আগেই তিনি এই প্যাকেজ চালু করেন। তখন থেকেই বাচ্চারা খেতে আসতে শুরু করে। তবে তার বাবা দুই বছর পর বিষয়টি জানতে পারেন। তবে তিনি এতে বাধা দেননি।

বর্তমানে পবিত্র রমজান চলছে, রমজান মাসে আজ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের অবস্থা একেবারেই শোচনীয়। সাহরি, ইফতারিতে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের পেটভরে খাওয়ারও সুযোগ নেই। দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া! অভিন্ন দুর্ভোগের মাত্রা রমজানে অসহনীয় হয় খেটে খাওয়া মানুষের জন্য। সবার সামর্থ্য সমান নয়, অনেকে রোজা রেখে ইফতারসামগ্রী জোগাড় করতে হিমশিম খায়। মুসলিম হিসেবে আসলেই আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংযমের মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য হ্রাস করে জনগণের সেবা করা হয়। আমাদের দেশে বিষয়টি সম্পূর্ণ বিপরীত। রমজান এলেই দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া! যা যুগ যুগ ধরে চলমান। অথচ রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমিয়ে রাখার বক্তব্য, আলাপ ও নির্দেশ শোনা যায়, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। বাজারে খাদ্যের পর্যাপ্ত মজুদ ও সরবরাহ থাকার পরও কেন পণ্যের দাম বাড়ে, তা অনুসন্ধান ও প্রতিকার করা কি কোনো সরকারের সাধ্য, সামর্থ্য ও শক্তির বাইরে?

যে সময়ে শহরের ফুটপাতে এক কাপ রং চা খেতে ১০ টাকা লাগে, সেই যুগে ৫ টাকায় স্কুলের বাচ্চাদের ?দুপুরের খাবার খাইয়ে পুুরো বাংলাদেশকে বিপ্লব দেখিয়ে দিয়েছে! হরতাল, ধর্মঘট, আমরণ অনশন, আন্দোলন, এটা চাই, ওটা চাই, আমাদের দাবি মানতে হবে ইত্যাদি সারাজীবন ধরে আমরা শুনেছি। কিন্তু এসব না করেও বিপ্লবের মতো অল্প কিছু মানুষ একটা দেশকে অনেক ওপরে নিয়ে যেতে পারে, বিপ্লবই তার বাস্তব উদাহরণ।

বিপ্লব সরকার বলেন, বাচ্চাদের তিনি কয়েকটি শর্তে খেতে দেন। তার প্যাকেজ খেতে হলে অবশ্যই স্কুল ড্রেস পরে আসতে হবে। আর খাবার আগে বা পরে বাইরের দোকানে অন্য কোনো মুখরোচক খাবার খাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, তিনি দেখেছেন বেশির ভাগ বাচ্চাই এক প্লেটের বেশি ভাত খেতে পারে না। তিনি ভাতের সঙ্গে সবজি আর ডাল দিয়ে একটি প্যাকেজ তৈরি করেছেন। খাবার সময় তিনি খেয়াল করেন, কোনো বাচ্চা যেন সবজি নষ্ট না করে। শরীরের জন্য সবজির বড় প্রয়োজন। তিনি তাদের সবজি খেতে বাধ্য করেন। টমেটোর মৌসুমে টমেটোর সালাদ খেতে বাধ্য করেন। এই প্যাকেজ তিনি পাঁচ টাকায় দেন। তবে পাশাপাশি খেতে বসে কোনো বাচ্চা যদি বেশি টাকা দিয়ে মুরগির মাংস খেতে চায়। তা হলে তিনি পাশের বাচ্চাটাকেও ছোট এক টুকরা মুরগির মাংস ও একটু ঝোল দেন। যাতে তার মন খারাপ না হয়।

মানবতার কোনো সীমানা, ধর্ম, বর্ণ, বয়স নেই। বিপ্লবকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও শুভ কামনা। বিপ্লবের মতো যুবকদের মহতি ও মানবতাধর্মী উদ্যোগের কারণেই, বিপ্লবের মতো মানুষ আছে বলেই এখনো আমরা ভালোভাবে বেঁচে থাকার, সোনার বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী গর্ব করার অনুপ্রেরণা পাই। এ রকম বড় মনের ও হৃদয়ের লোক আছে বলেই দেশকে নিয়ে এখনো আশা আছে। সব কিছু এখনো শেষ হয়ে যায়নি।

এ ছাড়াও বগুড়ার আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল সারা দিন উন্নত মানের খাবার বিক্রি করার পর রাতে গরিব, ভিক্ষুক, ভাসমান ছিন্নমূল ও অভাবী মানুষদের মুখে বিনামূল্যে খাবার তুলে দেওয়ার নজির স্থাপন করে আসছে। বগুড়া শহরের কবি কাজী নজরুল ইসলাম সড়কে অবস্থিত হোটেলটির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আকবর আলী মিঞা। হোটেল কর্তৃপক্ষ দীর্ঘ ৯৬ বছর ধরে বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করে আসছে।

‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য!’ আলোকিত মানুষ বিপ্লব ও বগুড়ার আকবর আলী প্রমাণ করলেন, এ সেøাগান এখনো বেঁচে আছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close