পঞ্চানন মল্লিক
মুক্তমত
দুর্যোগে দুর্ভোগে পদক্ষেপ
দুর্যোগ যেন নিত্য চলার সঙ্গী। বিভিন্ন দুর্যোগের সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয় দেশের অনেক মানুষকে। এসব দুর্যোগের মধ্যে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস অন্যতম। এতে আক্রান্ত হয় মানুষের জীবন ও জীবিকা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন এখন এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। হঠাৎ করে আক্রান্ত হয়ে জানমাল খোয়াতে হয় উপকূলবাসীর। বিগত দিনে কয়েকটি বড় বড় ঘূর্ণিঝড় এ দেশের দক্ষিণভাগকে বিপর্যস্ত করেছে। কেড়ে নিয়েছে হাজার হাজার প্রাণ। ক্ষতি হয়েছে ফসল, গবাদিপশু ও সম্পদের। একটার ক্ষত শুকাতে না শুকাতে এসে হাজির হয় আরেকটা। এমনিভাবে এসেছে সিডর, আইলা, নার্গিস, রোয়ানু, মহাসেন মোরাসহ আরো অনেক বড় বড় সাইক্লোন। এসব ঝড়ের ভয়ংকর চেহারা ও ক্ষয়ক্ষতির কথা মনে পড়লে এখনো আতঙ্কিত হতে হয়। চলতি সময়ের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ জনমনে বেশ আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করে। শেষ পর্যন্ত অনেকটা দুর্বল হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করায় এতে অতীতের তুলনায় ক্ষতির পরিমাণ অনেক কম হয়েছে। তাছাড়া এবারের ঝড়ে মানুষের মধ্যে পূর্ব প্রস্তুতিমূলক সচেতনতা ব্যাপক লক্ষ করা গেছে। প্রশাসনিক তৎপরতা, পর্যাপ্তসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক, রেড ক্রিসেন্ট প্রভৃতির সহায়তায় ঝড়ের সংকেত পাওয়ার পর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষকে সচেতন করা ও আশ্রয়কেন্দ্রে আনা সম্ভব হয়েছে। এতে লক্ষ করা গেছে মানুষের মধ্যে দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রস্তুতিমূলক সচেতনতা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।
প্রলয়ংকারী এসব ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে বাংলাদেশের দক্ষিণে অবস্থানরত বঙ্গোপসাগর। উত্তাপের কারণে সাগরে উত্তাল তরঙ্গ ও প্রচন্ড ঘূর্ণি বাতাসের সৃষ্টি হয়। ক্রমান্বয়ে ঘুরতে ঘুরতে এ ঝড় স্থলভাগের দিকে অগ্রসর হয়। একসময় উপকূলে আছড়ে পড়ে, আঘাত হানে মানুষের ঘরবাড়ি ও জানমালের ওপর। উপকূলবর্তী এলাকার নদীনালা ও চরাঞ্চলে স্বাভাবিক জোয়ারের তুলনায় পানি অনেক বৃদ্ধি পায়। দমকা হাওয়া বইতে থাকে। কখনো কখনো বৃষ্টিও থাকে সঙ্গে। প্রচন্ড ঘূর্ণি বাতাসে কাঁচা ঘরবাড়ি, গাছের ডাল ভেঙে চুরমার হয়। গাছপালা উপড়ে পড়ে। উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় এলাকা। তাই এসব ঘূর্ণিঝড় এলে মানুষের বিপদ বা দুর্ভোগের আর সীমা থাকে না। প্রথমত. এসব বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার মতো মজবুত ঘরবাড়ি অধিকাংশ উপকূলবাসীর নেই। উপকূলে বসবাসকারী লোকজন সাধারণত নিম্নবিত্ত বা দরিদ্রশ্রেণির। তাদের ঘরবাড়ি অধিকাংশ কাঁচা এবং এ রকম ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষার জন্য সহনশীল নয়। তাই এসব দুর্যোগের সময় মানুষ নিরাপত্তার অভাবে অসহায়ত্ব বোধ করে। অসহায় হয়ে সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা করা ছাড়া আর তেমন কোনো উপায়ান্ত থাকে না। অবশ্য উপকূলবাসীদের এমন দুর্যোগকালীন সময়ে সহায়তা প্রদান বা রক্ষার জন্য সরকারি উদ্যোগে উপকূল অঞ্চলে ইতোমধ্যে নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র বা সাইক্লোন সেল্টার। দুর্যোগের পূর্বাভাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় গ্রহণ করার জন্য বলা হয়ে থাকে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এসব আশ্রয়কেন্দ্রে সময়মতো আশ্রয় গ্রহণে মানুষের মধ্যে অনীহা লক্ষ করা যায়। মানুষ সাধারণত তাদের সংসারের জিনিসপত্র, গৃহপালিত পশুপাখি এসব রেখে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চায় না। তাই যতটা সম্ভব বিপদের ঝুঁকি নিয়ে এসব আগলে রাখার জন্য নিজের বাড়িতেই থেকে যান। তাছাড়া আশ্রয়কেন্দ্রগুলো অনেক ক্ষেত্রে দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত হওয়ায় মানুষ সময়মতো সেগুলোতে পৌঁছাতে পারেন না। কেউ কেউ একেবারে শেষ মুহূর্তে বিপদ নাকের ডগায় এলে ছোটেন আশ্রয়কেন্দ্রে। এ কারণে পথিমধ্যে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে যায়। উপকূলবর্তী অঞ্চলে এসব আশ্রয়কেন্দ্রের অপ্রতুলতা একটা বড় সমস্যা। আশ্রয় গ্রহণকারী মানুষের তুলনায় আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা কম। তাছাড়া স্কুল হিসেবে ব্যবহারের জন্য এর কোনো কোনোটি উপকূল হতে দূরবর্তী স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে প্রয়োজনের সময় এগুলো মানুষের উপকারে আসে কম। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে রয়েছে পর্যাপ্ত স্থান স্বল্পতা। পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপদ পরিবেশের অভাবও লক্ষ করা যায়। একসঙ্গে একই কক্ষে ভিন্নি ভিন্ন পরিবারের অনেক লোককে অবস্থান করতে হয়। এদের ভেতরে থাকে শিশু, কিশোরী, প্রতিবন্ধী, বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি, রোগাক্রান্ত ব্যক্তি প্রমুখ। রাতের বেলা সেখানে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা যায় না।
দুর্যোগ যখন এ দেশের মানুষের নিরন্তন সঙ্গী, দুর্যোগে যখন হানি হয় মানুষের জীবন ও সম্পদের, তখন দুর্যোগকালীন সময়ে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জীবনের সার্বিক নিরাপত্তা এবং সম্পদ ও ফসলাদি রক্ষায় প্রয়োজনীয় কার্যকরী ব্যবস্থা সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় জনসংখ্যার অনুপাতে পর্যাপ্তসংখ্যক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে বিকল্প আলোর ব্যবস্থা রাখতে হবে। নারী, শিশু, গর্ভবতী মহিলা, প্রতিবন্ধী, অসুস্থ ব্যক্তি, বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকতে হবে। মশার উপদ্রব থেকে রক্ষার ব্যবস্থাও রাখতে হবে। তা হলে দুর্যোগে দুর্ভোগের হাত থেকে মানুষকে অনেকটা নিরাপদে রাখা সম্ভব হবে। তবে কেবলমাত্র মানুষের কথাই নয়। দুর্যোগকালীন গৃহপালিত পশুপাখি ও মানুষের সাংসারিক জিনিসপত্র রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টির প্রতিও আমাদের খেয়াল করতে হবে। গৃহপালিত পশুপাখি রক্ষায় প্রয়োজনীয়সংখ্যক কেল্লা বা উঁচু স্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা যতটা কার্যকরী ও উন্নত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারব ততই দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে জানমালকে আমরা সহজে রক্ষা করতে পারব।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট
"