রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৮ মে, ২০১৯

বিশ্লেষণ

শৈশবকে বিবর্ণ করছে শিক্ষাব্যবস্থা

শৈশব মানব জীবনের এমন একটা অংশ যে সময়টা মনে করে একটা সময়ে এসে মানুষ রোমাঞ্চিত হয়, পুলক অনুভব করে। প্রতিটি মানুষের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই শৈশব। কারণ বয়সের একটা পর্যায়ে এসে মানুষ আবার এই বয়সে ফিরে আসতে চায়। শৈশবে বিভিন্ন সময়ের গল্প মানুষ তার পরিবারের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয়। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কোনো ছেলেমেয়ের কাছে। ফেলে আসা সেই দিনের কথা রোমন্থন করে একদিকে যেমন নিজে আনন্দ পায়, তেমনি বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা থেকে অন্যকেও আনন্দ দেওয়া যায়। আজকে যেমন আমার বা আমাদের সময়কার সেই ঘুড়ি উড়ানো, নদীতে সাঁতরে বা ডুব দিয়ে মাছ ধরা বা ডজন ডজন গ্রাম্য খেলাধুলার স্মৃতি মনে করে আনন্দ অনুভব করি। তবে বরাবরই শহরের ছেলেমেয়েরা গ্রামের ছেলেমেয়েদের দিক থেকে এসব গ্রাম্য দিকগুলো থেকে পিছিয়ে ছিল। কিন্তু আজ সময়টা ভিন্ন। আধুনিক সভ্যতা ক্রমেই খেয়ে ফেলছে গ্রাম্য চেনা সভ্যতাকে। ইট-পাথরের দেয়ালের কাছে গ্রাম্য মন আজ বন্দি। সেখান থেকে কোনো মতে, নিঃশ্বাস নেওয়া যায় কিন্তু ছোটাছুটি করা যায় না। আমি জানি, আজকের শিশুদের শৈশব অনেকটাই ভিন্ন। কী গ্রাম বা শহর সব জায়গাতেই একই অবস্থা। এ প্রজন্মের শৈশব একটু জটিল, যান্ত্রিকতায় ভরা। এর মোবাইলের রিংটোনে পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনে। আমরা আজ যে অতীত স্মরণ করে পুলকিত অনুভব করছি, সেদিনের সেই দাড়িয়াবান্ধা, ঘুড়ির সুতা কাটা, বৌচি বা মাংস চুরির মতো মাঠময় ছুটে বেড়ানো খেলা, সেসব খেলার সঙ্গে মাঠে প্রজাপতি আর ফড়িংয়ের পেছনে ছোটা, গামছা দিয়ে বর্ষার জলে মাছ ধরতে নামায় কাঁদায় মাখামাখি হয়ে মার হাতে বকুনি খাওয়ার মতো অতীত এখনকার ছেলেমেয়েদের থাকবে না।

একটি শিশুর জন্মের কিছুদিন পরেই বাবা-মা তাকে ঠেলে দিচ্ছেন নানা প্রতিযোগিতায়। এসব প্রতিযোগিতা শিশুদের মনে সৃষ্টি করছে চাপ। অনেক সময় এ চাপেই নষ্ট হচ্ছে তাদের সুন্দর শৈশব। সন্তানকে মানুষ হিসেবে নয়, বিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ নম্বরধারী শিশু হিসেবে গড়ে তুলতে কথা ফোটার সঙ্গে সঙ্গে অক্ষর চেনানো, ছড়া, আঁকা বা গান শেখানো শুরু করে দেন। ফলে তারা খেলাধুলার সময় পায় না। এতে করে শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশও বাধাপ্রাপ্ত হয় বলে মনোবিদরা মনে করেন। এরপর প্রাথমিকের গন্ডি পার হওয়ার আগেই অতিরিক্ত প্রস্তুতির জন্য বাড়ির শিক্ষক, কোচিং সেন্টার, বাবা-মার তত্ত্বাবধান সব মিলিয়ে শিশুর প্রাণ হয়ে ওঠে ওষ্ঠাগত। আর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো মাথার ওপর ঝুলতে থাকে পাবলিক পরীক্ষা। বিশেষ করে রাজধানীর বিভিন্ন নামিদামি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের করুণ অবস্থা সত্যিই কষ্টকর। এ বছর পিইসি পরীক্ষা যারা দেবে তাদের অবস্থা এমনÑ খেলাধুলার যেন একটুও সময় নেই তার। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতা করেই তাকে কোচিংয়ে যেতে হয়। এরপর দৌড় দিতে হয় স্কুলে। স্কুল শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আর বাসায় ফেরার পরই তাকে টিউটরের কাছে পড়তে হয়, এরপর ক্লাসের পড়া করা, হোমওয়ার্ক করা তো রয়েছেই। এমনকি সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতেও সে খেলাধুলার সময় পায় না। এদিনগুলোতে তাকে সকাল ও বিকেল দুবেলা কোচিং করতে হয়। প্রাথমিকের গন্ডি পার হওয়ার পরও কিন্তু এ চাপ ও প্রতিযোগিতা কমে না, উল্টো বাড়ে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার পর শিক্ষার্থীদের স্কুলে আরো দুটি পাবলিক পরীক্ষা দিতে হয়। এ ছাড়া মূল্যায়ন পরীক্ষার নামে শ্রেণি পরীক্ষা, সাময়িক পরীক্ষা, অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা ও বার্ষিক পরীক্ষা তো ধরাবাঁধা।

এমনকি এসব পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া ও প্রথম হওয়ার জন্য প্রায় সব বাবা-মাই শিশুর ওপর প্রচন্ড চাপ দেন। অনেক বাবা-মা মনে করেন ছবি আঁকা, গান শেখানোর মতো আনন্দের কাজও তো করছে ওরা। কিন্তু সেখানেও প্রতিযোগিতা আর পুরস্কারের যন্ত্রণা আছেই। শুধু নেই আনন্দ। মনের আনন্দে যা খুশি আঁকা বা গাওয়া নয়, নিয়ম মেনে করতে গিয়ে সেসব কাজও পড়ার চাপের মতোই ভারি হয়ে ওঠে। তাই এসব অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও চাপ বন্ধের প্রয়োজন। অভিভাবকদের বুঝতে হবে শিশুরা যন্ত্র নয়। তাই তাদের ওপর থেকে চাপ কমাতে হবে। তারা যা করতে পারবে না, তা কখনোই তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। শিশুরা যেন সব কাজ আনন্দের সঙ্গে করতে পারে, সেটা ভাবতে হবে। এ ছাড়াও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ছিনিমিনি বন্ধের প্রয়োজন। পিইসি পরীক্ষা একবার তুলে নেওয়া, আবার রাখা, হঠাৎ করে পরীক্ষায় সৃজনশীল বাড়ানো, এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাপের সৃষ্টি করে। আসলে পিইসি পরীক্ষা তুলে নেওয়াই উচিত। কেননা এই পরীক্ষাকে কেন্দ্র করেই অভিভাবকরা অল্প বয়সেই শিশুদের প্রতিযোগিতায় ঠেলে দিচ্ছেন।

মিথ্যা প্রতিযোগিতা আর মানসিক চাপ নিয়ে বেড়ে ওঠা শিশুদের মধ্যে সারা জীবনের জন্য বৈকল্য সৃষ্টি হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে একধরনের মানসিক দৈন্য। এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা শিশুর শৈশবকে বিবর্ণ করছে, তাকে স্বার্থপর ও অসামাজিক করে তুলছে, তাদের দলীয় মনোভাব ও নেতৃত্বের স্পৃহা নষ্ট করছে, নান্দনিক অনুভূতিকে ভোঁতা করে দিচ্ছে; সর্বোপরি তাদের মানুষ নয়, বরং যন্ত্রে পরিণত করছে। অতিরিক্ত বইয়ের চাপে ফিকে হয়ে আসা তাদের বিবর্ণ শৈশবের বেদনা কেউ বোঝে না; বুঝলেও করার কিছু থাকে না।

আর তখন কেবলই মনে পড়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তোতাকাহিনির কথা, যেখানে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর পাখিটির মৃত্যু হয়েছিল শিক্ষা লাভের অত্যাচারে। বিভিন্ন অভিজ্ঞতা কিন্তু বিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতা নয়। ঘরে ঘরে শিশু-কিশোর এবং তাদের অভিভাবকরা এ পরিস্থিতিকেই বাস্তবতা বলে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বলা হচ্ছে শিশুদের ওপর পড়ার চাপ কমানোর কথা। এই তো কয়েক দিন আগে প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ, ২০১৯-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলছেন, শিশুদের পড়ার জন্য অতিরিক্ত চাপ দেবেন না। তা হলেই দেখবেন তারা ভেতরে একটা আলাদা শক্তি পাবে। তাদের শিক্ষার ভিতটা শক্তভাবে তৈরি হবে। কিন্তু এসব আহ্বানের কোনো বাস্তব প্রতিফলন দেখি না প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায়। কী ইংরেজি মাধ্যম, কী বাংলা মাধ্যম, কী কিন্ডারগার্টেন কোথাও স্বস্তি নেই শিক্ষার্থীদের। কিছুদিন আগে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০১৮ : লার্নিং টু রিয়েলাইজ এডুকেশন প্রমিজ’-এ বেরিয়ে এসেছে যে, প্রাক্-প্রাথমিক থেকে শুরু করে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১১ বছরের স্কুলজীবনের মধ্যে সাড়ে চার বছর সময়ই নষ্ট হচ্ছে দুর্বল শিক্ষা পদ্ধতির কারণে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর প্রকাশিত ন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট ২০১৫-এ দেখা গেছে, তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ৩৫ শতাংশ বাংলায় এবং পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ২৫ শতাংশ গণিতে কাক্সিক্ষত যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। মূলধারার শিক্ষাদান পদ্ধতি, কারিকুলাম, শিক্ষকদের গুণগত মান ইত্যাদি নিয়ে বহু দিন ধরেই রয়েছে নানা বিতর্ক।

উল্লেখ্য, পরীক্ষানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এই স্রোতধারায় গাইডবই এবং কোচিং-বাণিজ্যের জয়জয়কার। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের অধিকাংশ শিক্ষক এখনো অর্জন করতে পারেননি সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন করার যোগ্যতাটুকু। অন্যদিকে, কিন্ডারগার্টেন ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর ওপর নেই সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ। ওই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়ার নামে শিক্ষার্থীর ওপর অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দিচ্ছেন বইয়ের বোঝা। যেন রোবট-মানব বানানোর ব্রত নিয়ে তারা বাজারে অবতীর্ণ হয়েছেন। রোবটে যে যত বেশি ইনপুট দিতে পারছে, সেই রোবটের বাজার কাটতি তত বেশি। স্কুলপড়ুয়া এই শিশু-কিশোরদের জন্য ভয় হয়! রবীন্দ্রনাথ তার ‘তোতাকাহিনি’ শেষ করেছিলেন এভাবে, ‘পাখি আসিল। সঙ্গে কোতোয়াল আসিল, ঘোড়সওয়ার আসিল। রাজা পাখিটাকে টিপিলেন, সে মুখ হাঁ করিল না, হু করিল না। কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খসখস গজগজ করিতে লাগিল।’ আমাদের সন্তানদের অবস্থাও যে অনেকটা ‘তোতাকাহিনি’র পাখির মতো, কর্তাব্যক্তিরা কি তা মানেন? শৈশব এমন যেন না হয় যে মনে পড়লেই আতঙ্কিত হতে হয়। কম্পিউটার, ট্যাবলেটে গেমস ছাড়া এরা আর কোনো খেলার নামই জানে না। এরা মুক্ত আকাশ দেখতে জানে না। খোলা মাঠে ছোটাছুটি করতে জানে না। এ প্রজন্মের সন্তানদের আসলে কোনো বলার মতো কোনো শৈশব থাকবে না। জীবনে লেখাপড়ার যে দরকার নেই, বিষয়টা এমন নয় বা আমার লেখার উদ্দেশ্য সেটা নয়। কিন্তু যদি এমন হয় যে, আমাদের সন্তানের শৈশবটা আমরা বইভর্তি ব্যাগ দিয়ে পূর্ণ করছি, তা হলে তা অবশ্যই অন্যায় হচ্ছে। সীমাবদ্ধ জ্ঞান দিয়ে মুক্ত আকাশের সন্ধান পাওয়া সম্ভব নয়, ইহাই চিরন্তন সত্য।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close