লায়ন মো. শামীম সিকদার

  ০৭ মে, ২০১৯

বিশ্লেষণ

যৌন হয়রানি বন্ধে নির্দেশনা বাস্তবায়ন জরুরি

যৌন হয়রানির বিচার চাওয়ায় ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে নিজ মাদরাসার ছাদে নিয়ে গায়ে কেরোসিন দিয়ে আগুন লাগিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে দেশের মানুষ এখন সোচ্চার। আরো কিছুদিন এ দাবিতে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি চলবে। তারপর হয়তো কিছুদিন পর দেশের অন্যান্য আলোচিত ঘটনার মতো এ ঘটনাও হারিয়ে যাবে অথবা দেশের সচেতন মানুষের কঠোর অবস্থানের কারণে রাফির হত্যাকারীদের বিচার হবে। তবে আর কত রাফি এ রকম ঘটনার শিকার হবে? যৌন হয়রানির হাত থেকে রাফিরা কি কোনো রেহাই পাবে না? মেয়েরা আর কত যৌন হয়রানির বলি হবে? দেশের ছাত্রীদের যৌন হয়রানির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক। যৌন হয়রানি বন্ধে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করে তার কার্যক্রম জোরদার করাসহ বিভিন্ন নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ কমিটি গঠনের নির্দেশনা থাকলেও তা এত দিন কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল। মাধ্যমিক থেকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যদি যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি কার্যকর এবং হাইকোর্টের নির্দেশনা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যায়; তা হলে আমার বিশ্বাস যৌন হয়রানির মাত্রা কমে আসবে। প্রতিষ্ঠানভিত্তিক এ কমিটি গঠন হলে যৌন হয়রানির বিচার যথাযথভাবে হবে এবং বিচার চাইতে গিয়ে আবার যৌন হয়রানি, নির্যাতিতকে হত্যা এবং বিচার না পেয়ে আত্মহত্যার সংখ্যাও কমবে।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট কর্মস্থল এবং শিক্ষাঙ্গনে নারী ও শিশুদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধের জন্য দিকনির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্ট বিভাগে জনস্বার্থে একটি রিট আবেদন করেন। শুনানি শেষে ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট এ রিটের রায় দেন। এই রায়ে হাইকোর্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ সব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠন করার আদেশ দেন। হাইকোর্টের এ রায়ের পর বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। তাই যৌন নির্যাতন বন্ধে মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ কমিটি গঠনে রাষ্ট্রের কঠোর নির্দেশ প্রয়োজন। হাইকোর্টের ওই রায়ে বলা হয়, কমিটিতে কমপক্ষে ৫ জন সদস্য থাকবেন। এই কমিটির বেশির ভাগ সদস্য হতে হবে নারী এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে দুজন সদস্য নিতে হবে। আরো বলা হয়, সম্ভব হলে একজন নারীকে কমিটির প্রধান করতে হবে। এ বিষয়ে সচেতনতা ও জনমত তৈরির জন্য হাইকোর্টের নির্দেশনায় আরো বলা হয়েছে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতি শিক্ষাবর্ষের পাঠদান কার্যক্রমের শুরুতে এবং প্রতি মাসে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ওরিয়েন্টশনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং সংবিধানে বর্ণিত লিঙ্গীয় সমতা ও যৌন নিপীড়ন সম্পর্কিত দিকনির্দেশনাটি বই আকারে প্রকাশ করতে হবে। হাইকোর্টের এ নির্দেশনা আইনে রূপান্তর না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ নির্দেশনাই আইন হিসেবে কাজ করবে এবং সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ নীতিমালা প্রযোজ্য হবে। হাইকোর্টের রায়ে যৌন নিপীড়নের সংজ্ঞায় বলা হয়, শারীরিক ও মানসিক যেকোনো ধরনের নির্যাতনই যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে। ই-মেইল, এসএমএস, টেলিফোনে বিড়ম্বনা, পর্নোগ্রাফি, যেকোনো ধরনের চিত্র, অশালীন উক্তিসহ কাউকে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে সুন্দরী বলাও যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। শুধু কর্মস্থল কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এ ধরনের হয়রানি ঘটে না, রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের অশালীন উক্তি, কটূক্তি করা, কারো দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকানো যৌন হয়রানি হিসেবে গণ্য করা হবে। রায়ে বলা হয়, কোনো নারীকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, যেকোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করা, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে সম্পর্ক স্থাপন, অশালীন চিত্র, দেয়াল লিখন, আপত্তিকর কিছু করাও যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে।

যৌন হয়রানি রোধে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির পক্ষে অ্যাডভোকেট ফাহিমা নাসরিন মুন্নী ২০১০ সালের ২ নভেম্বর জনস্বার্থে হাইকোর্টে অপর একটি রিট করেন। দীর্ঘদিন শুনানির পর আদালত কয়েক দফা নির্দেশনাসহ রায় প্রদান করেন। এ ছাড়া ২০১১ সালের ২৬ জানুয়ারি যৌন হয়রানি বন্ধে সাত দফা নির্দেশনাসহ রায় প্রদান করেন হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি মো. ইমান আলী ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের দ্বৈত বেঞ্চ। আদালতের এই বেঞ্চের দেওয়া রায়ে বলা হয়, ইভ টিজিং শব্দটি অপরাধের মাত্রা হালকা করে দেয়, এর পরিবর্তে সর্বস্তরে যৌন হয়রানি শব্দটি ব্যবহার করতে হবে। প্রতিটি থানায় নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য একটি করে সেল গঠনের আদালতের নির্দেশ ছিল। এই সেল প্রতি মাসে পুলিশ সুপারের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবে। কিন্তু এই সেলে অস্তিত্ব আছে বলে লক্ষ করা যায় না।

হাইকোর্টের এসব নির্দেশনা থাকলেও বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তা মানছে না এবং এই নির্দেশ মানা ও না মানার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে নেই কোনো নজরদারি। হাতেগোনা কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠন করলেও তার কোনো কার্যক্রম নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ কমিটি থাকলে যৌন হয়রানি তুলনামূলক কম হতো। প্রতিষ্ঠানপ্রধান, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী যে কেউ যৌন হয়রানি করলে ওই কমিটির কাছে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ জানাতে পারত। যৌন হয়রানির বিষয়ে এ গাফিলতির কারণে উৎসাহী করছে ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার মতো যৌন নিপীড়ককে। এর ফলে জীবন দিতে হলো নুসরাত জাহান রাফির মতো এক মেধাবী ছাত্রীকে। অধ্যক্ষের কাছে বিচার না পেয়ে পুলিশের কাছে গিয়েও রাফি হয়রানির শিকার হয়েছে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাফির মতো আর যেন কোনো শিক্ষার্থী অকালে ঝরে না যায়, তার জন্য যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করে তা কার্যকর করা এখন সময়ের দাবি। যেহেতু এ কমিটির অধিকাংশ সদস্য নারী, তাই ছাত্রীরা দ্বিধাহীনভাবে তাদের কাছে সব কথা বলতে পারবে। এ কমিটি ছাত্রীদের কাউন্সিলিং করতে বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনার প্রয়োগ ও কার্যকারিতা নিয়ে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দীর্ঘ ১০ বছর হয়ে গেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। গবেষণাটিতে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ শিক্ষার্থী অংশ নেন। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সংস্থা, পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান, সংবাদমাধ্যমের ২০ জন ব্যক্তির ওপর এ গবেষণা করা হয়। প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে অ্যাকশনএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেছিলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে হাইকোর্টের নির্দেশনা মানে সেটি আইন। তবে সেই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। ফলে নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিকার বা প্রতিরোধ হচ্ছে না। যেটির ভয়াবহতা আমরা বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি। নারীরা ঘরে-বাইরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সমস্যা সমাধানে হাইকোর্টের নির্দেশনার বাস্তবায়ন খুবই জরুরি। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাড়াতে হবে। যারা হাইকোর্টের নির্দেশনা মানেন না, তাদের ক্ষেত্রে জবাবদিহি করতে হবে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সচেতনতার অভাবেই মূলত হাইকোর্টের ২০০৯ সালের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তাই এ সম্পর্কে সর্বস্তরে বিশেষত, কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। আদালতের নির্দেশনা যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়, সেজন্য সরকারি উদ্যোগে একটি তদারকি কমিটি থাকা উচিত। ওই কমিটিতে সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, ট্রেড ইউনিয়ন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা থাকবেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো গণপরিসরে এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি পৃথক ও পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করা। এ প্রতিবেদনে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কিছু সুপারিশ উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্যে আছে ২০০৯ সালের হাইকোর্টের নির্দেশনাটি যাতে মানা হয় সেজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক-শিক্ষিকামন্ডলীদের মধ্যে যৌন হয়রানি সংক্রান্ত আইন, প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা এবং আদালতের নির্দেশনা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে একটি তদারকি ও পর্যবেক্ষণ কৌশল গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা। সুপারিশে আরো বলা হয়, সচেতনতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করা। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তদারকি কৌশল প্রণয়ন করা।

দেশে যৌন হয়রানি যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে দেশের নারীরা ঝুঁকিতে রয়েছেন। হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলে আমাদের দেশে যৌন হয়রানির মাত্রা কমে যেত বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিশিষ্টজনরা।

লেখক : কলেজশিক্ষক ও কলাম লেখক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close