সাধন সরকার
বিশ্লেষণ
যে দূষণ নিয়ে কেউ ভাবেন না
বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহরের তালিকায় বহু আগেই স্থান করে নিয়েছে রাজধানী ঢাকা। শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ এ শহরের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব দূষণ নিয়ে চলতে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে। পরিস্থিতি এমন যে, বিষয়টা গা সওয়া হয়ে গেছে! এসব দূষণের সঙ্গে আরো একটি দূষণের কথা বলা প্রয়োজন আর সেটি হলো ‘দৃশ্যদূষণ’। দৃশ্যদূষণ নিয়ে আগে হয়তো জোরোশোরে শোনা না গেলে বিষয়টি ধীরে ধীরে এখন সমস্যায় রূপ নিয়েছে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন দূষণ নিয়ন্ত্রণে এমনিতেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হিমশিম খাচ্ছে। তার ওপর আবার দৃশ্যদূষণের নতুন যন্ত্রণা।
চোখের সামনে আমরা যা দেখি সেটাই দৃশ্য বলে ধরে নেওয়া যায়! যা দেখে মস্তিষ্কে স্বস্তির উদ্রেক হয়, চোখের আরাম হয় তা দর্শনীয়ও বটে। আর যা দেশে চোখে অস্বস্তি লাগে, চোখের আরাম নষ্ট হয় তা দূষণীয় বলে ধরে নেওয়া যায়। ঢাকা শহরে চলার সময় রাস্তার চারপাশে দেখা যায় ব্যানার, পোস্টার, দেয়াল লিখন, ফেস্টুন, বিলবোর্ড, তারের জঞ্জাল আর ময়লা-আবর্জনা। বাসাবাড়ির দেয়াল, সরকারি প্রতিষ্ঠানের দেয়াল, বিদ্যুতের খুঁটি, ল্যাম্পপোস্ট, ঐতিহাসিক স্থাপনার দেয়াল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেয়াল, রাস্তার পাশে ব্যানার, পোস্টার আর দেয়াল লিখনে ছেঁয়ে গেছে চারপাশ। এমনকি গাছও রেহাই পাচ্ছে না। গাছেও পেরেক মেরে লাগানো হয়েছে বিলবোর্ড, প্ল্যাকার্ড। কোনো দেয়ালই বাদ যাচ্ছে না দৃশ্যদূষণের কবল থেকে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেয়ালগুলো ঝকঝকে তকতকে থাকলেও সেখানে সাঁটানো হয়েছে বিভিন্ন ধরনের পোস্টার। কোথাও লেখা কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন, কোথাও টানানো হারানো বিজ্ঞপ্তি, রুমমেট আবশ্যক, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকর্মীর নামে টানানো পোস্টার, দোয়া চেয়ে পোস্টার, শুভেচ্ছাবার্তা, চাকরির বিজ্ঞাপন, বাসা ভাড়া, শোক সংবাদসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যানার-পোস্টারের ছড়াছড়ি।
দেখা যায় যে, দেয়ালে পোস্টার লাগানোর ওপর সতর্কবার্তা দিয়েÑ ‘পোস্টার লাগানোর নিষেধ’ লেখা থাকলেও সেসবের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না, এমনকি সেখানেও পোস্টার লাগানো হচ্ছে। ঐতিহাসিক স্থান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেয়ালে পোস্টার লাগানো অনুচিত জেনেও সেখানেও পোস্টার সাঁটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পোস্টার, ব্যানার লাগানোর সময় ওই প্রতিষ্ঠানের বা জায়গার কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার কথা থাকলেও অনুমতি নেওয়া হচ্ছে না। এছাড়া যে উদ্দেশ্যে বা কাজে ব্যানার-পোস্টার দেয়ালে সাঁটানো হচ্ছে সে উদ্দেশ্য বা কাজ শেষ হয়ে গেলেও ওই ব্যানার-পোস্টার সরানো হচ্ছে না, মাসের পর মাস ওভাবেই পড়ে থাকে। এমনকি জায়গা না পেয়ে একটা পোস্টারের পর আর একটা পোস্টার লাগানো হচ্ছে। এখন রাতে পোস্টার-ব্যানার লাগানোর একটা রীতি হয়ে গেছে। হুট করে সবার চোখের আড়ালে যা ইচ্ছা দেয়ালে সাঁটানো হচ্ছে! বিলবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন অপসারণে সিটি করপোরেশন থেকে মাঝেমধ্যে অভিযান চালালেও তা নিয়মিত না হওয়ার কারণে ঢাকার সৌন্দর্য রক্ষা ও দৃশ্যদূষণ বন্ধ করার উদ্দেশ্য সফল হয় না!
ঢাকা শহরে চলার সময় মাথার ওপরে, চারপাশে তাকালে দেখা যায় তারের জঞ্জাল। বাদুরঝোলার মতো করে কুন্ডলী প্যাঁচানো তারের লাইন কোথায় গিয়ে যে শেষ হয়েছে কেউ জানে না! বিদ্যুতের তার, ডিশলাইনের তার, ইন্টারনেটের তার মিলিয়ে একাকার। একসময় এসব তারের জঞ্জাল মাটির নিচ দিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হলেও সে পরিকল্পনা আর বেশিদূর এগোয়নি। দুই সিটি করপোরেশনের সড়কগুলোতে এখানে-সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে ময়লা আবর্জনা, কাঁচাবাজারের উচ্ছিষ্ট। কোথাও রাস্তার ওপরেই রাখা হয়েছে ময়লার কন্টেইনার।
এক তথ্য মতে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন যে পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হয় তার প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ময়লা-আবর্জনা দুই সিটি করপোরেশন সংগ্রহ করে। বাকি ময়লা-আবর্জনা রাস্তা-ড্রেনেই পড়ে থাকে! উল্লেখ্য, কয়েক বছর আগে ঢাকা শহরটাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য কোটি টাকারও বেশি খরচ করে মিনি ডাস্টবিন (ময়লা রাখার পাত্র) বসানো হয়েছিল। নগরবাসীর সচেতনতার অভাবে সেই মিনি ডাস্টবিনই এখন ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছে! বেশির ভাগ ডাস্টবিন চুরি হয়ে গেছে। এখন কেউ এগুলো আর পরিষ্কার করে না। এছাড়া ব্যস্ত সড়কের কোনো কোনো স্থানে সুয়ারেজের পানি উপচে দুর্গন্ধ তৈরি করলেও তা যেন কারোরই যায় আসে না!
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের রাজধানী শহরটাকে যখন দেখি তখন বড় হিংসা হয়! আমাদের রাজধানী শহরটাকে তো অমন সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন হতে পারত। দৃশ্যদূষণের কারণে অনেক সৌন্দর্য দৃষ্টিসীমা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। শহরের সৌন্দর্য ও আদি সৌকর্য নষ্ট হচ্ছে। এক চিলতে জায়গাও যেন বাদ যাচ্ছে না দৃশ্যদূষণের কবল থেকে! ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি মানুষই দৃশ্যদূষণের শিকার! কোনটি দৃষ্টিনন্দন আর কোনটি দৃষ্টিকটু তা ভাবার সময় এসেছে। তাছাড়া সব ব্যানার-পোস্টার কি মানুষ পড়ে! এই বাজারে কাগজের এত দাম, এত এত পোস্টার-ব্যানার ছাপিয়ে লাভ কী ? এখন মানুষের চোখের দৃষ্টির আরামের কথা ভাবার সময় এসেছে। ভিন্নভাবে চিন্তা করলে, ৪০০ বছরের পুরোনো এই ঐতিহাসিক ঢাকা শহরটা বিশে^র অন্যান্য রাজধানী শহরের চেয়েও ভালো হতে পারত। তাই দৃশ্যদূষণ নিয়ে হেলাফেলা করার কিছুই নেই। এমনিতেই রাজধানীবাসী বিভিন্ন দূষণে জর্জরিত। নতুন করে আর কোনো দূষণকে স্থায়ী রূপ দিতে মোটেও আগ্রহী নয় রাজধানীবাসী। অন্যান্য দূষণের মতোই দৃশ্যদূষণও কম ক্ষতিকর নয়। প্রতœতত্ত্ব আইন অনুযায়ী, ঐতিহাসিক বা পুরাকীর্তি স্থাপনায় পোস্টার লাগানো দন্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু কে মানে কার কথা! এ ব্যাপারে সচেতনতা জরুরি। ঢাকা শহরের সৌন্দর্য রক্ষা করা সবার দায়িত্ব। দৃশ্যদূষণের কবল থেকে ঢাকাকে রক্ষা করতে হলে নতুন আইন প্রণয়নের কথা ভেবে দেখতে হবে। মূলকথা হলো, দৃশ্যদূষণ থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
"