মাহমুদুল হক আনসারী

  ০৫ মে, ২০১৯

ধর্ম

রমজানে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ

রমজান মাস মুসলমানদের ধর্মীয়ভাবে অন্য মাসের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অন্য ১১ মাসে যেসব ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ইবাদত-বন্দেগিতে অমনোযোগী হন তারাও এ রমজান মাসের বরকতময় ইবাদতে অংশগ্রহণের চেষ্টা করেন। ফলে রমজান মাসে সব বয়সের মুসল্লিদের মসজিদে আগমন বেশি থাকে। সবগুলো মসজিদ প্রায় মুসল্লিদের উপস্থিতিতে কানায় কানায় ভরপুর থাকে। প্রায় সুস্থ ও সবল প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীকে রোজা পালন করতে দেখা যায়। সারা পৃথিবীর মুসলমানদের সঙ্গে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা মাহে রমজান ও রোজাকে অভিবাদন ও স্বাগত জানাতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। রোজা, তারাবিহ নামাজ, সাহ্রি ও ইফতারের কারণে এ মাসে মুসল্লিদের ভোগ্যপণ্যের কিছুটা অতিরিক্ত চাহিদা বেশি থাকে। সে সুবাদে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় পণ্যের মজুদ গড়ে তোলেন। এটা এক ধরনের অনৈতিক ব্যবসা বলা যায়। পৃথিবীর মুসলিম অমুসলিম দেশে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা না গেলেও বাংলাদেশে এ প্রবণতা আমরা দেখে আসছি।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বলেই সাধারণভাবে মুসলমানরাই এখানে ব্যবসা-বাণিজ্যে এগিয়ে। তাদের নিয়ন্ত্রণেই বড় বড় ভোগ্যপণ্যের বাজার। সিন্ডিকেট ও বাজার উঠানামা তাদের ইশারায় হয়ে থাকে। এসব সিন্ডিকেটে ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণও দেখা যায়। রাজনৈতিক চত্রছায়া ছাড়া কখনো সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব না। তাই রাজনৈতিক দলের চত্রছায়ায় থেকে এসব অনৈতিক কর্মকান্ড চালাচ্ছে, যা এরই মধ্যে বিভিন্ন তথ্যে প্রমাণিত। এসব কর্মকান্ড অবশ্যই প্রশাসনকে থামাতে হবে। পৃথিবীর অন্য দেশে রমজান মাসে ভর্তুকি দিলেও বাংলাদেশে তার বিপরীত কর্মকান্ড জনগণ দেখে থাকে। বাংলাদেশে রাজনীতি থেকে শুরু করে ব্যবসা বাণিজ্য সামাজিক কর্মকান্ড সবকিছুর মধ্যেই ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থকে বিবেচনা করা হয়। ফলে ন্যায় ও অন্যায় রাষ্ট্রীয়ভাবে মূল্যায়নে কম আসে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ছোট বড় অপরাধ অথবা অপরাধীরা নিরাপদে থেকে যায়। অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে শনাক্ত না করে দলীয় বিবেচনার কারণে অপরাধ ও অপরাধী অনেকটা নিরাপদে থেকে যায়। ফলে অপরাধ প্রবণতা কমে যাওয়া তো দূরের কথা অপরাধী ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের পরিবর্তন লক্ষণীয়। যার কারণে অপরাধ ও অপরাধী সমাজে বহাল তবিয়তে বেঁচে যায়। সমাজে কী পরিমাণ অপরাধ ও অপরাধী, তার হিসাব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আছে। তবুও অপরাধীদের অপরাধ থামছে না, অথবা তাদের আইনের মধ্যে নিয়ে আসা হচ্ছে না। সঠিকভাবে যথাযথ আইনের মাধ্যমে সমাজে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা গেলে অবশ্যই অপরাধ প্রবণতা বহু অংশে কমে আসতো। কিন্তু সমাজের শান্তিপ্রিয় মানুষ তা দেখছে না। না দেখার কারণে নিত্যনৈমিত্তিক অপরাধ বিদ্যুৎ গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

অপরাধীর কাছে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, কোরআন আর গীতা কিছুতেই তফাৎ নেই। অপরাধী তার পরিচয় অপরাধকারী হিসেবে। তাকে রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে সেল্টার দেওয়া অথবা রক্ষা করা আইনের মধ্যে পড়ে না। আইনকে আইনের গতিতে না চালালে অপরাধ প্রবণতা কোনো অবস্থায় কমবে না। বরঞ্চ এসব অপরাধ আরো বৃদ্ধি পাবে। রমজান মাসে অন্যান্য মাসের তুলনায় অপরাধ প্রবণতা কম দেখা যায় না। নানাভাবে ছোট বড় চাঁদাবাজি, হাইজ্যাকার, প্রতারক ও মলমপার্টি দেখা যায়। সহজ সরল জনগণকে প্রতারণা আর ধোঁকায় ফেলে এসব অপরাধীচক্র সক্রিয় থাকে। তারাবিহ নামাজ, সাহ্রি ও ইফতারের সময় কিছু অপরাধ সংঘটিত হয়। ছোটখাটো চুরি, হাইজ্যাক পাড়ায় মহল্লায় হয়ে থাকে। মোবাইল চুরি থেকে ল্যাপটপ ও দোকান মার্কেটে চুরি ডাকাতি সংঘটিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর সাহসী প্রশংসার কথা আমরা জানি। এ বাহিনী অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে তাদের পক্ষে সম্ভব। এরপরও কেনো অপরাধীরা নানাভাবে ছোটবড় অপরাধ করে পার পেয়ে যায় সেখানেই অনেক প্রশ্ন থেকে যায়। রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে বলেই আমরা জানি। তবুও কেন অপরাধী বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও রমজান মাসে যেহেতু ঈদুল ফিতর মুসলমানদের বড় খুশির দিন সেহেতু একটু বাজার মার্কেটে যাতায়াত বেশি হয়ে থাকে। কী রাত, কী দিন যার যখন সময় সুযোগ হয়, অথবা অর্থকড়ি হাতে আসে তখনই বাজার মার্কেটে কেনাকাটায় নেমে পড়ে। সেখানেও আলাদাভাবে ভোগান্তির মধ্যে পড়তে দেখা যায় কেনাকাটাকারীদের। যুবক-যুবতী, ছাত্রছাত্রী দল বেধে মার্কেটে মার্কেটে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করে। প্রায় দেখা যায়, তারাবিহ নামাজের পর সাহ্রির আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অনেক মানুষ কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকেন। সেখানে কিছুটা তাদের যাতায়াত ও নিরাপত্তায় ভোগান্তি দেখা যায়। রাস্তায় নিয়োজিত কিছু কিছু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে অনেক সময় অহেতুক ঝামেলা করতে দেখা যায়। যেখানে নিরাপত্তা কর্মীদের জনগণকে অতিরিক্ত নিরাপত্তার বেষ্টনীতে রেখে সহযোগিতা করার কথা, সেখানে অহেতুকভাবে হয়রানি আর ভোগান্তি কোনো অবস্থায় গ্রহণযোগ্য নয়। যেহেতু রমজান মাসে মুসল্লিদের ইবাদত বন্দেগি আর পারিবারিক কেনাকাটার ঝামেলাটা বেশি থাকে, সেই সুযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জনগণের প্রতি সেবার মনোভাব থাকতে হবে বেশি। হয়রানি আর ভোগান্তির মাত্রা বেশি হলে এ বাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থা আর বিশ্বাস কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সে বিষয় বলার অপেক্ষা রাখে না।

রমজান মাসে রোজা পালনের সঙ্গে মুসল্লিদের পারিবারিক সামাজিক কর্তব্য বেড়ে যায়। সামর্থ্যবান মুসল্লিদের জাকাত প্রদান ও দান খয়রাতের বিষয় জড়িত। গরিব, দুস্থ মানুষকে এ মাসে সামর্থ্যবানরা সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। সেটা তাদের হক। এসব দান খয়রাত নিতে ও দিতে যেন কাউকে ভোগান্তিতে পড়তে না হয় সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা দরকার। দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় জাকাতের সামগ্রী নিতে গিয়ে অনেককে জীবন দিতে হয়েছে। এটা কোনো অবস্থায় গ্রহণযোগ্য নয়। যে বা যারা এসব দান খয়রাত করবেন, তাদের অবশ্যই তা শৃঙ্খলার মধ্যে করা দরকার। লোক দেখানো আর মানুষের জীবনকে ধ্বংস করে কোনো দান খয়রাত গ্রহণযোগ্য ইবাদত হতে পারে না। এসব কর্মকান্ড থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। রমজান মাসে যেসব সময়ে অপরাধ প্রবণতা বেশি সংঘটিত হয়, সেসব সময়ে বেশি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। অহেতুক ও অন্যায়ভাবে কোথাও যেন জনগণ ভোগান্তির শিকার না হয় সেসব দিকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে খেয়াল রাখতে হবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সব ক্ষমতার মালিক দেশের জনগণ। কোনো অবস্থায় জনগণকে অন্যায়ভাবে হয়রানি ও কষ্ট দেওয়া যাবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ দেশের রাষ্ট্র ও জনগণের সেবক, সে দায়িত্বের কথা মাথায় রেখে জনগণের কল্যাণে তারা কাজ করবেন, এটাই মানুষের চিরন্তন দাবি। রমজানে মুসল্লিদের পুণ্যময় ইবাদত বন্দেগি পালনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতার বিকল্প নেই।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

mh.hoqueansari@gmail

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close