মো. কায়ছার আলী

  ০৪ মে, ২০১৯

সিয়াম

তাক্ওয়া অর্জনের পথ

‘হে ইমানদারগণ। তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা তাক্ওয়া অর্জন করতে পার।’ (সুরা আল বাকারাহ্-১৮৩)। একই সুরায় ১৮৫নং আয়াতে বলা হয়েছে, পবিত্র রমজান মাসেই আল কোরআন নাজিল করা হয়েছে। শুধু পবিত্র আল কোরআনই নয়, এই রমজান মাসেই অন্যান্য আসমানি কিতাব ও সহিফা নাজিল করা হয়েছে। রমজান মাসের প্রথম অথবা তৃতীয় দিনে নাজিল হয়েছে হজরত ইব্রাহীম (আ.)-এর প্রতি তার সহিফা। হজরত দাউদ (আ.)-এর প্রতি জবুর কিতাব নাজিল হয় এ মাসেই। হজরত মুসা (আ.)-এর প্রতি তাওরাত কিতাব নাজিল হয় এ মাসের ৬ তারিখে এবং হজরত ঈসা (আ.) এর প্রতি ইঞ্জিল কিতাব নাজিল হয় ১২ কিংবা ১৩ রমজান। পবিত্র কোরআনের ওপরের আয়াতের সূত্র জানিয়ে দেয় সাওম বা রোজা পালনের ইতিহাস দীর্ঘ। মুসলমানরা রোজা রাখলে তাকে বলা হয় সিয়াম। খ্রিস্টানরা রোজা রাখলে তাকে বলে ফাস্টিং, হিন্দু বা বৌদ্ধরা রোজা রাখলে তাকে বলা হয় উপবাস। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে অর্থাৎ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মানুষ সব কিছুকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোজা রাখলে তাকে বলা হয় অটোফেজি। Autophagy শব্দটি গ্রিক শব্দ। Auto অর্থ নিজে নিজে এবং phagy অর্থ খাওয়া। সুতরাং Autophagy মানে নিজে নিজেকে খাওয়া। চিকিৎসাবিজ্ঞান নিজের গোশত নিজেকে খেতে বলে না। মানব শরীরের কোষগুলো বাহির থেকে কোনো খাবার না পেয়ে নিজেই যখন নিজের অসুস্থ কোষগুলো খেতে শুরু করে, তখন মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় তাকে Autophagy বলা হয়। পাঠকদের সুবিধার্থে আরেকটু সহজভাবে বলা যায়, আমাদের ঘরে যেমন ডাস্টবিন বা ময়লা-আবর্জনা ফেলার কে-নো ঝুড়ি থাকে আবার অন্যদিকে আমাদের কম্পিউটারগুলোতে রিসাইকেল বিন থাকে, তেমনি আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষের মাঝেও একটি করে ডাস্টবিন বা ঝুড়ি থাকে। সারা বছর শরীরের কোষগুলো খুব সুস্থ থাকার কারণে ডাস্টবিন পরিষ্কার করার সময় পায় না। ফলে কোষগুলোতে অনেক ময়লা ও আবর্জনা জমে যায়। শরীরের কোষগুলো যদি নিয়মিত তাদের ডাস্টবিন পরিষ্কার করতে না পারে, তা হলে কোষগুলো একসময় নিষ্ক্রিয় হয়ে শরীরের বিভিন্ন প্রকার রোগের উৎপন্ন করে। ডায়াবেটিস বা ক্যানসারের মতো অনেক বড় বড় রোগের জন্ম হয় এখান থেকে। মানুষ যখন খালি পেটে থাকে, তখন মানব শরীরের কোষগুলো অনেকটা বেকার হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা তো আর আমাদের মতো অলস হয়ে বসে থাকে না। তখন প্রতিটি কোষ তার ভেতরের ময়লা ও আবর্জনাগুলো পরিষ্কার করতে শুরু করে। আমাদের মতো কোষগুলোর আবর্জনা ফেলার জায়গা নেই বলে তারা নিজের আবর্জনা নিজেই খেয়ে ফেলে। বিস্তারিতভাবে মেডিকেল সায়েন্সের পদ্ধতিকেই বলা হয় Autophagy। খুব বেশি দিন হয়নি চিকিৎসাবিজ্ঞান Autophagyi সঙ্গে পরিচিত হয়েছে ২০১৬ সালে। এই Autophagy আবিষ্কারের জন্য জাপানের ডাক্তার ওশিনরি ওসুমি ২০১৬ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। এরপর থেকেই আধুনিক সব মানুষ রোজা রাখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। যারা প্রতিদিন স্বাস্থ্যের কথা ভেবে রোজা রাখতেন না, এখন তারাই সুস্বাস্থ্যের কথা ভেবে রোজা রাখতে চান। রোজার আসল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন। একই সঙ্গে আমাদের শরীর ও মনের জন্য এর অনেক উপকারিতা রয়েছে। উচ্চরক্তচাপের মাত্রা রোজা রাখার কারণে কমে আসে। নির্দিষ্ট সময়ে রোজা রাখার কারণে আমাদের শরীরের চর্বি Burn হয়। কিন্তু এই উপবাস যদি দীর্ঘ সময় ধরে করা হয়, তা হলে মাংসপেশির শর্করা ভেঙে যায়, যা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। রসুল (সা.) আমাদের সাহ্রি খেতে এবং ইফতারে দেরি না করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। নিয়মিত রোজা রাখলে হৃদরোগের ঝুঁকি ৫৮ শতাংশ কমে যায়। রোজা রাখার কারণে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল LDL ev Bad Cholesterol কমে সুগারের Metabolism-এর উন্নতি হয়। এটা ওজন বৃদ্ধি পাওয়া এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায় অর্থাৎ হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। রোজা রাখলে ৩০-৪০ শতাংশ কোলেস্টেরল বা HDL বৃদ্ধি পায় এবং TG কোলেস্টেরল শরীরের ওজন BMI কমে যায়। এক কথায় বলা যায়, রোজা হচ্ছে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর ওষুধবিহীন অন্যতম একটি মাধ্যম। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘রোজা রাখো ও সুস্থ থাকো।’ হজরত মুসা (আ.) ৪০ দিন রোজা পালন করে আল্লাহর ওহি পেয়েছিলেন। ইসা (আ.) ও তাই। তারা তাদের অনুসারীদের ওই ৪০ দিন রোজা রাখার নির্দেশ দেন। অন্য ধর্মাবলম্বীরাও তাদের নিজ নিজ ধর্মের সিয়াম সাধনা ওইসব রোজা বা উপবাসের সঙ্গে তুলনীয় নয়। পূর্ববর্তীদের রোজার নিয়ম ছিল এশার পর ঘুমিয়ে পড়লে পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার এবং কামাচার হারাম হয়ে যেত। ইসলামের শরিয়াহ সুবেহ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত সময় পর্যন্ত কিছু খাওয়া বা পান করা এবং যৌন তৃপ্তিকর কোনো কিছু করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সূর্যাস্তের পর থেকে সুবেহ সাদিকের আগ পর্যন্ত যেকোনো আহার-বিহারে সংযম সাধনা নষ্ট হয় না। রোজাদারের জন্য মিথ্যা, পরনিন্দা, পরের অকল্যাণ চিন্তা ও মন্দকর্ম শুধু নিষিদ্ধই নয়, অনৈতিকভাবেও এর চর্চা বা পরিচর্চা করলে প্রকৃত রোজা হবে না। বর্তমানে এক মাস রোজার পরও যদি কেউ সাওয়ালের রোজা, মহররমের রোজা, আরাফাতের দিনে রোজা, সপ্তাহে দুই দিন বা মাসে তিন দিন রোজা রাখেন; তা হলে তাদের স্বাস্থ্যের উপকারিতা অন্যদের চেয়ে বেশি হবে; যা রাসুল (সা.) করেছেন। রোজার মাসে সিয়াম সাধনার পর তারাবিহর নামাজসহ অন্য ইবাদাত বিশেষ করে জাকাত (সচ্ছল ব্যক্তিদের) ও ফিতরা প্রদান, লাইলাতুল কদর, ইতিকাফ পালনের মাধ্যমে মোমেন নিজেকে শুধু পরিশুদ্ধই করে না, দোয়া কবুলের সুযোগ গ্রহণ করে আখিরাতের নাজাতের পথ খুঁজে নেয়। সাওম, সিয়াম বা রোজার আসল উদ্দেশ্য মানুষের জাগতিক ও মনোদৈহিক উৎকর্ষ সাধন রোজাদারদের মনে আধ্যাত্মিক চৈতন্য জাগ্রত হয়। রোজার অনুশীলনে রোজাদারকে আত্মসংযমী, আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করে ধৈর্য ও সহানুভূতির অনুভূতি জাগায়। ফলে রোজা রিপুগুলোকে কামনা-বাসনার ঊর্ধ্বে উঠতে জাগায়। সর্বশেষ ও পরিপূর্ণ আসমানি কিতাব আল কোরআনে রোজার আবেদন অনেক বেশি তাৎপর্য বহন করে। মুসলমানের জীবনে সাওম, সিয়াম বা রোজা শুধু উপবাস নয়, রোজায় উপবাস আছে, কিন্তু উপবাসে রোজা বা সাওম নেই। ফলে উপবাসের সঙ্গে সাওম বা রোজার গুণগত তফাতটাও গৌণ নয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close