এস এম মুকুল

  ০৪ মে, ২০১৯

মুক্তমত

জঙ্গি নির্মূলে জাগ্রত থাকাটাই জরুরি

মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস সম্প্রতি বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে হামলার পরিকল্পনা করছে বলে সংবাদমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক প্রচারণায় জনমনে আশঙ্কা ও ভীতি কাজ করছে। ভীতি বা আতঙ্ক কাজ করাটাও খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কারণ বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বড় বড় বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। সেই বাংলাভাই থেকে শুরু করে ৬৪ জেলায় একযোগে হামলা এবং শেষে হলি আর্টিজানের ঘটনায় দেশবাসী শোকে, আতঙ্কে স্তব্ধ হয়েছে। বিশ্ব মিডিয়ায় তখন এ ঘটনার ব্যাপক প্রচারণা বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের অস্তিত্বের প্রমাণস্বরূপ উপস্থাপন করা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ সরকার জঙ্গিবাদ নির্মূলে কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করার ফলে নির্মূল না হলেও তাদের অবস্থা অনেকটাই দুর্বল হয়েছে বলা যেতে পারে। জঙ্গিরা অনেকটাই কোণঠাসা এবং অস্তিত্বের সংকটে রয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও আমরা মনে করি, এ আশ্বাস আমাদের আতঙ্ক কাটাতে যথেষ্ট নয়। কেননা, জঙ্গিবাদে যারা জড়িত তারা মনে করে, এটি তাদের একটি আদর্শিক লড়াই। যদিও ইসলাম ধর্মে মানুষের সঙ্গে এমন নির্মমতার কোনোই সুযোগ নেই। ইসলাম শান্তির ধর্ম। এই ধর্মের অনুসারীরা মানবজাতির ক্ষতি হয়Ñ এমন কিছু করতে পারে না। তবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূলে জিরো টলারেন্স ঘোষণা বিশ্বের প্রশংসা কুড়িয়েছে।

জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) সুন্নি ইসলামিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী আল কায়েদার একটি উপদল। যেটি আইএসআইএল, আইসিস এবং দায়েশ নামেও পরিচিত ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আক্রমণের পর এটির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এই জঙ্গিগোষ্ঠীটির লক্ষ্য হচ্ছে ইরাক, সিরিয়া এবং অন্যান্যা অঞ্চল নিয়ে একটি ইসলামিক স্টেট বা খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা। আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সক্রিয় রয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রুপ । বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অসংখ্য জঙ্গি হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস। সবচেয়ে ভয়াবহ আত্মঘাতী হামলাটি চালানো হয়েছে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে, যেখানে ২০০র বেশি মানুষ নিহত ও অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে। আইএসের নেতারা জঙ্গিগোষ্ঠীটির আদর্শে বিশ্বাসীদের এককভাবে বিভিন্ন স্থানে আঘাত হানতে উৎসাহ প্রদান করে। জঙ্গিগোষ্ঠীটির অর্থ আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে তেল ও গ্যাস। এটি এখনো সিরিয়ার তেল উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ দখলে রেখেছে। আর মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিমান হামলার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে জঙ্গিগোষ্ঠীর এই মূল্যবান সম্পদ। এ ছাড়া কর, মুক্তিপণ এবং লুট করা পুরাকীর্তি বিক্রি করেও অর্থ আয় করে এ জঙ্গিগোষ্ঠীটি। জানা যায়, এ জঙ্গিগোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছেন আবু বকর আল-বাগদাদি। বিশ্বের ১৮টি দেশে আইএস সক্রিয় রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশের সমন্বয়ে তৈরি মার্কিন নেতৃত্বাধীন একটি ‘কোয়ালিশন’ আইএস অধ্যুষিত এলাকায় বিমান হামলা চালাচ্ছে। এ কোয়ালিশনে কয়েকটি আরব দেশও রয়েছে। অন্যদিকে সিরিয়া সরকারের পক্ষে সেদেশে বিমান হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া। তবে ভূমিতে তাদের বিরুদ্ধে লড়ছে কুর্দিশ পেশমার্গার মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলো। ইরাক এবং সিরিয়ার কিছু অংশ এ গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং এটি সিরিয়ার রাকা শহরকে রাজধানী হিসেবে বিবেচনা করে। যদিও ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে এখন অবধি নিজেদের দখলে থেকে এক-চতুর্থাংশ এলাকা তাদের হাতছাড়া হয়েছে।

সম্প্রতি আইএস ঘনিষ্ঠ ‘টেলিগ্রাম’ নামের একটি মেসেজিং অ্যাপসে প্রকাশিত বাংলা ভাষায় লেখা একটি পোস্টারকে ঘিরে সেই আশঙ্কা আরো জোরালো হচ্ছে। পোস্টারটিতে বাংলায় লেখা রয়েছে, ‘শিগগিরই আসছি, ইনশাআল্লাহ...।’ টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে এরই মধ্যে জঙ্গিদের উপস্থিতি রয়েছে। স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠী জামা’আতুল মুজাহিদিনের (জেএমবি) সঙ্গে আইএসের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। জেএমবিকে তাদের দলে সদস্য নিয়োগের জন্য কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গে মাঝে মাঝেই তৎপর হতে দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা (এফবিআই) পশ্চিমবঙ্গের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে গ্রেফতার আইএস, জেএমবির সদস্য মোহাম্মদ মুসিরউদ্দিন একেএম মুসার বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে। মুসিরউদ্দিন গ্রেফতারের পর জানা যায়, জেএমবির নেতা আমজাদ শেখের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বাংলায় লেখা ওই পোস্টারে আল মুরসালাত নামে আইএসের একটি শাখা সংগঠনের লোগো আছে। শ্রীলঙ্কায় তওহিদ জামাত নামে একটি স্থানীয় সংগঠনের মাধ্যমে ভয়াবহ হামলার পর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পোস্টারটিকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। তবে টাইমস অব ইন্ডিয়া আইএসের বাংলায় লেখা পোস্টারটি তাদের প্রতিবেদনে প্রকাশ করেনি। তাদের প্রতিবেদনে শুধু বলা হয়, বাংলাদেশে আইএসের মজবুত ভিত্তি রয়েছে। দেশটিতে জামাতুল মুজাহিদিন (নব্য-জেএমবি) নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে আইএসের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। নব্য জেএমবিকে তাদের দলে সদস্য নিয়োগের জন্য কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গে মাঝে মাঝেই তৎপর হতে দেখা যায়। এমন পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এক সংবাদ সম্মেলনে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, সন্ত্রাসীরা হামলার পরিকল্পনা করছে। জঙ্গিবাদকে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এক বৈশি^ক সংকট হিসেবে অভিহিত করে শ্রীলঙ্কায় গত সপ্তাহের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর এ সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন তিনি।

অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর ২০১৮ সালে সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক একটি প্রতিবেদনে বলেছে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অনেক ব্যবস্থা নেওয়ার পরও বাংলাদেশে এখনো জঙ্গি হামলার ঝুঁকি রয়ে গেছে। দেশটির সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের মার্চ মাসে তিনটি সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয় বাংলাদেশ। এরপর থেকে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী অসংখ্য সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়েছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি এখনো অব্যাহত রয়েছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, যদিও এসব হামলার জন্য স্থানীয় জঙ্গিরা দায়ী বলে দেশটির সরকার বলছে, কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের আল কায়েদা এবং আইসিস অন্তত ৪০টি হামলার দায় স্বীকার করেছে। এমনকি আইসিস এবং একিউআইসের প্রকাশনা, ভিডিও ও ওয়েবসাইটে বাংলাদেশি জঙ্গিদের এসব কর্মকান্ড প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশে ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলায় দেশি-বিদেশি নাগরিকসহ ২২ জন নিহত হওয়ার পর জঙ্গিবিরোধী অভিযানে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ৩৮ জন নিহত হয়। আর পুলিশ দাবি করে, বাংলাদেশে জঙ্গিদের মেরুদন্ড ভেঙে গেছে। নতুন হামলা করার মতো শক্তি নেই তাদের। কিন্তু মধ্য মার্চ থেকে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জঙ্গিদের নতুন এক শক্তির মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আর এ পর্যায়ে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের মধ্যেই সিলেটে র‌্যাবের এক শীর্ষ কর্মকর্তাসহ সাতজন বোমা হামলায় নিহত হয়েছেন। তাই এখন নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আদৌ কি জঙ্গিরা দুর্বল হয়েছে? তাদের নেতৃত্ব কি দুর্বল হয়েছে? রিক্রুটমেন্ট কি বন্ধ হয়েছে?

বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। এটি সত্যি হলেই আমাদের জন্য স্বস্তির বিষয় হতো। তবে দেশের আমজনতার ধারণা, বাংলাদেশে আইএসের এজেন্ট কিংবা সদস্য যদিওবা না থাকে, তবে জঙ্গিবাদের আদর্শে বিশ্বাসী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব যে রয়েছে, তা কিন্তু কোনোভাবেই অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এ ছাড়া যেহেতু এটি একটি আদর্শিক বিষয়। তাই বাংলাদেশেও আইএসের অনুসারী বা এজেন্ট থাকতেই পারেÑ জনগণের এমন ধারণাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেননা, ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের এ যুগে অতি সহজে জঙ্গিরা আইএস কিংবা এ জাতীয় চরমপন্থি গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতেই পারে। আর এভাবেই আদর্শের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত হবে। আমরা এও মনে করি, দেশে জঙ্গিবাদের আদর্শিক গোষ্ঠীরা হয়তোবা চুপিসারে তাদের নেটওয়ার্ককে শক্তিশালী করছে। হয়তো তারা নীরব থেকে শক্তি সঞ্চয় এবং তাদের পরবর্তী আক্রমণের নকশা প্রণয়ন করছে। কাজেই দেশে জঙ্গি বা আইএস নেই, তা ভেবে আমরা যেন নিশ্চিত হয়ে না পড়ি। কারণ এরা কখন কী করে, কীভাবে করে, তা বুঝে ওঠা মুশকিল।

সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় জঙ্গি হামলার পরেই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে আইএসের হামলার বিষয়টি নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। যদিও আমাদের পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, বৈশ্বিক ঝুঁকির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ঝুঁকিতে থাকলেও হামলার কোনো আশঙ্কা নেই। কিন্তু বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে হামলার বিষয়ে আইএস হুশিয়ারি দেয় বলে ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান টাইমসের প্রতিবেদনে জানানো হয়। মনিরুল ইসলাম বলেছেন, নিউজিল্যান্ডে হামলার পর আমাদের দেশের জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে একটি প্রতিশোধপরায়ণ প্রবণতা জেগে উঠেছে। বিভিন্ন ইন্টেলিজেন্সির মাধ্যমে এমন তথ্য তিনি পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। তবে শ্রীলঙ্কায় হামলার ঘটনার পর থেকে নিঃসন্দেহে তারা ইন্সপায়ার হয়েছে। তবে হামলার জন্য সাংগঠনিক কাঠামো, মনোবল ও সরঞ্জাম তাদের নেই। এ বক্তব্যগুলো দেশে জঙ্গিবাদের অস্তিত্ব এবং তাদের সক্রিয়তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ধারণা দেয় এর সঙ্গে আইএসের লিঙ্ক থাকতেও পারে। তাই আমাদের উচিত হবে কোনোভাবেই যেন এরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। এদের সাংগঠনিক ভিত্তি যদি দুর্বল হয়েও থাকে, তা হলে তাদেরকে নির্মূল করার প্রশ্নে সদা জাগ্রত থাকতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close