রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৪ মে, ২০১৯

বিশ্লেষণ

নিরাপদ পানির টেকসই ব্যবস্থা

বাংলাদেশে বিশ্বের সর্বাধিক আর্সেনিক দূষণ আক্রান্ত মানুষের বসবাস। বিশুদ্ধ পানি সব ধরনের মানবাধিকারের ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃত। সবার জন্য উন্নত উৎসের পানি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। ৯৭ শতাংশের বেশি মানুষের উন্নত উৎসের পানি পাওয়ার সুযোগ আছে। তবে পুরোপুরি নিরাপদ পানি পানের সুযোগ এখনো সীমিত, মাত্র ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০০০ সালের তুলনায় ২০১২ সালে আর্সেনিকযুক্ত পানি পানকারীর হার ২৬ দশমিক ৬ থেকে কমে ১২ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। এরপরও বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আর্সেনিক দূষণ আক্রান্ত মানুষের বসবাস বাংলাদেশে। অগ্রগতি সত্ত্বেও ১ কোটি ৯৪ লাখ মানুষ এখনো সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে থাকা আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে। এ ছাড়া পানিতে ম্যাঙ্গানিজ, ক্লোরাইড ও লৌহ দূষণের কারণেও খাওয়ার পানির মান খারাপ থাকে। বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ পানির উৎসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের চেয়ে বেশি মাত্রায় ম্যাঙ্গানিজের উপস্থিতি পাওয়া যায়। মলের জীবাণু রয়েছে এমন উৎসের পানি পান করছে ৪১ শতাংশের বেশি মানুষ। এ ক্ষেত্রে স্বল্প শিক্ষিত নগরবাসী সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে বলে ২০১৩ সালের জরিপে বলা হয়েছে। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য পানি জীবনের একটি মৌলিক চাহিদা এবং অপরিহার্য অনুষঙ্গ। খাওয়, ব্যবহার, শস্য উৎপাদন, শিল্প-কারখানায় পণ্য উৎপাদন, নির্মাণকাজ, অগ্নিনির্বাপণসহ আমাদের জীবনে কোথায় নেই পানির ব্যবহার। আমাদের দেশের পানির উৎস দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে।

এমনকি শহর, উপশহর ও গ্রামের নদনদী, খালবিল, ডোবা, জলাশয়, পুকুর, দীঘি দখল-ভরাট, দূষণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেশের সবচেয়ে করুণ চিত্র হচ্ছে নদনদী ও খাল-উপখাল দখল, ভরাট, রাসায়নিক বর্জ্য, শিল্পবর্জ্য, মানববর্জ্য, বাজারের বর্জ্য, গৃহস্থালির ব্যবহার্য বর্জ্য, কৃষি বর্জ্য সরাসরি পানিতে ফেলে নদীর পানিকে দূষিত করা। মানুষের অতি লোভী, আগ্রাসী, দখলদারি মনোভাবের কারণে নদীর বালু উত্তোলন, নদী ভরাট, দখল, স্থাপনা নির্মাণের অবৈধ কর্মকান্ড। এসব দুর্বৃত্ত কোনো নিয়মনীতিকে তোয়াক্কাই করছে না। গেল বছরের আগাম বৃষ্টি ও বন্যায় চট্টগ্রামের হালদা নদীর পানিতে প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর অ্যামোনিয়ার পরিমাণ মানমাত্রার চেয়ে বেশি হওয়ায় রুই কাতাল মৃগেল জাতীয়সহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় অনেক মাছ মারা যায়। সবার জন্য পানির অধিকার নিশ্চিত করতে হবেÑ এই প্রধান প্রতিপাদ্য নিয়ে গত ২২ মার্চ ২০১৯ পালিত হয়েছে বিশ্ব পানি দিবস। বলা হয়ে থাকে পানির অপর নাম জীবন। আমাদের দেশে কেউ পকেটের পয়সা দিয়ে পানি কিনে খাবে, এটি কল্পনারও বাইরে ছিল। কি না এখন মানুষ পানি কিনে খাচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়ানোর জন্য। সুন্দর আর সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য। আসলেই আমরা জানি না আমাদের পানীয়টি কতটুকু সুপেয় এবং শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্য কতটুকুইবা নিরাপদ। কেননা, বিভিন্ন ভেজালবিরোধী অভিযানে পানীয়জলের মধ্যেও ভেজাল পাওয়া যাচ্ছে অহরহ; যা মানুষকে আতঙ্কিত ও শঙ্কিত করে তুলছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো ছাড়াও বিভিন্ন নামের ও ব্র্যান্ডের বিভিন্ন কোম্পানির অনেক ধরনের পানির বোতলে বাজার এখন সয়লাব।

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, বড় বড় জারের পানি কোনো রকম পরিশোধন বা বিশুদ্ধকরণ না করেই বিক্রি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এক তথ্য থেকে জানা যায়, বিভিন্ন রাসায়নিক অপরিশোধিত বর্জ্যরে কারণে বিভিন্ন নদীর পানিতে ক্রোমিয়াম, আয়রন ও জিংকের মতো ভারী ধাতু নদীর পানিতে পাওয়া যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এতে নদীর পানি স্বচ্ছতা হারাচ্ছে, ঘোলাটে আকার ধারণ করছে, পানির ঘনত্ব বেড়ে চলেছে, পলি জমছে, নদীর নাব্য হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে মাছ ও বিভিন্ন জলজপ্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে ধীরে ধীরে। পাশাপাশি দূষিত পানির কারণে ভারসাম্য হারাচ্ছে জলজ জীববৈচিত্র্য। এর কুপ্রভাব পড়ছে দেশের প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর। এক তথ্য থেকে জানা যায়, দেশের ২৯টি নদীর পানি বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে রয়েছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীও। পরিবেশ অধিদফতরের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, নভেম্বর থেকে এপ্রিল এই শুষ্ক মৌসুমে পানির দূষণ বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছায়। মৎস্য অধিদফতর ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ দেশের মাছের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ৯টি নদী নিয়ে আরেকটি সমীক্ষা করেছে। তাতে দেখা গেছে, মাছের এসব উৎস মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। এসব নদীর পানিতে মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতিকর মাত্রার ভারী ধাতু পাওয়া গেছে। এ ছাড়া গভীর নলকূপের পানির বিশুদ্ধতা নিয়ে আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছে। গভীর নলকূপের পানি কতটুকু বিশুদ্ধ, সেই হিসাব কারো কাছেই নেই বরং মানুষ তা নিরাপদ ভেবে অবাধে পান করছে। তাছাড়া ওয়াসা জানায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে পানিতে লবণ ও আয়রনের মাত্রা অতিরিক্ত হওয়ায় এ পর্যন্ত সেখানে গভীর নলকূপ বসানো সম্ভবপর হয়ে উঠেনি।

অত্যন্ত দুঃখ এবং বেদনাদায়ক ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদীও অবৈধ দখল, দূষণ, বালু উত্তোলন, মাছ শিকারসহ নাব্য হারিয়ে দিন দিন মরা নদীতে পর্যবসিত হচ্ছে। আরো একটি শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, কক্সবাজারের মাতামুহুরী, চট্টগ্রামের কর্ণফুলীসহ দেশের ১২টি নদী থেকে ইলিশের আবাসস্থল হারিয়ে গেছে। দেশ ও জাতির প্রয়োজনে পানির উৎসগুলো রক্ষা ও সংরক্ষণ করার পাশাপাশি দেশের মৎস্যসম্পদ রক্ষা, প্রজনন বৃদ্ধি করার জন্য ডোবা, জলাশয়, পুকুর, দিঘি ভরাট বন্ধ করা বিশেষভাবে জরুরি। তার জন্য দেশের প্রচলিত আইনের মাধ্যমে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়। নদীরক্ষা কমিশন, জেলা ও স্থানীয় প্রশাসনকে নদীর জীবন্ত সত্তা যেন দূষিত, বিঘিœত, বাধাগ্রস্ত না হয়; সে ব্যাপারে কঠোর ও কঠিন অবস্থানের পাশাপাশি সজাগ, সতর্ক, সচেতন ও নজরদারিতে থাকতে হবে। আমরা নিরাপদ খাবার পানি চাই। মাছ, জীবজন্তু, নদী, খাল-বিল থেকে নিরাপদ পানি পান করতে পারে, সে ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। দেশের বিভিন্ন খাতে পানির চাহিদা, প্রাপ্যতা ও জোগান নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অগ্নিনির্বাপণের জন্য চাহিদামতো পানি জোগানের বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। পানিকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে তা রক্ষা, সংরক্ষণ, দূষণরোধ করা, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য জলাধার নির্মাণের পাশাপাশি দেশের মৎস্যসম্পদকে রক্ষার জন্য সরকার, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসমূহ বিভিন্ন কার্যকর ব্যবস্থা জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করবে বলে দেশবাসীর প্রত্যাশা। নদীমাতৃক বাংলাদেশ থেকে নদী হারিয়ে যাবে বা ভরাট হয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাবে, তা যে আমাদের কল্পনারও অতীত।

উল্লেখ্য, নদী দখল-দূষণ, ভরাট বন্ধের জন্য নদী ও নদীর তীর দখলকারীদের চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী যদিও কৌশলগত কারণে আপাতত দ্বিতীয় ধাপের উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ রয়েছে এবং ঢাকার বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদের অবৈধ স্থাপনা ও দখলদার উচ্ছেদের মতো বিনা বাধায়, নির্ভয়ে-নির্বিঘেœ দেশের সব নদ-নদীর উচ্ছেদ কার্যক্রম অতি শিগগিরই শুরু করা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে অতীব জরুরি হয়ে উঠছে। যেহেতু হাইকোর্ট ডিভিশন নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করেছে; সেহেতু সরকারের আইনগতভাবে এই উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করতে কোনো বাধা নেই। তাছাড়া সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার দুঃসাহসিকতা কারোরই নেই বলে আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস। শুধু দরকার সরকারের আইনের প্রয়োগ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা; যা ইতোমধ্যেই দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে কর্ণফুলী, বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রমে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর পাশাপাশি হালদা নদীকে মা মাছের অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অচিরেই অবৈধ উচ্ছেদ কার্যক্রমের নির্দেশ দেওয়া উচিত। দেশের মাছের চাহিদা পূরণ করে যেন মাছ রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়; সেজন্য নদীর অবৈধ উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা, নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনা এবং নদীর পানি দূষণের জন্য দায়ী সব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকরী উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। পাশাপাশি শিল্প, কল-কারখানা থেকে যদি ইটিপির মাধ্যমে পরিশোধিত না করে দূষিত পানি নদীতে ফেলে তা হলে সেসব শিল্প, কল-কারখানা আইন করে বন্ধ করে দিতে হবে দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে।

ভুলে গেলে চলবে না, পানিই জীবন পানিই মরণ। নিরাপদ পানি নিশ্চিতের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার লক্ষ্যে আর্সেনিকমুক্ত ইউনিয়ন ও উপজেলাকে উদাহরণ হিসেবে সামনে এনে এ ক্ষেত্রে সমন্বিত মডেল তুলে ধরেছে ইউনিসেফ। কমিউনিটিভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা প্রণয়ন, কার্যক্রম পরিচালনা এবং সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণে নারীর অংশগ্রহণ কীভাবে টেকসই ও ফলপ্রসূ করা দরকার, তা ইউনিসেফের কর্মসূচিতে তুলে ধরা হয়। টেকসই ও যেকোনো সংকট সামাল দেওয়ার মতো ক্ষমতাসম্পন্ন সেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কমিউনিটি সদস্যদের তথ্য, সহায়তা ও সম্পদের জোগান দেওয়া হয়। ইউনিসেফ মনে করে, কমিউনিটির সদস্যদের সম্পৃক্ত করা ও ক্ষমতায়ন এবং তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি বিশেষত নারী, শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সেবা টেকসই করতে সহায়ক হবে। নাগরিক সমাজের নানা সংগঠনকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে মিলে কাজ করে ইউনিসেফ। বিভিন্ন সেবায় কমিউনিটির সদস্যদের সম্পৃক্ত করা, তাদের মধ্যে এসবকে নিজেদের মনে করার উপলব্ধি এনে দেওয়া, সামাজিক পরিবর্তন এবং পলিসি পরিবর্তনে তারা যেন সোচ্চার হন, সে লক্ষ্যে এটা করা হয়।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close