আবু আফজাল সালেহ

  ০৩ মে, ২০১৯

মুক্তমত

নারী নির্যাতন সমাধানে সম্ভাব্য করণীয়

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, প্রতি মাসে গড়ে ৫৫ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়ে থাকে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত শিশু ধর্ষিত হয়েছে ১৭৬টি। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ৫৫টি করে এবং মার্চে ৬৬ শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। সুতরাং মাসে গড়ে ৫৫টির বেশি শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। আর কেউ কেউ তো ধর্ষণের শিকার হয়েই মুক্তি পায় না, মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয় তাকে। এ কথাই শেষ কথা নয়, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৫ জনকে। শঙ্কিত হওয়ার বিষয় যে, এই পরিসংখ্যান অতীতের যেকোনো রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।

দেশের কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করব এবং নির্যাতনের স্বরূপ/পর্যায় জানার চেষ্টা করি। নির্যাতনে কারা কারা জড়িত বা সহযোগী, তা জানার ভালো পদ্ধতি হতে পারে এটা। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করা অহরহই ঘটছে। পত্রিকায় আসে কম। পরে প্রকাশ হওয়ার ভয়ে খুন। এ ঘটনাও কম নয়। ক্ষেত্রমতে, প্রশাসনের সহযোগিতা পাওয়া যায় কম বা বিভিন্ন কারণে দীর্ঘসূত্রতা আসে। সাভারে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে এক তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। এ ঘটনায় সাভার মডেল থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করার পরও পুলিশ ধর্ষকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ ছিল। অপমানে ঘরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ফঁসি নিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল ভুক্তভোগী ওই তরুণী। পরের ঘটনা অজানা। এ রকম অভিযোগ এখন অনেকই আসে। যারা সমাজে প্রভাব বিস্তার করে তারাও নির্যাতন করে থাকে অনেক সময়। চট্টগ্রামের পটিয়ায় বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী এক কিশোরীকে (১৭) ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে মামলা করেছিলেন। মামলা তুলে না নেওয়ায় তাদের একঘরে করে রাখা হয়েছিল। কুমিল্লায় প্রতিবন্ধী ১৫ বছরের কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনার বিচার চাওয়ায় এবং মামলা করায় মেয়েটির ভাইকে এক বখাটে কুপিয়ে জখম করেছিল। আমরা নুসরাতের ক্ষেত্রেও এটাই দেখি। বিবেকের লজ্জা খেয়ে নির্যাতনকারী সিরাজের পক্ষে মানববন্ধনও করি। কী অদ্ভুত আমরা! নুসরাতের মতো গায়ে আগুন ধরানোর সংখ্যাও কিন্তু সমাজে কম হয় না! সিলেট কানাইঘাট উপজেলায় চাচাতো ভাইসহ কয়েকজন ১২ বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণ করে। শিশুটির বাবা এর বিচার চাইতে এক লন্ডন প্রবাসীর কাছে গেলে তিনিও শিশুটিকে ধর্ষণ করেন। বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তো নিরাপত্তাই নেই। নির্যাতনের কথা বললে টিসি দিয়ে দেন অনেক শিক্ষক-ব্যবস্থাপনা কমিটি! ধর্ষণের বিচার চেয়ে মামলা করায় রংপুরের মিঠাপুকুরে এক ছাত্রীকে বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ধর্মীয় নেতারাও পিছিয়ে নেই। শিক্ষকদের একটা অংশ জড়িত অনৈতিক কাজে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার শর্তে ছাত্রীনির্যাতন করে থাকেন। চাকরিজীবী-প্রশাসনের অনেকেও নারী নির্যাতনে জড়িত। পত্রিকায় সংবাদ আসে মাঝেমধ্যে। বাদ নেই মসজিদ-মন্দির বা অন্যধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের গুরুজনের একাংশ। প্রকাশের সংখ্যা কম। বাস্তবে নির্যাতনের হার অনেক বেশি। মূল্যবোধ কতটা অবক্ষয় হলে এমন ঘটনাগুলো ঘটে, ভেবে দেখেন কি!

ঘটনা প্রতিদিনের। কিন্তু সমাধান হয় না! বলছি নারী নির্যাতন বিষয়ে, ধর্ষণ ও ধর্ষণ শেষে খুন নিয়ে বা বলা যেতে পারে নারীর প্রতি সহিংসতা বা মানসিক নির্যাতন নিয়ে! সবচেয়ে বড় সমাধান হচ্ছে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে। মানুষ হিসেবে আমরা লজ্জাতে মাথা লুকাবার স্পেস পাওয়ার কথা নই। তাই এখনই আমাদের নেতিবাচক মনোভাব ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন দরকার। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা পরাবে কে! আমরা যারা প্রভাব বিস্তার করতে পারি তাদের বেশির ভাগের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। আমরা মুখে বলি এক আর মনে ধারণ করি অন্যটা। আর বাস্তবায়ন করি তৃতীয়টা। আমাদের না আছে ধর্মে বিশ্বাস বা অন্যপক্ষের মানবতায় বিশ্বাস! অন্ধবিশ্বাসের মোহে আছি! তাই বলি, নারী নির্যাতন বা নিগ্রহের প্রধান সমাধান হচ্ছে পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন। এরপরও কিছু অপরাধ থাকবে। আমরা যদি আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে পারি এবং তা সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে, তা হলে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা কমে যাবে।

‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০’ আইন অনুসারে বর্ণিত অপরাধ সংঘটনে ওয়াকিবহাল ব্যক্তির জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা হয়। যা ওই অপরাধ তদন্ত ও বিচারের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষ লোকের কাছে ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়। এতে অনেক ভিকটিম ইতস্ততবোধ করেন। এ কারণে অনেকে লজ্জায় আইনগত সহায়তা নিতে চান না! সম্প্রতি যৌন নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের রক্ষায় এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। সার্কুলার জারি করে সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার নারী-শিশুর জবানবন্দি নেওয়ার দায়িত্ব নারী ম্যাজিস্ট্রেটকে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতির আদেশে সারা দেশের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রতি এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, সুপ্রিম কোর্টের ‘স্পেশাল কমিটি ফর জুডিশিয়াল রিফর্মস’র গোচরীভূত হয়েছে, বর্তমানে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া নারী বা শিশুদের জবানবন্দি পুরুষ ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। এতে নারী-শিশু ভিকটিম ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের বর্ণনা দিতে সংকোচবোধ করেন। সেজন্য তারা ঘটনার প্রকৃত বিবরণ দিতে অনেক সময় ইতস্ততবোধ করেন।’ সুপ্রিম কোর্টের মতো আমরাও মনে করি, নতুন এই নির্দেশনার ফলে যৌন নির্যাতনের শিকার নারী-শিশু সহজে ও নিঃসংকোচে নির্যাতনের বর্ণনা দিতে পারবেন। দেশে নারী-শিশুদের প্রতি যৌন নির্যাতনের যে মহামারি চলছে, তার পেছনে অন্যতম কারণ হলো অপরাধ করেও আইনের ফাঁক গলে অপরাধীদের পার পেয়ে যাওয়া। সে হিসাবে এ সিদ্ধান্ত খুবই সুচিন্তিত ও সময়োপযোগী।

আমরা মনে করি, সার্বিকভাবে নারী-শিশুর বিরুদ্ধে যে যৌন নির্যাতন; তা অনেকাংশেই বন্ধ করা সম্ভব আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে। আইন অনুযায়ী ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে, বিশেষ ক্ষেত্রে কারণ দেখিয়ে কিছুটা সময় নিতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, মামলা শেষ হতে কখনো কখনো ১০ বছর ২০ বছরও লেগে যায়। কোনো কোনো মামলার পরিণতিই জানা যায় না। যৌন হয়রানি প্রতিরোধে হাইকোর্ট একাধিক নির্দেশনা দিয়েছেন। ২০০৯ সালে এক রায়ে যৌন হয়রানি নিয়ে সংজ্ঞাও নির্ধারণ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। সংজ্ঞা অনুযায়ী, অনাকাক্সিক্ষত যৌন আবেদনমূলক আচরণ (সরাসরি বা ইঙ্গিতে), যেমন : শারীরিক স্পর্শ বা এ ধরনের প্রচেষ্টা, প্রাতিষ্ঠানিক ও পেশাগত ক্ষমতা ব্যবহার করে কারো সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা, যৌন হয়রানি বা নিপীড়নমূলক উক্তি এবং যৌন সুযোগ লাভের জন্য অবৈধ আবেদন যৌন হয়রানির সংজ্ঞার মধ্যে পড়বে। পর্নোগ্রাফি দেখানো, যৌন আবেদনমূলক মন্তব্য বা ভঙ্গি, অশালীন ভঙ্গি, যৌন নির্যাতনমূলক ভাষা বা মন্তব্যের মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করা, কাউকে অনুসরণ করা বা পেছন পেছন যাওয়া এবং যৌন ইঙ্গিতমূলক ভাষা ব্যবহার করে ঠাট্টা বা উপহাস করা হলেও তা এ সংজ্ঞায় পড়বে। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলে যৌন হয়রানির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন না হলে এ লাগাম টেনে রাখা দায় হয়ে যাবে। এর থেকে সুরাহার জন্য পারিবারিক মূল্যবোধ ও প্রকৃত শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।

একটি জাতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বোঝা যায় কয়েকটি লক্ষণ দেখে! শিশু/নারী নির্যাতন ও খুনের ঘটনা দিয়েই সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রেও দেখা যায়, এ দুটো গর্হিত কাজের কারণে অনেক পরাক্রমশালী দেশ-জাতি অবশেষে পরাজয় বরণ করেছে। বলা হয়, এ দুটো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটালে সে সম্প্রদায়ের ওপর সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ চলে আসে! আমাদের কিন্তু এ দুটো লক্ষণ বেড়েই চলেছে! আল্লাহই ভালো জানেন আমাদের কপালে কী লেখা আছে! আমরা চাই না আমাদের ওপর ধ্বংস নেমে আসুক! এ অবক্ষয় থেকে পরিত্রাণ পেতেই হবে। সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে সমাজের অবক্ষয় রুখতে। বিশেষ করে তরুণ সমাজকে।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close