সাধন সরকার

  ০১ মে, ২০১৯

আলোচনা

জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবিলায় বিশ্ব

জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি এক সম্মেলনে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছে বিশ^।’ বাস্তবতাও সে কথা বলছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব আজ বিশ^জুড়ে দৃশ্যমান। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর মানুষ ১০ ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে। তথ্যমতে, গত ১ দশকে বরফ গলার হার ৪ গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর স্থলভাগ। ফলে জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে যেসব উপকূলীয় দেশ অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে, সেসব দেশের প্রথম সারিতে রয়েছে বিশে^র বৃহত্তম বদ্বীপ বাংলাদেশ। সম্প্রতি গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০১৯ সালে ‘বৈশি^ক জলবায়ুঝুঁঁকি সূচকে’ বাংলাদেশের অবস্থান নবম। গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ৭ নম্বরে। এ সময়ে এ দেশে প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিটি দেশ কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উপকূলীয় দ্বীপরাষ্ট্রগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এর জন্য দায়ী উন্নত দেশসমূহের মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নির্গমন।

সম্প্রতি ‘জাতিসংঘ শিশু তহবিল’ (ইউনিসেফ) কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়, বন্যাসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি শিশু। দেশের দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় বসবাস করা এসব শিশুর জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এটা এখন এক দৃশ্যমান বাস্তবতা যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ঘরবাড়ি হারানো পরিবারগুলোর শিশুরা অর্থ উপার্জনের জন্য যেকোনো কাজে যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছে! এতে করে শিশুরা নানাবিধ শোষণ ও নির্যাতনের ঝুঁকিতে পড়ছে। দায়িত্ব নিতে না পেরে অনেক পরিবার মেয়ে শিশুদের দ্রুত বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে বহু পরিবার সর্বস্ব হারিয়ে একপর্যায়ে কাজের খোঁজে শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। এতে করে এসব পরিবারের শিশুরা পাচার হওয়াসহ যৌন হয়রানির ঝুঁকিতে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকার শিশু ও নারীদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার কারণে গর্ভবতী নারী ও শিশুরা অতিমাত্রায় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

ইউনিসেফের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ঝুঁকির মধ্যে থাকা প্রায় দুই কোটি শিশুর মধ্যে নদীভাঙন এলাকাগুলোয় বাস করছে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ শিশু। এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে রয়েছে ৪৫ লাখ শিশু আর খরার ঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় ৩০ লাখ শিশু। এসব শিশুর পরিবার বিভিন্ন কারণে শহরমুখী হওয়াসহ পরিবারের শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শ্রম দিতে বাধ্য হচ্ছে। মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে প্রকৃতির স্বাভাবিক বদলে যাওয়ার ধরনও বদলে গেছে। অনেক আগে থেকেই প্রকৃতির আকস্মিক পরিবর্তনের ঝুঁকিতে পড়েছে বিশ^। শিল্পবিপ্লব পরবর্তী যুগে উন্নত দেশগুলোর মাত্রাতিরিক্ত জীবাশ্ম জ¦ালানির কারণে বৈশি^ক উষ্ণতার মাত্রা বেড়ে গেছে বহুগুণ। বৈশি^ক উষ্ণায়নের প্রভাবে ঋতুচক্র বদলে গেছে। হিমবাহের বরফ গলছে, সমুদ্র উত্তপ্ত হচ্ছে, বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। দুর্যোগে উপকূলীয় এলাকায় বসবাসরত মানুষের জীবনব্যবস্থা ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষিব্যবস্থা, স্থানচ্যুত হয়ে মানুষ অভিবাসী বা শরণার্থীতে রূপান্তরিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে ভুগতে ভুগতে অনেক পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে। এসব পরিবার তাদের ও তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ২০১৫ সালের ফ্রান্সের প্যারিসে জলবায়ু সম্মেলনে বিশে^র গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি শিল্পযুগের আগের তুলনায় দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। বিজ্ঞানীরা এটাও সতর্ক করে দিয়েছেন যে, এ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে প্রকৃতি আরো প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠবে। ঝড়ঝঞ্ঝা, খরা, বন্যা, অগ্নিকান্ডসহ বিভিন্ন ধরনের আকস্মিক দুর্যোগ আরো বেড়ে যাবে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও সুপেয় পানির সংকট।

জাতিসংঘের বিশ^ আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) তথ্যমতে, চলতি শতকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে! তা হলে কি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটু একটু করে হেরে যাবে বিশ^? জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে লন্ডনসহ বিশে^র ৩৩টি দেশের মোট ৮০টি গুরুত্বপূর্ণ শহরে থেমে থেমে আন্দোলন চলছে। আন্দোলনরত মানুষ ও সংগঠনের মূল দাবি, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে বিভিন্ন দেশ বা কর্তৃপক্ষ প্রকৃত সত্যটা বলছে না এবং তাদের দাবি কার্বন নির্গমনের হার শূন্যে নামিয়ে আনা হোক। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার ফলে সমালোচনা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এ কারণে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি যে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে, সে কথা এখনো বলা যাবে না; এ কথা যেমন ঠিক এটাও ঠিক যে, যুক্তরাষ্ট্র না থাকার কারণে সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমন করা উন্নত দেশগুলোকে এক কাতারে নিয়ে এসে জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবিলায় নেতৃত্ব দেওয়া নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। যাহোক প্রতিটি দেশকে নিজস্ব কৌশল অবলম্বন করে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় কাজ করে যেতে হবে। উন্নত দেশসমূহের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পেতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহকে এক কাতারে এসে আরো বেশি চাপ তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া উন্নত দেশসমূহকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কার্বন নির্গমনের কমানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। নবায়নযোগ্য জ¦ালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। দেশে দেশে জলবায়ু দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উন্নয়ন টেকসই হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (এসডিজি) অর্জন ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। প্রত্যেক শিশুর টেকসই ও উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে এবং বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে উন্নত দেশসহ বিশে^র প্রতিটি দেশকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একযোগে কাজ করতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close