ইয়াসমীন রীমা

  ০১ মে, ২০১৯

বিশ্লেষণ

স্বীকৃতিহীন শ্রম ও নারী

মে মাসের প্রথম দিন ‘মে দিবস’। বঞ্চিত, লাঞ্ছিত এবং অধিকারহারা শ্রমজীবী জনগণের অধিকার ও দাবি আদায়ের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে মে মাসের প্রথম দিনটি সারা বিশ্বে সব দেশের শ্রমিকরা পালন করে আসছেন। ধর্ম-বর্ণ ও দলমত নির্বিশেষে সারা বিশ্বে শ্রমিকরা শহর-বন্দর, শিল্প এলাকার কোনো একটি স্থানে শ্রমিকের লাল পতাকা নিয়ে একত্র হন এবং সভা, সমাবেশ, মিছিলসহ দাবি আদায়ের জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠান করেন। এই দিনটিতে শ্রমিকরা কেবল নিজ দেশেই নয়, বিশ্বের সব দেশের শ্রমিকদের প্রতি সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব ও সংহতি প্রকাশ করেন। মিছিল, সভা, সমাবেশ ব্যানার-ফেস্টুনে কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয় ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। শ্রমিকশ্রেণির কাছে মহান মে দিবসটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে পালিত হলেও এই দিবসে পৃথিবীর নিপীড়িত শ্রমিকরা নব নব সংগ্রামের শপথ গ্রহণ করেন।

গ্রিক শব্দ Maius থেকে ‘মে’র উৎপত্তি। শব্দটি দেবী Maius -এর সঙ্গে সম্পর্কিত। দেবী মেইয়াকে গ্রিকরা প্রাচুর্য ও প্রবৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে মানত। মানার কারণ ছিল মে মাস হচ্ছে গ্রিকদের ফসলের মওসুম। এ ফসলের ওপর তাদের জীবিকা নির্ভরশীল ছিল। তাই গ্রিকরা মের আগমনে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের বিশ্বাসে দেবী মেইয়াকে অভিবাদন জানাত পুষ্পমঞ্জুরি প্রদান করে।

কাকাডাকা ভেরে ঢাকাবাসীর চোখে পড়ে এক চিরচেনা দৃশ্য। দলে দলে তরুণী ও কিশোরী মেয়ে হেঁটে চলেছে দ্রুত পদক্ষেপে। অনেকেরই হাতে টিফিন বক্স বা ব্যাগ। এরাই গার্মেন্ট কারখানার শ্রমিক। শত বঞ্চনা, ক্ষোভ, সমস্যা ও অপ্রাপ্তির মধ্যেও তারা সচল রেখেছেন আমাদের বস্ত্রশিল্পের চাকা। নগর গবেষণা কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে উল্লেখ, গার্মেন্টের শ্রমিকদের শতকরা ৮৫ জন অপুষ্টিতে ভোগেন। তাদের অধিকাংশই চোখের কোণে কালো দাগ পড়ে গেছে। শরীরে নেই স্বাভাবিক জৌলুস। পাতলা-টিনটিনে দেহখানি যেন রুগ্ণ জীবন্ত লাশস্বরূপ। তারা যখন রাস্তা ধরে চলে, তখন তাদের চোখে-মুখে থাকে না হাসি আনন্দের ছিটেফোঁটা। বরং বিষণœ মুখমন্ডল নিয়ে সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ কোনো জীবন সংগ্রামীর প্রতিচ্ছবিই যেন রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে সারি সারি। গার্মেন্টের বেতন-ভাতার ব্যাপারে মালিক পক্ষে মোটামুটি ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও পরিবেশগত পরিবর্তন এসেছে খুব কম গার্মেন্টে। যেমন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত শ্রমিকদের খাটানো হয়। বেশির ভাগ গার্মেন্টে ওভারটাইম কাজ করানো হয়। কিন্তু ওভারটাইম সরকার নির্ধারিত পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না। গার্মেন্টে কর্মরত একটু উচ্চপদস্থরা নানা গালি দেয় হেলপার, কোয়ালিটি কন্ট্রোলা, অপারেটরসহ প্রায় সব পদের শ্রমিককে। গার্মেন্টে কর্মরত অধিকাংশ মেয়ের ওপর বহুমাত্রিক পাশবিকতা চালানো হয়। এমনিভাবে এখনো চলছে গার্মেন্ট শ্রমিকদের অসহায়ত্বের জীবিকা। এ প্রসঙ্গে কর্মজীবী নারী সমিতির সভানেত্রী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে গার্মেন্ট শ্রমিকদের ওপর যে নির্যাতন ও বঞ্চনা চলছে, তারই পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘটা গার্মেন্ট বিক্ষোভ। আসলে গার্মেন্ট শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি না মানলে এ ধরনের অনাক্সিক্ষত ঘটনা সামাল দেওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়, সেজন্য শ্রমিকদের দাবি পূরণের ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, এটা ঠিক যে একটা মহল এ আন্দোলনের সুযোগে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে। আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। শ্রমিকদের এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। গার্মেন্ট সেক্টরে আমাদের দেশের আইন, আইএলও বিধি ও মানবাধিকার বাস্তবায়ন করতে হবে অবিলম্বে।

জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বলেন, গত তিনটি রাজনৈতিক সরকারের ক্ষমতাসীন অবস্থায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো হয়নি। ২০০৭ সালের ২৯ মের মধ্যে ন্যূনতম মজুরি ৩ হাজার টাকা প্রদানসহ ১১২ দফা বাস্তবায়নের জন্য সরকার বিজিএমইএ ও বিকেএমইকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছিল। কিন্তু দাবি মোতাবেক বেতন বাড়ানো হয়নি। যে কারণে শ্রমিকরা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক লীগের সভাপতি সেলিম রেজা জানান, বর্তমান বাজারে মোটা চালের কেজি ৪২ টাকা ডালের কেজি ১১০ টাকা। একটি সংসারে প্রতিদিন ২ কেজি চাল লাগলেও ১৫০০ টাকা দরকার। ঢাকার কোনো বস্তিতে থাকলেও ঘরভাড়া দিতে হয় মাসে অন্তত দেড় হাজার টাকা। সব মিলে কমপক্ষে সাড়ে ৩ হাজার টাকা না হলে ডাল-ভাতের সংসারও চলে না। বর্তমানে বাংলাদেশে গার্মেন্টের সংখ্যা ৪ হাজার ৩০০। এসব গার্মেন্টে শ্রমিকের সংখ্যা ২২ লাখ। এর মধ্যে শুধু হেলপার পদে কর্মরত রয়েছেন ১০ লাখ শ্রমিক। তাছাড়া অন্যান্য পদের মধ্যে সহকারী প্রডাকশন ম্যানেজার ও অপারেটর, সুপারভাইজার, লাইনচিফ পদে কর্মরত শ্রমিকরা কেউই ভালো বেতন পান না। এ ছাড়াও ঠিকমতো বেতন-ভাতা না দেওয়া, বকেয়া বেতন দিতে গড়িমসি করা, ওভারটাইম কেটে রাখা, সোয়েটার ফ্যাক্টরিগুলোতে পিস রেট কম দেওয়া, উৎসব-ভাতা না দেওয়ার মতো বিষয়গুলো গার্মেন্ট মালিকদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ গার্মেন্টশিল্প কোটামুক্ত বিশ্ববাজারে প্রবেশ করলে এ শিল্পে ধস নামার সম্ভাবনা থাকলেও তা হয়নি। বরং কোটামুক্ত বাজারে বাংলাদেশে ৪০০ গার্মেন্ট বেড়েছে। অথচ বাড়েনি গার্মেন্ট শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বা বেতন-ভাতা। যদিও সাম্প্রতিক বিশ্বমন্দার একটা ধাক্কা লেগেছে, কিন্তু এর আগে তো হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন গার্মেন্ট মালিকরা।

সারা দেশে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি এবং পানি ও বিদ্যুৎ সংকট তাতে মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে যাচ্ছে। শ্রমিকদের অবস্থা আরো শোচনীয়। তারা বলছেন, ১৯৯৪ সালের ৯৪০ টাকা বেতন কাঠামো নিয়ে তাদের দীর্ঘ সময় ধরে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়। ইপিজেডগুলোর মধ্যে শ্রমবিধি মানা হয় না। শ্রমিকদের ব্যাপারে মালিক পক্ষের তেমন ইতিবাচক পদক্ষেপ নেই বলে জানিয়েছেন শ্রমিকরা। বর্তমান সরকারে কাছে শ্রমিকদের দাবি, মালিক-শ্রমিক ও শ্রমিক নেতাদের ডেকে আলোচনায় বসে আমাদের জীবনমানের বিষয়টি বিবেচনা করুক সরকার। অবিলম্বে ন্যূনতম মজুরি এবং শ্রমিক অধিকার রক্ষার ঘোষণা দেওয়া। তা না হলে আমরা বাঁচব কী করে? আমরা না বাঁচলে গার্মেন্টশিল্পেও ধস নামবে। ভেঙে পড়বে জাতীয় অর্থনীতি। তাসলিমা, বেবি, আকলিমা, সোনালী, মাজিদা, খাইরুন, দীপালি, কনকচাপা, বেলী, শেফালি, টিয়া, মরিয়ম, কাকন, ইয়াসিন, হীরনসহ অর্ধশতাধিক গার্মেন্ট শ্রমিকের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায়, তাদের অভাব-অভিযোগ ও দাবি-দাওয়ার কথা। তারা নিজেরা মোটামুটি ভালোভাবে বাঁচতে চান এবং গার্মেন্টশিল্পকে আঁকড়ে ধরে জাতীয় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে চান। কিন্তু তাদের কথা শুনবে কে? জাতিসংঘের তথ্যে, নারীর মজুরিহীন গৃহস্থালি শ্রমের দাম ১১ লাখ কোটি ডলার। হিসাব না করায় বিশ্ব অর্র্থনীতি থেকে প্রতি বছর এই ১১ লাখ কোটি ডলার খুঁজে পাওয়া যায় না। জাতিসংঘ সমীক্ষায় আরো দেখা যায়, নারীরা সংসারে যে শ্রম প্রদান করেন, তা বাজারমূল্যে জাতীয় আয়ে যুক্ত করলে বিশ্বের মোট উৎপাদন আরো ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারীরা সপ্তাহে প্রায় ৪০ ঘণ্টা মজুরিহীন কাজে নিয়োজিত থাকেন এবং পুরুষরা ৩ ধরনের কাজ সপ্তাহে করে থাকেন মাত্র ১০ ঘণ্টা। আবার বিশ্ব খাদ্য সংস্থার গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, অধিকাংশ দেশে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে নারীরাই মূল ভূমিকা পালন করেন। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আফ্রিকার ভোগ করা মোট খাদ্যশস্যের ৮০ ভাগ এবং ল্যাটিন আমেরিকার ৪০ ভাগ নারীই উৎপাদন করেন। গোটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাতীয় আয়ে নারীর অবদান ৩০ ভাগ। বর্তমানে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী বিশ্বের মোট নারীর ৪৫ ভাগ অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয়। পরিবেশ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় নারীদের উল্লেখযোগ্য অবদান ও ভূমিকা এখন বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। উল্লেখ্য, লোকায়ত প্রযুক্তি, জ্ঞান ও লোকজ চিকিৎসা নারীদের দ্বারাই সংগৃহীত ও সঞ্চারিত হয়। বিশ্বে সর্বত্র প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান এ ইতিবাচক প্রবণতা লক্ষণীয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ১০ হাজার গ্রামীণফোনের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে প্রায় দেড় কোটি মানুষকে টেলিফোন সুবিধা দিচ্ছেন নারীরা। যার থেকে বছরে আয় হচ্ছে প্রায় ৭০০ মার্কিন ডলার; যা দেশের মাথাপিছু আয়ের দ্বিগুণ। বাংলাদেশের নারীদের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের হার প্রায় ৬০০ শতাংশ। মোট নারীর শ্রমশক্তির ৭৮ ভাগ এখন কৃষি খাতে নিয়োজিত। দেশের সার্ভিস খাতে ১২ ভাগ ও শিল্প খাতে ২৫ ভাগ নারীর শ্রমশক্তি অবদান রাখছে। অন্যদিকে পারিবারিক কাজে ৮০ ভাগই হচ্ছে নারীর শ্রম। উল্লেখ্য, জাতীয় প্রবৃদ্ধি পরিমাপের প্রচলিত প্রাচীন পদ্ধতি পুরুষের উৎপাদনমূলক কাজের ৯৮ ভাগকেই হিসাবে ধরা হয়। কিন্তু নারীর উৎপাদনী কাজে মাত্র ৪৭ ভাগ গণনা করা হয়। ফলে পুরোনো হিসাব অনুযায়ী, জাতীয় আয়ে নারীর অবদান দাঁড়ায় ২৫ ভাগ। কিন্তু নারীর রাজারবহির্ভূত কাজ বা মজুরিহীন শ্রমকে জাতীয় আয়ে অন্তর্ভুক্ত করলে আমাদের জাতীয় আয়ে নারীর অবদান দাঁড়ায় ৪১ ভাগ। দুই দশক ধরে দেশে রফতানি আয়ে নারীর অবদান সবচেয়ে বেশি। কেননা, এ দেশের বৈদেশিক ৭৫ ভাগ আসে পোশাকশিল্প খাত থেকে। যে খাতে প্রায় ৮০ ভাগই নারী শ্রমিক, প্রায় ১২ লাখ নারী এখন এ খাতে নিয়োজিত। তাছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী অন্যান্য রফতানিমুখী শিল্প খাতের অধিকাংশ শ্রমিক নারী। নির্মাণশিল্পসহ নানা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমবর্ধমান রাজনীতি ও নারীর দীপ্ত পদচারণা গণতন্ত্রকে আরো সুদৃঢ় করছে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close