নিতাই চন্দ্র রায়

  ০১ মে, ২০১৯

মুক্তমত

মহান মে দিবস ও শ্রমিক ঐক্য

মালিক শ্রেণি যেহেতু মুখের কথায় মুনাফার ন্যায্য অংশ শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টনের নীতি মেনে নিতে নারাজ। তাই তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম চালানো শ্রমিকদের ন্যায়সংগত অধিকার। পণ্য উৎপাদন, বিনিময় ও বণ্টন ব্যবস্থাÑ এ ত্রিবিধ ভিত্তিভূমির ওপর গড়ে উঠে কোনো সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো আর অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর গড়ে উঠে সমাজের আইনকানুন, রীতিনীতি ও রাজনৈতিক সংগঠন। মানুষের বেঁচে থাকার লক্ষ্যে জরুরি সব পণ্য উৎপাদনের জন্য শ্রমের বিকল্প নেই। এ শ্রমের জোগান দেন শ্রমিক। শ্রমিকরা সমাজের একটি বড় অংশ। কায়িক শ্রম বিক্রি করেই তারা বেঁচে থাকেন। তাদের শ্রম ছাড়া আর কোনো সহায়-সম্পদ নেই। তাই শ্রমিককে তার ন্যায্য মজুরি দেওয়া প্রয়োজন।

সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ পুঁজিপতি শ্রেণি। তারাই উৎপাদন উপকরণের মালিক। মালিক শ্রেণি নিজেদের জন্য অন্যদের খাটিয়ে সম্পদ বৃদ্ধি করেন। অপরদিকে শ্রমিকের আয় হলো মজুরি, যা তারা কাজ করার বিনিময়ে পেয়ে থাকেন। অধিক মুনাফা অর্জনের পূর্বশর্ত হলো খরচ কমিয়ে আনা। উৎপাদন ব্যয়ের একটি বড় অংশ হলো শ্রমিকের মজুরি। উৎপাদন উপকরণের মালিক এবং শ্রমিকের স্বার্থ পরস্পর বিপরীত। শ্রমিকদের কাছে সম্পদটা হলো দ্বিতীয় বিবেচ্য। তাদের বিবেচ্য বিষয় হলো শ্রমের ন্যায্য মজুরি। শ্রম ও পুঁজির ঐক্য সম্পর্কে যে যত কথাই বলুক, তার কোনো মূল্য নেই।

মে দিবস সারা পৃথিবীর মেহনতি মানুষের বিজয়ের সম্মিলিত ইতিহাস। এ ইতিহাস যেমন একদিকে বিজয়ের আবার অন্যদিকে বেদনার। বিজয় অর্জনে বহু শ্রমিককে জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে। কারাবরণ করতে হয়েছে। হতে হয়েছে নির্যাতনের শিকার। ১৮৮৬ সালে ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে হাজার হাজার শ্রমিক রাজপথে নেমে আসেন। আন্দোলনটি সারা আমেরিকায় আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৮৬ সালের ২ মে ছিল রোববার, সরকারি ছুটির দিন। তাই আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ বেশি দূর এগোতে পারেনি। ৩ মে সারা আমেরিকায় যখন শ্রমিকদের আন্দোলনে উত্তাল, সেদিন ম্যাকমিক রিপার কারখানায় আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে ৬ শ্রমিক নিহত হন। ৪ মে পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে শিকাগোর হে মার্কেট স্কয়ারে এক বিরাট শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেদিনের সমাবেশটি ছিল অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ। সমাবেশের শেষ বক্তা ফিশডেলের বক্তৃতার শেষের দিকে দূর থেকে একটি বোমা এসে পড়ে সমাবেশস্থলে। এতে একজন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। পুলিশ সমাবেশের শ্রমিকদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। শ্রমিকরাও রুখে দাঁড়ান। শুরু হয় শ্রমিক পুলিশ সংঘর্ষ। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ৪ শ্রমিক। নিহত হয় ৭ পুলিশ। সমাবেশস্থলে একজন কিশোর রক্তে ভেজা জামা খুলে বিজয় পতাকা উড়িয়ে দেয়, যা পরবর্তীতে লাল পতাকার মর্যাদা পায়। আটকদের মধ্য থেকে অনেককে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়। ১৮৮৭ সালে এঞ্জেল, ফিসার, পারসন্স ও স্পাইক নামের চারজন বিপ্লবী শ্রমিককে ফাঁসি দেওয়া হয়। ফাঁসিতে ঝোলানোর ঠিক পূর্বমুহূর্তে স্পাইক বলে যান, ‘এমন এক দিন আসবে যেদিন আমাদের নীরবতা, তোমরা যে কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে চাও, তার চেয়েও শক্তিশালী হবে।’ বিপ্লবী শ্রমিক নেতা স্পাইকের উচ্চারণ বৃথা যায়নি। বৃথা যায়নি তার আত্মহুতি। বিশ্বে আজ শ্রমিকদের আট ঘণ্টা শ্রমের দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশে দেশে ১ মে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে। এবারের মহান মে দিবসের প্রতিপাদ্য হলোÑ ‘সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে শ্রমিক ঐক্যের বিকল্প নেই।’

কোনো দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে শিল্প খাতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পের বিকাশ ছাড়া কাক্সিক্ষত অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্যবিমোচন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। চীন, জাপান ও কোরিয়া প্রভৃতি দেশ কৃষি থেকেই ধীরে ধীরে শিল্পের দিকে এগিয়ে গেছে। শিল্প উন্নয়নের সঙ্গে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার, কর্মপরিবেশ, মজুরি ও ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শ্রমিরা হলো শিল্প উন্নয়নের চালিকাশক্তি। তাদের মধ্যে যদি হতাশা থাকে, বিনা অপরাধে চাকরি হারানোর ভয় থাকে, তা হলে তারা কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না। ফলে পণ্যের গুণগত মানের সঙ্গে উৎপাদনও ব্যাহত হয়। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পায়, যার প্রভাব পড়ে দেশের সার্বিক অর্থনীতির ওপর।

বাংলাদেশের রফতানি আয়ের শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি আসে পোশাক খাত থেকে। এ শিল্পের সঙ্গে ৪০ লাখ শ্রমিকের জীবন-জীবিকা জড়িত। দেশের পোশাক খাতে মালিক পক্ষ মূল মজুরি বৃদ্ধির হার ২৩ শতাংশ বলে দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে তা গড়ে ২৬ শতাংশ কমে গেছে। তাই পোশাক খাতের সাম্প্রতিক মজুরি বৃদ্ধিকে শুভংকরের ফাঁকি বলে অভিহিত করেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। রানা প্লাজা ধসের ছয় বছর উপলক্ষে ‘তৈরি পোশাক খাতে সুশাসন : অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরে টিআইবি এ তথ্য জানায়। ২৩ এপ্রিল রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে এক সম্মেলনে প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, আইন অনুযায়ী প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে মজুরি বৃদ্ধির সঙ্গে ৩৬ শতাংশ বাড়ালে ৭তম গ্রেডে মূল মজুরি হওয়ার কথা ৫ হাজার ২০৭ টাকা, কিন্তু এই গ্রেডে মূল মজুরি ধরা হয়েছে ৪ হাজার ১০০ টাকা, যা কাক্সিক্ষত পরিমাণের চেয়ে অনেক কম। এভাবে প্রতিটি গ্রেডে ২৬ শতাংশ মূল মুজরি কমেছে। টিআইবি বলছে, বছরে ৫ শতাংশ হারে বাড়ানোর পর যে মজুরি দাঁড়ায়, তার সঙ্গে কমিশন গঠন করে বৃদ্ধির হারকে তারা বিবেচনায় নিয়েছে। তাদের কথা, ভারতের পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি ১৬০ ডলার, কম্বোডিয়ায় ১৯৭ ডলার, ফিলিপাইনে ১৭০ ডলার, ভিয়েতনামে ১৩৬ ডলার ও বাংলাদেশে ১০১ ডলার। মাথাপিছু জিডিপি বিবেচনায় বাংলাদেশের মজুরি হওয়া উচিত ২০২ ডলার, যা ১৭ হাজার টাকার সমান। এখন আছে মাত্র আট হাজার টাকা।

রানা প্লাজা ধসের ছয় বছরে পোশাক খাতের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার বিষয়ে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, শ্রমিকের কল্যাণে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ১ হাজার ১৩৮ জন শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে এবং আহত হন আরো ১ হাজারেরও বেশি শ্রমিক। ঘটনার ছয় বছর পরও আহত শ্রমিকদের অনেকেই এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেননি। দুর্ঘটনার শিকার ৫১ শতাংশ শ্রমিক এখনো কর্মহীন অবস্থায় আছেন। ২০ শতাংশের শারীরিক অবস্থা আরো অবনতি হয়েছে। অনেকে হাত, পা হারিয়ে রোগ যন্ত্রণায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। গার্মেন্ট শ্রমিক ছাড়াও এ দেশে মোটর শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, হোটেল-রেস্তোরাঁর শ্রমিক ও চাশ্রমিকরা আরো বেশি বঞ্চনার শিকার। বঞ্চনার শিকার নারী কৃষক-শ্রমিকরাও। তারা সমান কাজ করে পুরুষের চেয়ে অনেক কম মজুরি পান। মোটর শ্রমিকদের অবস্থা আরো শোচনীয়। দুর্ঘটনায় যত শ্রমিক মারা যান তার বেশির ভাগই মোটর শ্রমিক। অধিকাংশ মোটর শ্রমিকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না। আট ঘণ্টার বেশি কাজের জন্য ওভারটাইমও দেওয়া হয় না। দুর্ঘটনায় আহত হলে তার চিকিৎসা ও পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করে না মালিক পক্ষ। একটানা ১৬-১৭ ঘণ্টা গাড়ি চালাতে হলেও তাদের জন্য নেই কোনো বিশ্রামের ব্যবস্থা। নির্মাণশ্রমিকরাও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে বেঁচে আছেন। চামড়া ও বস্ত্রশিল্পে কর্মরত শ্রমিকরাও নানা প্রকার দুরারোগ্য রোগ-ব্যাধির শিকার। তাদের জীবনেরও নিরাপত্তা নেই। বাংলাদেশে ২ শতাধিক চা বাগানে পাঁচ লাখেরও বেশি শ্রমিক কর্মরত আছেন। এসব শ্রমিক দৈনিক মজুরি পান মাত্র ১০২ টাকা। বর্তমানে একজন কৃষি শ্রমিকের দৈনিক মজুরি যেখানে ৫০০ টাকা, সেখানে একজন চা শ্রমিকের মজুরি ১০২ টাকা, যা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। চা শ্রমিকদের সঙ্গে মালিক পক্ষের এ ধরনের আচরণ অমানবিক ও প্রহসনমূলক। শ্রমিক নেতাদের মতে, অন্যান্য রাষ্ট্রীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের মজুরির সঙ্গে সংগতি রেখে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি কমপক্ষে ৩০০ টাকা হওয়া উচিত।

স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও আমরা শ্রমিকদের ন্যূনতম বেঁচে থাকার অধিকারটুকু প্রদান করতে পারিনি। তাদের ন্যায্য মজুরি, কর্মপরিবেশ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও কর্মস্থলে মানবিক পরিবেশ এখনো নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। কোনো দেশে মালিক পক্ষ এমনিতেই তা বাস্তবায়ন করে না। এটা নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রকেই নিতে হবে উদ্যোগ। নিতে হবে যথাযথ ব্যবস্থা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা দায়িত্ব পান, তারা শ্রমিকের ভোটে নির্বাচিত হলেও ক্ষমতায় গিয়ে শ্রমিকরে স্বার্থ না দেখে, দেখেন মালিকের স্বার্থ। রক্তের মাধ্যমে অর্জিত শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯১৯ সালে আইএলও প্রতিষ্ঠিত হয়। দুনিয়ার মজদুর এক হও, শ্রমিকের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। এ সেøাগান চিরজাগ্রত হোক। বেঁচে থাক সারা পৃথিবীর মেহনতি মানুষের মনে অনন্তকাল। আমাদের মনে রাখতে হবে, সর্বহারাদের হারানোর কিছু নেই। পাওয়ার আছে সারা বিশ্ব। তাই সর্বহারাদের বিজয় অনিবার্য।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি

ত্রিশাল উপজেলা শাখা, ময়মনসিংহ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close