রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৯ এপ্রিল, ২০১৯

পর্যালোচনা

পরাশক্তির হস্তক্ষেপে দ্বিধাবিভক্ত লিবিয়া

আরব বিশ্বের গণবিস্ফোরণ এখন ছুঁয়ে যাচ্ছে প্রতিটি আরব বিশ্বে। পশ্চিমে আলজেরিয়া থেকে মরক্কো আর পূর্বে বাহরাইন থেকে ইয়েমেন। পঞ্চাশের দশকে মিসরে ‘বিপ্লব’ আরব জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্ম দিয়েছিল। আজ প্রায় তিনটি বছর পর তিউনিসিয়ায় জাইন এল আবিদিন বেন আলীর পতনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে আরেক বিপ্লবের। ইতিহাসে এ বিপ্লব কীভাবে চিহ্নিত হবে জানি না, কিন্তু প্রচন্ড এক রাজনৈতিক সুনামির জন্ম দিয়েছে আরব বিশ্বে। এটা অস্বীকার করা যাবে না, গত ৪১ বছরের শাসনে এই প্রথমবারের মতো গাদ্দাফি ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। ১৯৬৯ থেকে ২০১১ সাল, সময়টা বেশ দীর্ঘ। ৪১ বছর। রাজতন্ত্র দীর্ঘদিন থাকে বটে, কিন্তু একজন রাজা কিংবা বাদশাহও দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় নেই। গাদ্দাফি বাদশাহ ইদ্রিসকে উৎখাত করেই ক্ষমতায় এসেছিলেন। তার দীর্ঘ শাসনে তিনি এক অদ্ভুত শাসনব্যবস্থার জন্ম দিয়েছেন, যাকে গণতন্ত্র বলা যাবে না, সমাজতন্ত্রও বলা যাবে না। রাজতন্ত্র তো নয়ই। তিনি এটাকে বলছেন, ‘জনগণের শাসন’। এই জনগণের শাসনে কোনো রাজনৈতিক দল নেই। এমনকি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ অপরাধের শামিল, মৃত্যুদন্ড যেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি। তিনি এমন একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন, যেখানে তিনিই মুখ্য শক্তি। তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে সব কর্মকান্ড। ২০১১ সালের আরব বসন্ত নামক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঢেউ লেগেছিল লিবিয়ায়ও। এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সুযোগটি গ্রহণ করেছিল বৃহৎ পশ্চিমা শক্তিগুলো।

এমনকি আমেরিকাসহ ন্যাটো বাহিনী সরাসরি সামরিক অভিযান পরিচালনা করার মাধ্যমে গাদ্দাফীকে শাসনক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করে এবং সব আন্তর্জাতিক আইনকানুন ও নিয়মনীতি উপেক্ষা করে ন্যাটো বাহিনী গাদ্দাফিকে গুলি করে হত্যা করেছিল। এভাবেই গাদ্দাফি যুগের অবসান ঘটেছিল। গাদ্দাফি শাসনের পতন পরবর্তীতে ২০১১ সালের অক্টোবরে-ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিলর বা এটিসি লিবিয়ার শাসনক্ষমতা গ্রহণ করে এবং নতুন সরকারের পেছনে মূল শক্তি ছিল আমেরিকা ও ন্যাটো বাহিনী। নতুন সরকার একটি ঐক্যবদ্ধ বহুদলীয় গণতান্ত্রিক লিবিয়া বিনির্মাণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল। বিদ্যমান বাস্তবতা হলো, ঐক্যবদ্ধ লিবিয়ান রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিনির্মাণ করা সম্ভব হয়নি গাদ্দাফির পতনের আট বছর পরও। গাদ্দাফির শূন্যতা এখন অবধি পূরণ হয়নি এবং দেশে স্থিতিশীলতা আসেনি। ক্ষমতা আর সম্পদের জন্য দেশটিতে গৃহযুদ্ধ হয়েছে এবং লিবিয়া এখন দ্বিধাবিভক্ত। গাদ্দাফির ক্ষমতা দখল ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি তার ঝোঁক থাকায় পুঁজিবাদী বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো শুরু থেকেই গাদ্দাফির প্রতি বিরাগভাজন ছিল। লিবিয়ার তেল-সম্পদের ওপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠায় গাদ্দাফির ভূমিকায় পশ্চিমা পুঁজিবাদী শক্তিগুলো গাদ্দাফিকে পশ্চিমা শক্তিগুলোর অন্যতম দুশমন হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তখন থেকেই গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য প্রকাশ্য ও গোপনে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল আমেরিকাসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো। তবে শত বাধাবিপত্তি এবং পশ্চিমা শক্তিগুলোর ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত উপেক্ষা করেই ৪২ বছর ধরে লিবিয়ার প্রতাপশালী শাসক হিসেবে দেশ শাসন করে গেছেন কর্নেল গাদ্দাফি।

আসলে লিবিয়া এক জটিল ও সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আসছে সেই ২০১১ সাল থেকে এবং আবারও গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দেশটি। উত্তর আফ্রিকার মাগরেব অঞ্চলের তেল-সমৃদ্ধ রাষ্ট্র লিবিয়া; যার উভয় সীমান্তে ভূমধ্যসাগর, পূর্বে মিসর, দক্ষিণ-পূর্বে সুদান, দক্ষিণে চাদ ও নাইজার এবং পশ্চিম সীমান্তে রয়েছে তিউনিসিয়া ও আলজেরিয়া। ১ দশমিক ৮ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট ছয় মিলিয়ন জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশটি তার ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রচুর তেল-সম্পদের কারণে বৃহৎ পশ্চিমা শক্তিগুলোর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিধায় লিবিয়ার রাজনীতিতে বরাবরই হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেছে পশ্চিমের ওই শক্তিগুলো। এখন অবধি লিবিয়ার রাজনীতির কলকাঠি নাড়ছে ওই শক্তিগুলোই। লিবিয়া ১৯৫১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল এবং একটি ফেডারেল নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশটি পরিচালিত হওয়াকালীন সময়েই ১৯৬৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাজা ইদ্রিসকে ক্ষমতাচ্যুত করে কর্নেল মোয়াম্মার গাদ্দাফি দেশটির শাসনক্ষমতা দখল করে নেন। গাদ্দাফি সব রাজনৈতিক দল ব্যবস্থা বাতিল করে দেশে একদলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন এবং পররাষ্ট্রনীতি ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে, বিশেষ করে রাশিয়ার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। তবে গাদ্দাফি একটি শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ লিবিয়ান রাষ্ট্র ও সমাজ গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। লিবিয়ার জনগণের মধ্যে এখন চরম হতাশা এবং ভয় কাজ করছে। মৃত্যু এখন তাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। সন্ত্রাসী আর জঙ্গিগোষ্ঠীর আস্তানা এখন লিবিয়ায়। এদের হাতে হাতে অস্ত্র।

লিবিয়া এখন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। কারণ নিয়ন্ত্রণ করার মতো একক বৈধ কোনো শাসক বা কর্তৃপক্ষ এখন নেই লিবিয়ায়। লিবিয়ায় এখন কার্যত দুটি সরকার, দুটি প্রশাসন বিদ্যমান। রাজধানী ত্রিপোলিভিত্তিক লিবিয়ার পশ্চিম অংশে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমর্থনে গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল অ্যাকর্ড বা জিএনএ নামে একটি সরকার রয়েছে এবং এ সরকারের প্রধান হলেন ফায়াজ আল সারাজ। এই সরকারকে বৈধ সরকার হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত হাউস অব রিপ্রেজেনটিটেভসের সমর্থনপুষ্ট অপর একটি সরকার ও প্রশাসন রয়েছে লিবিয়ায়। লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি প্রধান ফিল্ড মার্শাল খলিফা হাফতারের সমর্থনপুষ্ট এ প্রশাসন লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে আছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, লিবিয়ার মোট ভূখন্ডের দুই-তৃতীয়াংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এ প্রশাসনের। আর লিবিয়ার অর্থনীতির মূল ভিত্তি তেল-গ্যাসের ত্রিকোয়ার্টার এ পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। ওখানকার বিভাজন ও বিভক্তিকে এভাবে দেখা যেতে পারে, ইসলামিক বনাম নন-ইসলামিক, আইএস জঙ্গি বনাম আল কায়েদা, মুসলিম ব্রাদারহুড বনাম মডারেট ইসলামিক গ্রুপ, হার্ডলাইনার ইসলামিক গ্রুপ, রেভ্যুলেশনারি বনাম নন-রেভ্যুলেশনারি গ্রুপ এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিভক্তি রয়েছে নন-বেদুইন আরব বনাম বেদুইন আরব। উপরোক্ত সমুদয় উপাদান লিবিয়ার রাজনীতি ও সমাজনীতিকে দ্বন্দ্বমুখর ও সংঘাতময় করে রেখেছে।

এসব অবস্থার মধ্যে এখন সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে দেখা দিয়েছে জাতিসংঘ সমর্থিত ফায়াজ আল সারাজ সরকার এবং মার্শাল হাতাফের মধ্যেকার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল ও সারা লিবিয়ায় কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লড়াই। ইতোমধ্যে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির ফেসবুক পেজে প্রচারিত এক অডিও বার্তায় ফিল্ড মার্শাল হাতাফ লিখেছেন, ‘আমরা ত্রিপোলিতে আসছি-আমরা আসছি’। হাতাফের এ ঘোষণা শুধুমাত্র ভয় দেখানো নয়, তিনি তার বাহিনীকে ত্রিপোলি অভিমুখে মার্চ করে যাত্রা করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং অবিলম্বে ত্রিপোলি দখলের জন্য তার বাহিনী ত্রিপোলি অভিমুখে রওনা দিয়ে ত্রিপোলির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম খবর প্রকাশ করেছে। লিবিয়ায় ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র, একক সরকার, শান্তি ও স্থিতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা করে মানুষের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করার জন্য জাতিসংঘ সব পক্ষকে নিয়ে শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে এবং এ মাসের মধ্যভাগে বৈঠকটি হওয়ার কথা রয়েছে। তবে এরই মধ্যে হাতাফ বাহিনীর ত্রিপোলি দখলের জন্য অভিযান শুরুর ফলে শান্তি আলোচনার সফলতা নিয়ে ইতোমধ্যেই শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমন অবস্থায় জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারও বসে নেই। হাতাফের বাহিনীকে প্রতিরোধ ও প্রতিহত করার জন্য জোর প্রস্তুতি নিয়েছে সরকারি বাহিনী। ফলে উভয় প্রতিদ্বন্দ্বী বাহিনীর মধ্যে স্থানে স্থানে সংঘাত হচ্ছে এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ রকমটা চলতে থাকলে লিবিয়ায় আবারও পরিপূর্ণ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। আর এটাই হচ্ছে লিবিয়াবাসীর জন্য প্রকৃত ভয় ও বিপদ।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গোটা দেশের ওপর এ দুটি প্রশাসনের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং অনেক সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী, মিলিশিয়া গোষ্ঠী, ট্রাইবাল অ্যালায়েন্স ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের প্রশাসন কায়েম করেছে। একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র ও সর্বসম্মত সরকার না থাকার কারণেই এমনটা হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১৪ সালের পর থেকে লিবিয়ার বিভক্তি এতটাই প্রকট হয়ে উঠতে থাকে যে, এর ফলে দেশটির প্রশাসন দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার পাশাপাশি দেশের সব প্রতিষ্ঠানÑ যেমন : আর্থিক প্রতিষ্ঠান, নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান, পুলিশ প্রশাসন এবং সামরিক বাহিনীও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। এ ধরনের প্যারালাল প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় দেশে কার্যকর শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশের মানুষ নিরাপত্তাহীন এবং সীমান্তগুলো অনিরাপদ। ফলে সীমান্তের জঙ্গি, সন্ত্রাসী ও চোরাকারবইর মাদক ব্যবসায়ীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর সংখ্যালঘু টুবু সম্প্রদায় ও আরব বংশোদ্ভুত চোরাকারবারি ও মাদক ব্যবসায়ীরা সীমান্ত রুটের দখল নিয়ে প্রায়শই সশস্ত্র লড়াইয়ে লিপ্ত হতে দেখা যায়। মোটকথা হলো, লিবিয়া এখন অশান্ত, অস্থিতিশীল এবং ক্ষমতা ও সম্পদের জন্য লড়াইয়ের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এবং লিবিয়ানদের মতে, আমরা গাদ্দাফির পতন পরবর্তীতে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলাম। মুক্ত মানুষ হয়ে পৃথিবীর অন্য সব মানুষের ন্যায় এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু এখন আমাদের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ক্ষমতা আর সম্পদলোভীদের ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে গোটা লিবিয়া আজ রক্তাক্ত এবং সব মানুষ তথা সর্বত্র আজ হতাশা, দুরবস্থা এবং ভীতিকর পরিবেশ। অর্থাৎ লিবিয়া এখন বিপর্যস্ত এবং মানুষের জীবন বিপন্ন। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে দেশ ও এর মানুষরা এখন বিভক্ত। তা হলে লিবিয়া কি গৃহযুদ্ধের দিকে অগ্রসর হচ্ছে- এই প্রশ্ন জনগণের মনে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close