অলোক আচার্য

  ২৬ এপ্রিল, ২০১৯

নিবন্ধ

সৃজনশীল পদ্ধতির ভবিষ্যৎ কোথায়

২০১০ সালে এসএসেিত সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রথম প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়। প্রথম দিকে সব বিষয়ে এবং সব শ্রেণিতে সৃজনশীল পদ্ধতির প্রয়োগ না করে ক্রমান্বয়ে এ পদ্ধতির প্রয়োগ হতে থাকে। কিন্তু এ পদ্ধতির প্রয়োগের এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীর ভেতর এ পদ্ধতির দুর্বলতা প্রকটভাবে লক্ষণীয়। তা ছাড়া বাজারে গাইডের প্রভাব কমেনি এতটুকু। বরং নানাভাবে বাজারে গাইডবই আরো ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। ছাত্রছাত্রীরা বছরের শুরুতেই বিনামূল্যে বই পাওয়ার পরপরই গাইড কেনার জন্য ছোটে। গাইডবই কেবল ছাত্রছাত্রীর দরকার হয় না, শিক্ষকদেরও হয়। সৃজনশীল বিষয়ে শিক্ষকরা কতটা দক্ষ হয়েছেন, তা নিয়ে নিয়মিত জরিপ পরিচালনা করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) গত মাসে প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে মাত্র ৬০ ভাগ শিক্ষক সৃজনশীলে প্রশ্ন করেন। ৪০ ভাগ শিক্ষক এখনো প্রশ্ন করেন না বা করতে পারেন না। বিভাগভেদে এ হার আরো কম। বরিশালে মাত্র ৩৪ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীলে প্রশ্ন করেন।

সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষকদের দক্ষ করে তুলতে সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ২০০৭ সাল থেকে এ প্রকল্প থেকে সৃজনশীল পদ্ধতির ওপর এসএসসি ও দাখিল পর্যায়ে চার লাখ ছয় হাজার ও এইচএসসি ও আলিম পর্যায়ে ৩৬ হাজার শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। প্রশ্ন হলোÑ এত টাকা ব্যয়ে প্রশিক্ষণ ও তদারকির পর আজও সৃজনশীল পদ্ধতিতে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন হয়নি কেন। অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ ওঠে শিক্ষকদের দক্ষতা নিয়ে। এ কথা সত্যি যে, আমাদের অনেক শিক্ষকই সৃজনশীলে দক্ষ নন। তারা নিজেরা প্রশ্ন তৈরি করেন না এবং গাইডবই থেকেই একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রশ্ন করেন। তাই সৃজনশীল আদতে সেই মুখস্থ বিদ্যার আদলেই রয়ে গেছে। বছর দুয়েক আগে মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নয়নে দেওয়া সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের প্রভাব মূল্যায়নে করা জরিপে সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে বেশ কিছু তথ্য ওঠে এসেছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর সৃজনশীল পদ্ধতি বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। তারা প্রয়োগমূলক ও উচ্চতর দক্ষতার প্রশ্নে উত্তর দিতে হিমশিম খাচ্ছে। তাছাড়া বিষয়ভিত্তিক সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে গণিত বিষয়ে ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ, ইংরেজিতে ৮ দশমিক ২ শতাংশ এবং বিজ্ঞান বিষয়ে ৩৩ শতাংশ শিক্ষার্থী বিষয়গুলো দুর্বোধ্য বলে মনে করে।

আমাদের দেশে শিক্ষা নিয়ে একটু বেশিই কাটাছেঁড়া চলে। এ বছর একটা বিষয় পাঠ্যে আছে তো পরের বছর তুলে দেওয়া হলো। সৃজনশীল পদ্ধতি প্রয়োগের আগে যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। তা হলে সেসময় কেন বোঝা যায়নি যে, এ পদ্ধতি আমাদের দেশে কতটা প্রয়োগযোগ্য। বিকল্প কোনো চিন্তা করলেই তা ফলপ্রসূ হবে, তার গ্যারান্টি কেউ দেবে না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষার্থীরা। যারা এসব পদ্ধতির প্রয়োগের শিকার। এখন পর্যন্ত সৃজনশীল বাস্তবায়নের পথে বাধা অথবা ব্যর্থতা বলতে গাইডবইয়ের পিছু না ছাড়া অন্যতম। কারণ গাইডনির্ভরতা কমানোই ছিল অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু তা এখন পর্যন্ত হয়নি। যারা সেসময় বললেন, সৃজনশীল হলেই গাইডের দরকার হবে না, এখন ঘটনা ঘটছে তার উল্টো। তার বদলে প্রাথমিক শ্রেণি থেকে শুরু করে সব শ্রেণিতেই গাইড ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিষয়টা এখন পর্যন্ত বড় চ্যালেঞ্জিং। কারণ গাইডমুখী থেকে পাঠ্যবই মুখী করাটাই সবথেকে প্রধান কাজ। মুখস্থ নয়, বরং বই পড়ে উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করাটাই আসল কাজের। গাইড থেকে প্রতি অধ্যায় থেকে বাছাই করা ১০টা জ্ঞানমূলক বা অন্যান্য প্রশ্ন মুখস্থ করে উত্তর দিলেই যদি পরীক্ষায় কমন পড়ে যায়, তা হলে বলতে হবে এটা মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাপকভাবে ব্যাহত করছে। সৃজনশীল পদ্ধতির নাম প্রথমে কাঠামোবদ্ধ ছিল। আদতে প্রশ্ন পদ্ধতি কাঠামোর ভেতরই করা হয়। কিন্তু নামটা একটু কঠিন টাইপের হওয়ায় পরে তা সৃজনশীল করা হয়। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়ার বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। শিক্ষকরা যাতে নিজেরাই প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন এবং বাইরে থেকে প্রশ্ন এনে পরীক্ষা না নিতে পারেন, তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

সৃজনশীলের ক্ষেত্রে বিশেষ করে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের দুর্বলতা চোখে পড়ার মতো। গণিতে সৃজনশীল না রাখার দাবিতে তো কত কিছুই হলো। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সৃজনশীল একটি আধুনিক মনোবিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি এবং এটিকে আমাদের আয়ত্ত করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি করতে পারব তত মঙ্গল। এখন পর্যন্ত সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে যে সমালোচনা হচ্ছে তা নিয়ে এখনই হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমরা আগের পদ্ধতিতে ফিরেও যেতে পারব বলে মনে হয় না। আবার নতুন কোনো পদ্ধতির প্রয়োগ বেশ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। আর তা সফল হবেইÑ এ নিশ্চয়তাও কেউ দিতে পারে না। ছাত্রছাত্রীদের গিনিপিগ না বানিয়ে বরং ব্যর্থতার কারণগুলো অনুসন্ধান এবং কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। আমাদের দেশে শিক্ষা পদ্ধতি, পাঠ্যসূচি নিয়ে যত ঘনঘন পরিবর্তন করা হয় অন্য কোথাও এটা করা হয় না। কেন প্রায় অর্ধেক শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে অদক্ষতার কারণ অনুসন্ধান করে তাদের প্রয়োজনে আরো প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।

এ কথা সত্যি, কোনো নতুন পদ্ধতির প্রয়োগে সফলতা অর্জন একটু সময়সাপেক্ষ। আমাদের পর্যাপ্ত জনবল, বিনিয়োগ এবং সর্বোপরি সঠিক পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। যে কারণে সৃজনশীল পদ্ধতির দিকেই আজ আঙুল উঠছে। কিন্তু যাদের কারণে সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে আজ প্রশ্ন করা হচ্ছে, তাদের দিকে আঙুল উঠছে না। ঢাকার একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রথম সাময়িক পরীক্ষার বাংলা প্রথম পত্রের বহুনির্বাচনী প্রশ্নে নিজের সৃজনশীলতার প্রয়োগ করতে গিয়ে অপপ্রয়োগ করেছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সেই প্রশ্নের ৮নং প্রশ্নে ‘আম-আটির ভেঁপু’ কার রচিত এর খ নম্বরে সানি লিওন অপশন, ২১ নং প্রশ্নে ’রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতার নাম’ এর ঘ নং অপশনে মিয়া খলিফা এবং প্রমথ চৌধুরীর পৈতৃক নিবাস কোথায়, প্রশ্নের খনং অপশনে ঢাকার বলদা গার্ডেন দেওয়া হয়েছে। সৃজনশীলতার এহেন অপপ্রয়োগ আমাদের হতাশ করে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষক কোনোভাবেই এর দায় এড়াতে পারেন না। তবে সৃজনশীল পদ্ধতি ব্যর্থÑ এখনো এ কথা বলার সময় আসেনি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close