আবু আফজাল সালেহ

  ২৬ এপ্রিল, ২০১৯

মুক্তমত

অপরাধপ্রবণতা ও আমাদের করণীয়

আমরা সাধারণত অর্থের অনিয়মকেই দুর্নীতি বলে থাকি। কিন্তু ব্যাপক অর্থে, দুর্নীতি হচ্ছে সুশাসনের অভাব। নীতির বাইরে যা তাই দুর্নীতি। এ হিসাবে আমাদের দুর্নীতির ব্যাপকতার শিকড় অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে। এখনই লাগাম টেনে ধরতে হবে। দুর্নীতির বিস্তৃতিই সামাজিক অবক্ষয়ের পাগলা ঘোড়াকে ছুটতে দিচ্ছে! খুন, ধর্ষণ তাই নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ। ক্ষমতার অপব্যবহার, নৈতিকতার পরাজয়, সংকীর্ণ মনতা ইত্যাদি অবক্ষয়ের গতি দিতে রসদ জোগাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহারও দায়ী। কৃত্রিম বৈষম্য তৈরি করাও সামাজিক অবক্ষয় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ! বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে প্রতি স্তরে সুশাসন নিশ্চিত করে সামাজিক অবক্ষয় রোধ করা যেতে পারে।

সমাজের স্থিরতা আনতে প্রভাব বিস্তারকারীরা ব্যর্থ। অনেক ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহযোগিতার ভূমিকা পালন করছে। ফলে অপরাধীদের শনাক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছি। ক্ষেত্রবিশেষে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছি। ক্ষমতার অপব্যবহার হচ্ছে প্রায়ই। সাগর-রুনি-তনু-সাফাদের ধর্ষণ করা হচ্ছে; নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। শিশু নির্যাতন বাড়ছে। লজ্জা-বিবেক লোপ পেয়েছে আমাদের! কার্যত সমাজব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না! রাষ্ট্রযন্ত্রকে কঠোরভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে আরো ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আমরা ক্রমেই পিছিয়ে যাব। সভ্য জাতি থেকে অসভ্য-বর্বর জাতির দিকে এগিয়ে যাব। যা আমাদের জন্য কখনো কাক্সিক্ষত বিষয় হবে না!

অবক্ষয় শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘ক্ষয়প্রাপ্তি’, সামাজিক মূল্যবোধ তথা সততা, কর্তব্য নিষ্ঠা, ধৈর্য, উদারতা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, সৃজনশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমতাবোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলি লোপ পাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বলে সামাজিক অবক্ষয়। অবক্ষয়ের পেছনে লোভ দায়ী। লোভ হতে পারে ক্ষমতার, লোভ হতে পারে চেয়ারের। জাতীয় জীবনে অবক্ষয়ের স্রোত প্রবলভাবে বইছে। মূল্যবোধ, নৈতিক চেতনা পাত্তা পাচ্ছে না। জবরদখল, হত্যা-আত্মহত্যা চলছে। অনেক ক্ষেত্রেই পরিবার ক্ষয় পেয়ে গেছে, ড্রাগের প্রচলন বেড়ে চলছে। পত্রপত্রিকায়, টেলিভিশন চ্যানেলে সমাজের ভেতরকার চিত্র অল্প প্রকাশিত হচ্ছে।

আর নৈতিকতা হচ্ছে ধরন বা ভালো আচরণ। মানসিক অবস্থা, যা অপরের মঙ্গল কামনা করে বা করতে অনুপ্রেরণা দেয়। আর মূল্যবোধ হচ্ছে, মানুষের আচরণের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারকারী ধারণা বা আদর্শ। বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী স্টুয়ার্ট সি, ডাজ বলেছেন, ‘সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে ওইসব রীতিনীতির সমষ্টি, যা ব্যক্তি সমাজের কাছ থেকে আশা করে এবং যা সমাজ ব্যক্তির কাছ থেকে লাভ করে।’ সমাজবিজ্ঞানী বেসারের মতে, ‘সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে সেসব গুণাবলি, যা ব্যক্তি নিজের সহকর্মীদের মধ্যে দেখে খুশি হয় এবং নিজের সমাজ, জাতি, সংস্কৃতি ও পরিবেশে মূল্যবান মনে করে খুশি হয়।’ আলোচনা করলে দেখা যাবে, এদিকে আমরা ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছি। যোগাযোগ খুব সামান্য, নড়াচড়াও খুব কম। এ ক্ষেত্রে মূলত প্রচারমাধ্যমই অবলম্বন। অপরাধ, অসামাজিক কার্যকলাপ, জুলুম, জবরদস্তি, দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ, ঋণখেলাপি ইত্যাদি স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। এমন একটা ঐতিহাসিক পর্যায়ের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি, যাকে বলা যায় অবক্ষয়ের কাল। এ সংকট থেকে উদ্ধার পেতে সবস্তরের লোকের সহযোগিতা প্রয়োজন। সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করতে হবে। নৈতিকতার সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পরিবার থেকেও নৈতিকতার প্রচলন করতে হবে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও লাগবে।

সমাজবিজ্ঞানী জনাথান হ্যাইট বলেন, ধর্ম, ঐতিহ্য ও মানব আচরণÑ এ তিনটি বিষয়ে নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এবার আমরা দেখি আমাদের প্রেক্ষাপট। ধর্মীয় বিষয়ে আমরা একেবারেই অসহিষ্ণু! অন্য ধর্মের বিষয়ে আমরা সহ্য করতে পারি না! সত্য-মিথ্যার ধার ধারি না! আমাদের ঐতিহ্যের অনেক কিছু আজ অন্য জাতি কর্তৃক দখল হয়ে যাচ্ছে বা গেছে। আর মানব আচরণ ক্রমেই অসহিষ্ণুতার দিকে এগিয়ে চলেছে। স্বাধীনতার ৪৮ বছরে আমাদের সমাজটা কতদূর এগিয়েছে। সামাজিক শৃঙ্খলা, সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা আমাদের যাপিত জীবনে কতটা অর্জিত হয়েছে। সমাজে কতটা অপরাধপ্রবণতা কমেছে, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সমাজটা কতটা নিরাপদ, সমাজ কাঠামো কতটা উন্নত হয়েছে, সার্বিক বিবেচনায় আমাদের সমাজটা নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধের দিক থেকে কতটা এগিয়েছে আজ, এ প্রশ্নগুলোর বিচার-বিশ্লেষণ করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।

লোভ, ন্যায়বিচার, বৈষম্য, নৈতিক শিক্ষার অভাব ইত্যাদি অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে, ফলে আত্মহত্যা ও হত্যাসহ অন্যান্য অপরাধপ্রবণতা বেড়েই চলছে। পারিবারিক কলহ, যৌনাচার, অশ্লীলতা, ধর্ষণ, খুন, ইভটিজিং, অ্যাসিড সন্ত্রাস, শিশু হত্যা-নির্যাতন, মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, স্বজন, বন্ধুবান্ধব সামাজিক স¤পর্কের এমন নির্ভেজাল জায়গাগুলোতে ফাটল ধরছে, ঢুকে পড়ছে অবিশ্বাস। ফলে বাপ-মায়ের হাতে সন্তান বা বিপরীত, স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, আত্মীয়স্বজনের কাছ হতে হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে; যা সমাজ অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ। সবচেয়ে বেশি অবক্ষয়ের শিকার হচ্ছে যুবসমাজ, যারা একটি দেশ বা জাতির ভবিষ্যৎ। তারা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে, হয়ে যাচ্ছে বখাটে, মদ্যপ, ধর্ষক ও সন্ত্রাসী। ইতিহাস ঐতিহ্য আর ক্রমবর্ধমান সভ্যতার ক্রম বিকাশ এর প্রতি ভ্রƒক্ষেপ না করে মানুষ তার আপন সত্তার কথা ভুলে গিয়ে নফসের তাঁবেদারিত্বে মত্ত হওয়ার প্রবণতাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

হতাশা, নিঃসঙ্গতা, অবিশ্বাস আর অপ্রাপ্তি আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে অনেকেই। সন্তানকে যথেষ্ট সময় না দেওয়া, অবৈধ আয়, অসম বণ্টন, সুশাসনের অভাব ইত্যাদি সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। কৃত্রিমতা, চাতুরতা, স্বার্থপরতা, তিক্ততা, হীনম্মন্যতা, ঈর্ষা, ক্রোধ, অহমিকা, দাম্ভিকতা, অনাচার, অবিচার, অকৃতজ্ঞতা, বেহায়াপনা, অবিচার, নৃসংসতা, বহুগামিতা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, অত্যাচার, ষড়যন্ত্র, খুন, গুম, অপহরণ, আদায়, ঠকবাজি, প্রতারণা, সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, যৌতুক, মাদক, বাল্যবিবাহ, চোরাচালানি, মজুদখোরী, ফিল্ম, পর্নো, বিজাতীয়, আকাশ সংস্কৃতির অবাধচর্চা, প্রশ্নপত্র ফাঁস, ফেসবুক, পরকীয়া, ঝগড়া, কলহ, বিরোধ, গোপনে অবৈধ মেলামেশা, ইভটিজিং, অ্যাসিড নিক্ষেপ, নারী ও শিশু ধর্ষণ, শিশু খাদ্যে বিষক্রিয়া, চাঁদাবাজি, বোমাবাজি। এগুলো সামাজিক অবক্ষয়ের চরম ও হতাশাজনক চিত্র!

দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে একশ্রেণির ভুয়া চিকিৎসক-পুলিশ-র‌্যাব-সাংবাদিক, দালাল, ভুয়া পরিদর্শক, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার দৌরাত্ম্য সমাজকে কলুষিত করে সামাজিক অবক্ষয় ডেকে আনছে। পরিবারের বয়স্ক পিতা-মাতার ভরণপোষণে সন্তানদের বিমাতাসুলভ আচরণ মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ। সমাজে পাড়া-প্রতিবেশীর প্রতি বিত্তবানদের প্রয়োজনীয় নৈতিক দায়িত্ববোধ দিন দিন কমে যাচ্ছে। ধর্মীয় অনুশাসন ও সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টি/বৃদ্ধি এ অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে! এ ব্যাপারে ধর্মীয় নেতাদের অধিক প্রচার করতে হবে। শিক্ষকরা যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। তারা ক্লাস বা বাইরে মূল্যবোধ নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। আবার সাংবাদিক/লেখকরা পত্রিকায় লেখার মাধ্যমে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করতে সক্ষম। এ ব্যাপারে তারাও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন। অপরাধের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে আমাদেরকে বা প্রশাসনকে। অপরাধীকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত বা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এসব বিচার করা যেতে পারে। বিচার বিভাগীয় তদন্ত/নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করতে পারে সরকার। অবশ্য অপরাধী ধরতে আমাদের শতভাগ সাহায্য ও সহযোগিতা করতে হবে। তদুপরি কঠোর ও শক্তিশালী আইন প্রণয়ন ও তার কঠোর প্রয়োগ অবক্ষয় বা বিকৃত এ রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে! যেন আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে অপরাধীরা পার না পায়, সে বিষয়ে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে! পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। শিক্ষা বা ধর্মীয় অপব্যাখ্যা বন্ধ করতে হবে। এজন্য ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগব্যবস্থা তদারকি করতে হবে কঠোরভাবে। জনসাধারণকে এ ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগিতা করতে হবে। তাই বলা যায়Ñ সরকার, জনসাধারণ, বুদ্ধিজীবীরা সবাইকে একই প্ল্যাটফরমে আসতে হবে। আর এটাই হবে সামাজিক অবক্ষয় থেকে বাঁচার একমাত্র পথ।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close