এস এম নাজের হোসাইন

  ২৬ এপ্রিল, ২০১৯

বিশ্লেষণ

ভোক্তারাই রুখতে পারে মূল্যবৃদ্ধি

পবিত্র রমজান, ঈদ, পুজো-পার্বন আসার বহু আগেই আমাদের দেশে ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে জনজীবনে অসহনীয় পরিবেশ তৈরি করে থাকেন। পবিত্র রমজান সামনে রেখে প্রতি বছর অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী ও মুজদদারের আবির্ভাব ঘটে, এসব ব্যবসায়ী রমজান উপলক্ষে চিনি, ছোলা, ডাল, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, চাল, সয়াবিন, খেজুর, পাঞ্জাবি, শাড়ি ইত্যাদি পণ্যের পসরা সাজিয়ে থাকেন। অনেকে আবার ডিও ব্যবসার ন্যায় পণ্যদ্রব্যের আমদানি ও বাজারজাত করে থাকেন। কথিত আছে এসব ব্যবসায়ী নাকি বলেই থাকেন রমজানে ‘এক মাস ব্যবসা করব আর সারা বছর আরামে কাটাব’? পবিত্র রমজান মাস মুসলিম বিশ্বের জন্য আল্লাহর নিয়ামত বা দান এবং এটি সংযম ও নাজাতের মাস, পাপ মুক্তির মাস হলেও এসব মৌসুমি ব্যবসায়ী নামদারি মূল্য সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্যের কারণে জনজীবন হয়ে ওঠে অসহনীয় ও যন্ত্রণাদায়ক। পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রজমানের ব্যবহার্য সব পণ্যসামগ্রী এবং পবিত্র বড়দিন উপলক্ষে ইউরোপে ও আমেরিকার দেশগুলোতে পণ্যসামগ্রীর বাজারে বিশাল মূল্যহ্রাস প্রথা চালু আছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতেও পুজোর সময় মূল্যহ্রাসসহ নানা প্রথা চলমান আছে। কিন্তু তার বিপরীতে আমাদের দেশে পরিস্থিতি পুরোপুরি উল্টো। রমজান, ঈদ বা পুজো এলেই আমাদের দেশের খুচরা থেকে মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ীরা সাধারণ ভোক্তাদের পকেট কাটার উৎসবে মাতোয়ারা হন, ‘শুভ মূল্য বৃদ্ধি’-এ সেøাগান দিয়ে। ফলে জনগণের জনজীবন হয়ে ওঠে নাভিশ্বাস। রমজান নাজাতের মাস হলেও অনেকের কাছে এটি আতঙ্কের মাসে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। কারণ তাদের জীবন ও জীবিকা এ মাসে কঠিন হয়ে যায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এরই মধ্যে ব্যবসায়ীদের প্রতি দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু কতটা কার্যকর হয়, এটা দেখার বিষয়।

পবিত্র ইসলামেও অতিরিক্ত মূল্য আদায়কে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে, হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘ব্যবসায়ী যদি সীমাতিরিক্ত মূল্য গ্রহণ করে এ সুযোগে যে ক্রেতা পণ্যের প্রকৃত মূল্য জানে না, তা হলে এই অতিরিক্ত পরিমাণের মূল্য সুদ পর্যায়ে গণ্য হবে।’ আবার মজুদদারি সম্পর্কে হযরত মুহাম্মদ (স.) ঘোষণা করছেনে, ‘মজুদদার খুবই নিকৃষ্টতম ব্যক্তি। যদি জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পায় তবে তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে। আর যদি দাম বেড়ে যায় তবে আনন্দিত হয় (মশিকাত)’। মজুদদারি পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কখনো কখনো পণ্যদ্রব্যের দাম তাদের ইচ্ছামতো বাড়িয়ে দেয়। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘কেউ যদি মুসলমানদের থেকে নিজেদের খাদ্যশস্য আটকিয়ে রাখে, তবে আল্লাহ তাআলা তার ওপর মহামারি ও দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন’ (ইবনে মাজা ও বায়হাকি)। রাসুলুল্লাহ (স.) বলছেন, ‘যে ব্যক্তি পণ্য আমদানি করে বাজার দামে বিক্রয় করে, তার উপার্জনে আল্লাহর রহমত রয়েছে। আর যে ব্যক্তি আমদানি করে চড়া দামে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে যে পণ্য মজুদ করে রাখে, তার প্রতি আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন’।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লেই আমরা প্রায়শ সরকারকে দোষারূপ করে থাকি। এটি ঠিক যে, সরকারের যথাযথ মনিটরিংয়ের দুর্বলতার সুযোগে আর দ্রব্যমূল্য মনিটরিংয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারের কর্তাব্যক্তিদের খামখেয়ালিপনার কারণে কিছু মুনাফাখোর, মজুদদারি, সিন্ডিকেট ও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য অস্থিতিশীল হয়। একশ্রেণির নীতি আদর্শহীন, অতি মুনাফালোভী, অসাধু ব্যবসায়ীদের দিনে দিনে কোটিপতি হওয়ার বাসনায়, তাদের ইচ্ছামতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ ও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ও দাম বাড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা অচল করে দেয়। যার ফলে সাধারণ মানুষের জন্য জীবন-জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন ও অনেকাংশে অসম্ভব হয়ে পড়ে। ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে দাম বাড়ালেও ওই পণ্যের আন্তর্জাতিক মূল্য কমলেও তারা আর কমায় না। আবার যখনই কোনো পণ্যের দাম বাড়ে তখনই সাধারণ জনগণও সেখানে হুমরি খেয়ে পড়েন, দাম বাড়ার গুজবে নিজেরাই ওই পণ্যের মজুদে তৎপর হয়ে ওঠে। ফলে সংকট আরো ঘনীভূত হয়। আমাদের সবার জানা, গেল বছর পাঁচেক আগে ভারতে পেঁয়াজের দাম হাঠৎ করে বৃদ্ধি পেলে, পুরো ভারতবর্ষে ভোক্তারা পণ্যটি কেনায় সাশ্রয়ী হয়ে উঠেন এবং বিকল্প ব্যবহার শুরু করেন। ফলে একপর্যায়ে ভারতে পেঁয়াজ এর মূল্যবৃদ্ধি স্তমিত হয়ে পেঁয়াজের মূল্য এত কমে যায় যে, অনেক ব্যবসায়ী পেঁয়াজ বিক্রি করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ লোকসান গুনতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ অবস্থা আমাদের দেশেও হয়েছে গত ২ বছর পেঁয়াজ, ছোলা ও খেজুরের দাম বৃদ্ধির কারণে অনেকে বেশি করে আমদানি করেন। কিন্তু পরবর্তীতে দাম কমে গিয়ে বিপুল লোকসানের শিকার হন অনেক ব্যবসায়ী। আমরা অন্তত এ ধরনের একটি দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে স্থাপন করতে পারি না? কিন্তু একজন সাধারণ ক্রেতা-ভোক্তা হিসাবে আমরা সব সময় আমাদের অধিকারের কথা বলি। অধিকার ভোগ করতে গিয়ে আমাদের উওপর যে দায়িত্বগুলো বর্তায় তা কিন্তু একেবারেই ভুলে যাই। একজন ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকারগুলো হলো; অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, নিরাপদ পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার, পণ্যের উপাদান, ব্যবহারবিধি, পার্শ¦প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি তথ্য জানার অধিকার, ন্যায্যমূল্যে সঠিক পণ্য ও সেবা পাওযার অধিকার, অভিযোগ করার ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার, কোনো পণ্য বা সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার, ক্রেতা-ভোক্তার অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার, স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ ও বসবাস করার অধিকার। ঠিক একই সঙ্গে আমাদের রয়েছে ৫টি দায়িত্ব, এগুলো হলো; পণ্য বা সেবার মান ও গুণাগুণ সম্পর্কে সচেতন ও জিজ্ঞাসা হওয়া; দরদাম করে সঠিক পণ্যটি বাছাই করা; আপনার আচরণে অন্য ক্রেতা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন; সে ব্যাপারে সচেতন থাকা; পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সচেতন ও সক্রিয় হওয়া; ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে অধিকার সংরক্ষণে সোচ্চার ও সংঘটিত হওয়া। উপরোক্ত বিষয়গুলো জাতিসংঘ স্বীকৃত ক্রেতা-ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব হলেও বাংলাদেশর সাধারণ জনগণ প্রতিনিয়তই এবং প্রতি পদে পদে এসব অধিকার থেকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি দায়িত্ব সম্পর্কে একেবারেই নির্লিপ্ত ও অনাগ্রহী। সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা, জাতীয়, আর্ন্তজাতিক সংস্থা ও বহুজাতিক দাতা গোষ্ঠী দুর্নীতি হ্রাস, সুশাসন ও মানবাধিকার সুরক্ষায় সরব থাকলেও জনগণের নিত্যনৈমিত্তিক এ অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে তাদের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। অথচ এই ক্রেতা-ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করা না গেলেই তৃণমূল পর্যায় থেকেই মানবাধিকার সুরক্ষা বা সুশাসনের স্বপ্ন শুধু মাত্র স্বপ্নই থেকে যাবে। কারণ তৃণমূলে ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত না হলে মানুষের জীবন-জীবিকা স্বাভাবিক রাখা কঠিন হবে।

তাই রমজান মাস উপলক্ষে ক্যাব থেকে সম্মানিত ক্রেতা-ভোক্তাদের কাছে আমাদের আবেদন, দয়া করে একজন ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে আমরা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো সম্পর্কে সচেতন হই, নিজেরা দায়িত্ববান হই। একই সঙ্গে মাসের বাজার না কিনে সপ্তাহের জন্য সপ্তাহে কিনি। পণ্য ক্রয় করার সময় দাম ও পণ্যের মান যাচাই-বাছাই করে কিনি। কোনো পণ্যের দাম বাড়লে তা কেনা ও মজুদের জন্য হন্য হয়ে না পড়ে আগে খোঁজখবর নিই, প্রয়োজনে বিকল্প হিসেবে অন্য পণ্য কিনি এবং ওই পণ্যটির ব্যবহারে সাশ্রয়ী হই। এটা প্রায় সময় দেখা যায়, রমজানের সময় ছোলা, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, বেগুন ও শসার দাম আকাশচুম্বী হয়ে যায়, কিন্তু রমজানে এগুলোর ব্যবহার সীমিত করলে রমজানের কোনো পবিত্রতা নষ্ট হবে না বা তৃপ্তিতে কোনো বিঘœ ঘটবে না। তা হলে কেন আমরা রমজানের সময় বিনা কারণে এসব উপাদানের পেছনে ছুটছি? তা নতুন করে ভাবতে হবে। তবে সবচেয়ে যেটা বেশি প্রয়োজন তা হলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বিকল্প উৎস বের করা এবং কোনোভাবেই একক পণ্যের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল না হওয়া। সরকারের ও উচিত এসব ভোগ্যপণ্য আমদানির ভার এককভাবে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যবসায়ীর হাতে ছেড়ে না দিয়ে মনোপলি ব্যবসা বন্ধ করা। একই সঙ্গে উৎস দেশ হিসিবে সব কিছুর জন্য কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশের ওপর নির্ভর না হয়ে অন্য দেশগুলোর ওপরও গুরুত্বারোপ করা। এ ছাড়াও যেসব উৎপাদক, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী তিনি পাইকারি ও খুচরা হোক না কেন, যারাই ইচ্ছাকৃতভাবে বাজারে কৃত্রিমভাবে পণ্য কেনা বেচায় সংকট তৈরি করছেন তাদের বাজারজাতকৃত পণ্য বয়কট ও তাদেরও সামাজিকভাবে বয়কট করি। এ ছাড়াও অনেক বিত্তবান রমজান মাসে মানুষ ইফতারি দিয়ে সাহায্য করেন, এটি ভালো উদ্যোগ। তবে তাকে ইফতারসামগ্রী না দিয়ে যদি নগদ টাকা দেওয়া হয়, সে তার পছন্দমতো পণ্য কিনে নিতে পারবেন। আমি যাকে ইফতারিসামগ্রী দিচ্ছি, তার হয়তো চাল দরকার। বিষয়টি এভাবে ভাবলে পণ্যসামগ্রীর সরবরাহে বিঘœ ঘটবে না। বিষয়টি মনে রাখতে হবে, ভোক্তা হিসেবে আমরাই সব পণ্যের নিয়ামক হই। কোনোভাবেই উৎপাদক ও বাজারজাতকারী খুচরা ব্যবসায়ীরা যেন পণ্যের মূল নেয়ামক না হয়, সেজন্য আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে, সচেতন হতে হবে। প্রতিটি রমজান ও পুজো পার্বন উপলক্ষে দেশে কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ীর আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু যারা প্রকৃত ব্যবসায়ী সারা বছর বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ করে আমাদের চাহিদা মিটিয়ে থাকেন, এসব মৌসুমি ব্যবসায়ীর উৎপাতে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তাদের করণীয় তেমন থাকে না। তাই মৌসুমি ব্যবসায়ীদের বিষয়ে সতর্ক হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।

লেখক : ভাইস প্রেসিডেন্ট

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close