সাধন সরকার

  ২৫ এপ্রিল, ২০১৯

মতামত

অপচয় নয় তারুণ্যের শক্তি

একটি দেশের প্রাণশক্তি হলো তরুণ জনগোষ্ঠী। যেকোনো দেশের মোট জনসংখ্যার যত বেশি তরুণ জনগোষ্ঠী থাকে, সে দেশ তত বেশি সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি পায়। তারুণ্যের শক্তি বা কর্মদক্ষতার ওপর ভর করে একটি দেশ উন্নতি লাভ করে। স্বপ্ন দেখাই হলো তারুণ্যের ধর্ম। তবে তরুণদের মাঝে মাঝে হতাশও হতে হয়! দুঃখের বিষয় হলো, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে মর্মপীড়া কাজ করছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার জনমত জরিপেও ৯০ ভাগের বেশি তরুণ (জরিপে অংশগ্রহণকারী) চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর যৌক্তিকতা তুলে ধরে গত কয়েক বছর থেকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে আসছেন তরুণরা। বলতে দ্বিধা নেই, লাখ লাখ তরুণ সত্যিই আজ হতাশাগ্রস্ত! তারা এ কথা মানতে পারছেন না যে, একাডেমিক পড়া শেষ করে চাকরির পড়া শুরু করার স্বল্প সময়ের মধ্যে বয়স ৩০ বছর পার হওয়ার কারণে তারা আর চাকরিতে আবেদন করতে পারবেন না! এক একটা বিসিএসের আবেদনসহ অন্যান্য চাকরির আবেদন চলে যাচ্ছে আর লাখ লাখ তরুণ চোখের জল ফেলছে, তারা আরো হতাশ হয়ে পড়ছে। সদ্য চাকরির বয়স পার হওয়া তরুণদের প্রাণ গুমরে গুমরে কাঁদছে! তারুণ্যের শক্তি আজ ‘৩০’-এর দেয়ালে চাপা পড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে! বর্তমানে শিক্ষিতের হার বেড়েই চলেছে এবং প্রতি বছর গেল বছরের চেয়ে আরো বেশি চাকরিপ্রত্যাশী চাকরির বাজারে প্রবেশ করছেন।

বর্তমানে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ১৮-৩০ বছর। গড় আয়ু যখন ৪৫ ছিল তখন চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছিল ২৭ বছর। গড় আয়ু যখন ৫০ পার হলো তখন প্রবেশের বয়স হলো ৩০। বর্তমানে গড় আয়ু প্রায় ৭২ বছর, তা হলে চাকরিতে প্রবেশের বয়স কেন ৩০-এ থমকে থাকবে? জাতীয় সংসদে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির বিষয়ে বহুবার দাবিও উঠেছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই! সত্যি বলতে মানসম্মত চাকরি পেতে হলে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করতে করতে প্রায় ২৫-২৬ বছর লেগে যাচ্ছে! অবসরের বয়সসীমাও বেড়েছে। অন্যান্য কিছু পেশায় অবসরের বয়সসীমা আরো বেশি বাড়ানো হয়েছে। পৃথিবীর ১৬০টিরও অধিক দেশে (রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সুইডেন, ভারতসহ অধিকাংশ উন্নত দেশে) চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০-এর অধিক। পাশর্^বর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৪০, রাশিয়ায় অবসরের আগের দিনও সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করা যায়। আফ্রিকায় কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫৯ বছরের আগের যেকোনো সময় চাকরিতে প্রবেশ করা যায়। সত্যি কথা হলো, একাডেমিক পড়াশোনা শেষ করে চাকরির পড়াশোনা শুরু করতে করতে বয়স ৩০ পার হয়ে যাচ্ছে। লাখ লাখ তরুণ চাকরি না পেয়ে হতাশায় ভুগছেন। বাস্তবতা এটাই যে, বর্তমানে লাখ লাখ ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষা আছে, সনদ আছে, কিন্তু চাকরি নেই! ঘুষ-দুর্নীতির কারণে অনেকে আবার সময়মতো চাকরি পাচ্ছেন না! বয়স ৩০ পার হওয়া মানে অর্জিত সার্টিফিকেটের মেয়াদ শেষ! সহজ কথায়, একজন তরুণকে ‘৩০’-এর গন্ডির মধ্যে বেঁধে রাখা হচ্ছে! ফলে বয়স ৩০-এর মধ্যে চাকরি না পাওয়া একজন তরুণকে নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তথ্যমতে, বর্তমানে প্রায় ২৭ লাখ কর্মক্ষম তরুণ-তরুণী বেকার। এদের প্রায় অর্ধেক অংশই স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করা চাকরিপ্র্রত্যাশী। তবে প্রকৃতপক্ষে বেকারের সংখ্যা আরো বেশি। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ‘৩০’-এ বেঁধে রাখার ফলে সব শিক্ষার্থীর মেধা কি আদৌ কাজে লাগানো যাচ্ছে? সরকারি নিয়ম অনুসরণ করার ফলে বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানও ৩০ বছরের ঊর্ধ্বে জনবল নিয়োগ দিচ্ছে না! আবার ‘যুবনীতি-২০১৭’তে যুবাদের বয়স ১৮-৩৫ রাখা হয়েছে। তা হলে কেন চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ রাখা হবে?

দেশের সব তরুণের সম্ভাবনা, সৃজনশীলতা ও কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগাতে হবে। তাই উন্নত বিশে^র সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষিত তরুণদের কাজে লাগাতে দেশের উন্নয়নে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো প্রয়োজন। এতে করে বেকারত্বের বোঝা কমবে। সদ্য বেকার বনে যাওয়া তরুণরা দেশের অভিশাপ নয়, তারাও সুযোগ পেলে দেশের ও পরিবারের জন্য কিছু করতে চান। সেই সুযোগ রাষ্ট্রকে তৈরি করে দিতে হবে। অন্যথায় বড় ধরনের জনশক্তি অপচয় হবে! বেকারত্বের জ¦ালা সহ্য করতে না পেরে অনেকে সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন! অনেক মেধা আবার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো মানে তো চাকরি দেওয়া নয়। বরং একটি সম্ভাবনাময় শেষ হওয়া

জীবনগাড়ির চাকা নতুন করে সচল করা! এতে বাড়তি টাকার অপচয়ও হবে না। যে যার মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাবেন। তা ছাড়া একটু বেশি বয়সে চাকরিতে প্রবেশ করলে জ্ঞানের চর্চাও অব্যাহত থাকবে। বিভিন্ন রাষ্ট্রে বেকার তরুণদের জন্য বেকার ভাতা চালু আছে। কিন্তু আমাদের দেশে বেকার ভাতা না হোক অন্তত চাকরিতে

প্রবেশের বয়সসীমা বাড়িয়ে তরুণদের বেকারত্বের হাত থেকে তো মুক্তি দেওয়া যেতে পারে! যুক্তিসংগত ও সময়ের যুগোপযোগী দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সব দিক বিবেচনা করে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার সুপারিশ (একাধিকবার) করেছিল গত সরকারের জনপ্রসাশন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত ‘সংসদীয় স্থায়ী কমিটি’। তরুণ সমাজ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের প্রতি আবারও

আস্থা রেখেছে। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারেও চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা যৌক্তিকভাবে বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। যুক্তিসংগত ও সময়ের দাবি, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ করা হোক। এতে করে শিক্ষার্থীরা হয়তো নিজেকে তৈরির এবং মেধা কাজে লাগানোর আরো বেশি সুযোগ পাবেন। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়িয়ে তরুণ জনগোষ্ঠীর মর্মযাতনা দূর করার উদ্যোগ নেওয়া হোক।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close