মোতাহার হোসেন

  ২৫ এপ্রিল, ২০১৯

বিশ্লেষণ

স্বাস্থ্যসেবায় সরকার

প্রবাদ আছে ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’। স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে অর্থবিত্ত, যশখ্যাতি কিছুই ভালো লাগে না। তা ছাড়া একটি উন্নতসমৃদ্ধ জাতি গঠনেও সুস্বাস্থ্য অপরিহার্য। এই অর্থে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দেশের স্বাস্থ্যসেবায় নিরন্তর কাজ করে চলেছে। এরই মধ্যে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, বেশ কিছু বিরল রোগের চিকিৎসা, হৃদরোগ, কিডনি ও ক্যানসার চিকিৎসায়ও যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. দেবী শেটি মন্তব্য করেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের চেয়ে এখানের চিকিৎসা ব্যবস্থা কোনো অংশে পিছিয়ে নেই।’ একই ধরনের মন্তব্য করেছেন ওবায়দুল কাদেরের চিকিৎসায় আসা সিঙ্গাপুরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও। এ ছাড়া সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন, বিনামূল্যে ৩০ রকমের ওষুধ সরবরাহ, মাতৃত্বকালীন সেবাসহ বেশ কিছু সেবা বিনামূল্যে দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বিস্তৃত করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এমনি এক প্রেক্ষাপটে এই প্রথমবারের মতো দেশে পালিত হতে যাচ্ছে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা সপ্তাহ। এই কর্মসূচির প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘স্বাস্থ্যসেবার অধিকার : শেখ হাসিনার অঙ্গীকার’।

এ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা প্রয়োজন, স্বাধীনতা-উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই মূলত স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন শুরু হয়েছিল। এটি জনগণের মৌলিক পাঁচ চাহিদার অন্যতম একটি। স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে সংযোজন এবং প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে দেশের সব মানুষ তথা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে ‘জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান’ প্রতিষ্ঠা করেন। জাতির পিতার গৃহীত পরিকল্পনাসমূহের

আলোকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের দোরগোড়ায় নিরাপদ ও মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে নানমুখী কার্যক্রম গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এসব কার্যক্রমের বিস্তৃতিসহ সার্বিক সেবা কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা, স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও সব পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন।

আমরা বিশ্বাস করি, একটি জাতির সামগ্রিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতির সার্বিক উন্নতি ও অগ্রগতি নির্ভর করে জনস্বাস্থ্যের সার্বিক উন্নয়নের ওপর। সরকার স্বাস্থ্যমান উন্নয়ন, সংরক্ষণ, সেবার মান বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা জোরদারে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে; যার সুফল জনগণ এরই মধ্যে পেতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। গত এক দশকে রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় নতুন নতুন বিশেষায়িত ও জেনারেল হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে, যেমনÑ শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইএনটি, ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট মুগদা জেনারেল হাসপাতালসহ অনেক হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে। আরো অনেক হাসপাতাল সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। এ ছাড়াও উপজেলা হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন, চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফ পদ সৃষ্টি, নতুন নতুন ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণ, টিকাদান কর্মসূচিতে নতুন নতুন টিকা সংযোজন করা হয়েছে। সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নির্মিত কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে গ্রামীণ হতদরিদ্র মা ও শিশুসহ সবস্তরের জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে; যা আজ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। সরকারের গৃহীত এসব কর্মকান্ড জনগণের স্বাস্থ্যমান উন্নয়নের পথকে সুগম করেছে।

অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধিতে দক্ষ জনবল তৈরির জন্যও চলছে। তারই অংশ হিসেবে প্রতিটি বিভাগে একটি করে মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়, নতুন নতুন মেডিকেল কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউট, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট নার্সিং ইনস্টিটিউটসহ অন্যান্য চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়েছে। চিকিৎসকদের জন্য উচ্চশিক্ষার আসন বৃদ্ধি, নতুন কোর্স চালুকরণ, নার্সিং বিষয়ে পিএইচডি ও মাস্টার্স প্রশিক্ষণ, বিএসসি নার্সিংয়ের আসন সংখ্যা বৃদ্ধি, ডিপ্লোমা-ইন-মিডওয়াইফারি কোর্স চালুকরণসহ দক্ষ জনবল তৈরিতে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। বর্তমান সরকারের গত মেয়াদে ১৩ হাজার চিকিৎসক, ১৫ হাজার নার্স এবং ১৬ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আরো নতুন ১০ হাজার চিকিৎসকসহ পর্যাপ্তসংখ্যক নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। সম্প্রতি বিসিএসের মাধ্যমে ৩০৬ জন চিকিৎসক যোগদান করেছেন।

দেশের ওষুধশিল্পেও ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ২০১৬ সালে জাতীয় ওষুধনীতি আধুনিকায়ন করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে ১৬০টিরও বেশি দেশে ওষুধ রফতানি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারী ও শিশুদের জন্য মানসম্মত সেবা প্রদান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কার্যকর এবং গ্রহণযোগ্য সেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে শিশু, বয়স্ক ও নারীদের সঙ্গে ভালো আচরণ প্রদর্শনে চিকিৎসকদের মানসিকতার উৎকর্ষ সাধনে প্রয়োজনীয় কাউন্সিলিং অপরিহার্য। আমরা যদি চিকিৎসদের সেবার ও তাদের আচরণের ইতিবাচক পরিবর্তন না ঘটাতে পারি, তা হলে চিকিৎসা ব্যবস্থায় যতটাই আধুনিক, যুগোপযোগী করা হোক না কেন; রোগীরা এ থেকে সামান্যই উপকৃত হবে। কাজেই এ বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার।

স্বাস্থ্য খাতের সব শাখায় বিগত ১০ বছরে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে সরকারের মনোযোগ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির ফলে সামগ্রিকভাবে সব স্বাস্থ্যসূচকে বিস্ময়কর উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে জিডিপির শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২, যা ২০০০ সালে ছিল ৬৫.৩। শিশুদের টিকাদানের অর্জন শতকারা ৯৭ ভাগ। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে শতকরা ৬৫ ভাগ মানুষকে; মাতৃমৃত্যুর হার ২০১৭ সালে প্রতি লাখে ১৭২ জন; যা ২০১৫ সালে ছিল ১৭৬ জন; প্রতি ১০০০ জনে নবজাতকের মৃত্যু ২০১৫ সালে ছিল ২০; যা ২০১৭ সালে কমে হয় ১৮.৪। সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নির্মূলেও বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে গত এক দশকে। উচ্ছেদ হয়েছে পোলিও ও ধনুস্টংকার নির্মূলের পথে কালাজ্বর, গোদ রোগ, নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কলেরাসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগ। বর্তমান সরকার স্বাস্থ্য খাতের পাশাপাশি পরিবার

পরিকল্পনা খাতেও বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমেও অনেক সাফল্য এসেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। অবশ্য এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও আন্তরিকভাবে চান চিকিৎসকরা গ্রামে নিজ নিজ কর্মস্থলে থেকে রোগীদের সেবা দেবেন। এখন দরকার চিকিৎসকদের মানসিকতার পরিবর্তন। পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে সব ধরনের দুর্নীতি বা অনিয়ম রোধে কার্যকর পদক্ষেপ।

মনে রাখতে হবে, একটি সুন্দর, উন্নতসমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে মানুষের সুস্বাস্থ্য অপরিহার্য। এ জন্য প্রয়োজন জনগণের স্বাস্থ্যসেবার শতভাগ নিশ্চয়তা। এ লক্ষ্যে সরকারকে আরো বহু দূর এগোতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close