নিতাই চন্দ্র রায়

  ২৪ এপ্রিল, ২০১৯

বিশ্লেষণ

দূষণমুক্ত নদী ও প্রাকৃতিক পরিবেশ

নদীর সঙ্গে বাংলাদেশের নাড়ির সম্পর্ক। নদীকে কেন্দ্র করেই দেশে কৃষি, মৎস্য চাষ, যোগাযোগ, পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। নদীর সঙ্গে এ দেশের শিল্প, সাহিত্য এবং সংস্কৃতিরও রয়েছে আত্মার সম্পর্ক। আগামী ১০ বছরের মধ্যে ঢাকার বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালুসহ চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী দখল-দূষণমুক্ত করে নাব্য ফিরিয়ে আনা হবে। উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে যেমন গ্রাম-গঞ্জের সব মানুষের কাছে উন্নয়নের সুবিধা পৌঁছে দিতে হবে, তেমনিভাবে নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলোকে দূষণমুক্ত করতে হবে। নাব্য ফিরিয়ে আনতে হবে।

আমাদের দেশের শিল্পপতিরা অধিক লাভের আশায় তরল শিল্পবর্জ্য শোধন না করেই সরাসরি নদীতে নিক্ষেপ করছেন। এতে মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। বিনষ্ট হচ্ছে জীবৈচিত্র্য; জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ। ঢাকার চার পাশের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ও ধলেশ্বরী নদী দূষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে শিল্পদূষণ। পলিথিনের অপব্যবহার, পয়ঃবর্জ্য, গৃহস্থালি বর্জ্যও এসব নদী দূষণের জন্য কম দায়ী নয়। তাই যারা শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন তাদের অবশ্যই আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।

লন্ডনের টেমস কিংবা নেদারল্যান্ডসের রাইন নদীতে কি আমাদের দেশের মতো সরাসরি শিল্পবর্জ্য ফেলা হয়? সেখানে কি শিল্প-করাখানা স্থাপন করা হচ্ছে না? নেদারল্যান্ডসে প্রতিটি শিল্প কারখানায় তরল বর্জ্য শোধনের ব্যবস্থা আছে। সেখানকার শিল্পপতিরা এক ফোঁটা তরল বর্জ্যও নদীতে ফেলেন না। আর আমাদের শিল্প-কারখানায় ইটিপি থাকলেও তা ব্যবহার করা হয় না। তাদের অভিমত- ইটিপি ব্যবহারে খরচ বেশি। এর চেয়ে বিনা খরচে তরল শিল্পবর্জ্য প্রাকৃতিক জলাশয়ে ফেলাই অধিক লাভজনক। পরিবেশ অধিদফতরকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য নামমাত্র কিছু তরল বর্জ্য শোধনাগার শিল্প প্রতিষ্ঠানে থাকলেও সেগুলো বন্ধই রাখা হয় সব সময়। শিল্প দূষণের হাত থেকে নদী তথা প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো বাঁচাতে হলে নির্দিষ্ট শিল্পপার্ক বা অর্থনৈতিক অঞ্চল ছাড়া অন্য কোথাও কোনো শিল্প-কারখানা স্থাপন করার অনুমোদন দেওয়া যাবে না। প্রত্যেকটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বা শিল্পপার্কে পরিবেশ অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয়ভাবে বর্জ্য শোধনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। শিল্প-কারখানার বর্জ্য শোধনাগার পরিবেশ অধিদফতরের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের সঙ্গে আধুনিক সফটওয়ারের মাধ্যমে যুক্ত থাকতে হবে। যাতে অর্থনৈতিক অঞ্চলের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারটি ওই অঞ্চলের সব শিল্প-কারাখানার বর্জ্য শোধন কার্যক্রম ২৪ ঘণ্টা মনিটরিং করতে পারে। কোনো শিল্প-কারখানা বর্জ্য শোধন বন্ধ রেখে প্রাকৃতিক জলাশয়ে তরল বর্জ্য ফেলার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতি অঞ্চলের পরিবেশ অধিদফতরের কার্যালয়ে রক্ষিত সাইরেন বেজে উঠবে এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আমরা জানি, পরিবেশের ক্ষতি করে উন্নয়ন করলে, সে উন্নয়ন টেকসই হয় না বরং তা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দৈনন্দিন কাজে পানি ব্যবহারে সবাইকে মৃতব্যয়ী হতে হবে। গোসল, কাপড় ও হাঁড়ি-পাতিল ধোয়া প্রভৃতি কাজে ব্যবহৃত পানিকে শোধন করে পুনরায় ব্যবহার করতে হবে। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে আমাদের দেশের পানি ব্যবস্থাপনা উজানের দেশের ওপর নির্ভরশীল। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তঃসীমান্ত পানি ব্যবস্থাপনার জন্য ১৯৭২ সালে ‘যৌথ নদী কমিশন’ (জেআরসি) গঠন করেন। তারই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন করে। চলতি মেয়াদে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ পুনর্খনন করে নৌচলাচলের উপযোগী করার পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। নৌপথে পণ্য পরিবহনে খরচ কম। যানজটের সমস্যা নেই। দুর্ঘটনাও কম হয়। কৃষিপণ্য সহজে পচে নষ্ট হয় না। বর্তমানে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ২২টি, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং নৌবাহিনীর আওতায় ৪০টি ড্রেজার আছে। আরো ৮০টি ড্রেজার সংগ্রহ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এক জায়গায় বেশি দিন বালুমহাল করা উচিত নয়। বালুমহালগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে করতে হবে, যাতে বালু উত্তোলনে এলাকাটি নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পায়। হাওর-বাঁওড় ও জলাশয় সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৯৯৬ সালে প্রথমবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই ‘জলাধার সংরক্ষণ আইন’ প্রণয়ন করে। এরই মধ্যে সরকার পানি আইন-২০১৩ এবং এর বিধিমালা-২০১৮ প্রণয়ন করেছে, যা বাস্তবায়ন করা একান্ত প্রয়োজন।

রাজধানীর আশপাশের নদ-নদীর জমি দখল করে গড়ে ওঠা স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছে বিআইডব্লিউটিএ। বিআইডব্লিউটিএর এ কার্যক্রমকে আমরা সাধুবাদ জানাই। শীতলক্ষ্যা নদীর সীমানা পিলারের অভ্যন্তরে ও আইন অমান্য করে নদীর সীমানার ১৫০ ফুটের ভেতরে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা সম্প্রতি উচ্ছেদ করা হয়েছে। জানা যায়, উচ্চ আদালতের নির্দেশে জেলা প্রশাসন, ভূমি কর্তৃপক্ষ ও বিআইডব্লিউটিএ যৌথভাবে নদীর সীমানাসংক্রান্ত পুনর্জরিপ ও উচ্ছেদ অভিয়ান পরিচালনা করে। এই অভিযান পরিচালনাকালে কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। নদীর জমি দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা শতভাগ অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।

ত্রিশালের লোকনাথ খাদ্য ভান্ডারের লেবার সর্দার আবু মুসার গ্রামের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সুতিয়া নদী। এ নদীতে একসময় সারা বছর পানি থাকতো। শত শত জেলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আবু মুছা জানান, ধানীখোলা ড্রামের মোড়ের কাছে বহু লোক সুতিয়া নদীর পাড় কেটে বোরো ধানের চাষ করেছে। কেউ কেউ নদীতে পুকুর কেটে করছে মাছের চাষ। কেউ আবার নদীটির পাড় ভরাট করে দোকানপাটও গড়ে তুলেছে। কোনাবাড়িতে সুতিয়া নদীতে করা হয়েছে পানিকচুর চাষ। ত্রিশাল পৌরসভার বৃষ্টির পানি এসে পড়ে সুতিয়া নদীতে। এ নদী ভরাট হয়ে গেলে ত্রিশাল পৌরশহরের সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে। সুপেয় পানির অভাব হবে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাবে। আমি শৈশবে এই সুতিয়া নদীতে সাঁতার কেটেছি। এখন সুতিয়া নদীতে কচুরিপানা আর বোরো ধানের খেত ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। ত্রিশাল পৌর এলাকায় সুতিয়া নদীর দুই তীর দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে দোকানপাট ও ইস্টিকুটুম নামের হোটেল। এ হোটেল থেকে প্রতিদিন নদীতে ফেলা হয় শাকসবজি ও তরিতরকারি অবশিষ্টাংশসহ নানা বর্জ্য। আজ থেকে ৩০ বছর আগে বর্ষাকালে এই নদী দিয়ে পাট বোঝাই নৌকা যেত নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষা নদীতে। এ কথা এখন কেউ বিশ্বাস করবে না।

সুতিয়া পুরাতন বহ্মপুত্রের শাখা নদী। ময়মনসিংহ জেলার ময়মনসিংহ সদর, ত্রিশাল ও গফরগাঁও উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে নদীটি। নদীটি পুরাতন ব্রহ্মপুত্র থেকে উৎপত্তি হয়ে মনতলা, ধানীখোলা ত্রিশালের কোনাবাড়ি হয়ে শিবগঞ্জে খিরো নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে সুতিয়া নামেই টোকের কাছে শীতলক্ষা নদীতে মিশেছে। শুধু ঢাকার আশপাশের নদী নয়, সুতিয়া নদীর মতো সারা দেশে অসংখ্য নদ-নদী মানুষের নিষ্ঠুর কর্মকান্ডের ফলে ভরাট হয়ে গেছে। মরে গেছে নদীর প্রাণপ্রবাহ। ব্যবহারে অযোগ্য হয়ে গেছে পানি। মাছও জলজপ্রাণী মারা গেছে। এসব নদীর দখল করা জায়গা উদ্ধার করে এবং নদীর তলদেশ ড্রেজিং করে মৃত, প্রাণহীন নদীগুলোকে আবার জীবন্ত করে তুলতে হবে। যারা নদীর পাড় কেটে বোরো ধানের চাষ করছে, দোকানপাটও বাড়িঘর নির্মাণ করে নদী হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর নদী দখলের মতো দুষ্কর্ম করার সাহস না পায়। সাহস না পায় নদীতে বর্জ্য ফেলার।

হাইকোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে নদীর অভিভাবকত্ব প্রদান করেছে। হাইকোর্টের ওই রায়ের আলোকে নদ-নদীসহ সব জলাশয়কে দখলও দূষণমুক্ত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ আবার ফিরে পাবে তার হারানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও নদ-নদীগুলোর অপরূপ নিসর্গÑ এটাই পরিবেশবাদী সচেতন ও নদীপ্রেমিক মানুষের প্রত্যাশা।

লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড, নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close