আহমদ আবদুল্লাহ

  ২১ এপ্রিল, ২০১৯

বিশ্লেষণ

মুক্তির পয়গাম শবেবরাত

শাবান আরবি মাসগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি মাস। প্রিয়নবী (সা.) এ মাসকে অত্যধিক গুরুত্ব দিতেন। ইসলামের বুনিয়াদ রোজা পালনের মাস মাহে রমজানের পূর্ববর্তী মাস যেহেতু এই শাবান মাস, তাই এ মাসটি হলো পবিত্র রমজান মাসে একাগ্রচিত্তে সিয়াম-সাধনা ও অধ্যবসায়ের প্রস্তুতি গ্রহণের মাস। শাবান মাসের বরকত ও ফজিলত অনেক। এর অন্যতম কারণ হলো, এ মাসের ১৪তম তারিখ দিবাগত রাতেই হয়ে থাকে বিশ্বসৃষ্টির মুক্তি ও ভাগ্য নির্ধারণের বিশেষ ও বরকতপূর্ণ রজনি শবেবরাত বা লাইলাতুল বরাত। এ রাতের ফজিলত সম্পর্কে এবং ইবাদতের ব্যাপারে নির্দেশ দিয়ে রাসুল (সা.) বলেন, যখন শাবান মাসের অর্ধেকের রজনি আসে (শবেবরাত) তখন তোমরা রাতে নামাজ পড়, আর দিনের বেলা রোজা রাখ। নিশ্চয় আল্লাহ এ রাতে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর আসমানে এসে বলেন, কোনো গোনাহ ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি আমার কাছে? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো রিজিকপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দেব। কোনো বিপদগ্রস্ত মুক্তি পেতে চায় কি? আমি তাকে বিপদমুক্ত করে দেব। আছে কি এমন, আছে কি তেমন? এমন বলতে থাকেন ফজর পর্যন্ত। (ইবনে মাজাহ : ১৩৮৮)।

এই রাতে ইবাদত-বন্দেগি করা নির্ভরযোগ্য হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। তাই রাসুল (সা.) ও সাহাবা-তাবেয়িনের যুগ থেকে অদ্যবধি এ রাতে বিশেষভাবে নফল ইবাদত ধারাবাহিকতার সঙ্গে চলে আসছে। হজরত আয়শা (রা.) বলেন, একরাতে রাসুল (সা.) কে না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে জান্নাতুল বাকিতে গিয়ে আমি তাঁকে দেখতে পেলাম। তিনি বললেন, কি ব্যাপার আয়শা? তুমি যে তালাশে বের হলে? তোমার কি মনে হয় আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল তোমার ওপর কোনো অবিচার করবেন? তোমার পাওনা রাতে অন্য কোনো বিবির ঘরে গিয়ে রাত্রিযাপন করবেন? হজরত আয়শা (রা.) বললেন, আমার ধারণা হয়েছিল আপনি অন্য কোনো বিবির ঘরে গেছেন। রাসুল (সা.) তখন বললেন, যখন শাবান মাসের ১৫তম রাত আসে অর্থাৎ যখন শবেবরাত হয়, তখন আল্লাহ পাক এ রাতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। তারপর বনু কালব গোত্রের বকরির পশমের চেয়ে বেশি সংখ্যক বান্দাদের ক্ষমা করে দেন। (সুনানে তিরমিজি : ৭৩৯)।

এ মাস এলে প্রিয়নবী (সা.) স্বীয় আমলের পরিমাপ স্বাভাবিক অবস্থা থেকে অধিক বাড়িয়ে দিতেন। উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) রাতে নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সেজদা করলেন যে, আমার আশঙ্কা হলো, তাঁর হয়তো ইন্তেকাল হয়ে গেছে। আমি তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা! অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা! তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসুলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। নবীজি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন। তিনি তখন বললেন, এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত। (শাবানের ১৪ তারিখের দিবাগত রাত)। আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি প্রদান করেন, ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই। (বায়হাকি ৩/৩৮২,৩৮৩)। উপরোক্ত হাদিস থেকে এ রাতের ফজিলত যেমন জানা যায় তদ্রƒপ এ রাতের আমল কেমন হওয়া উচিত তা-ও বোঝা যায়।

লাইলাতুল বরাত পরিচিতি : হাদিসে এ রাতকে বলা হয়েছে, ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান বা শাবানের অর্ধ মাসের রাত। আবার কোথাও বলা হয়েছে লাইলাতুল বরাত বা মুক্তির রজনি। হজরত জালালুদ্দিন মহল্লি (রাহ.) এ রাতের আরো দুটি নামের কথা উল্লেখ করেছেন এভাবে ক. লাইলাতুল রাহমাত বা করুণার রাত। খ. ‘লাইলাতুস সাফ বা চুক্তিনামার রাত। (জালালাইল : ২/৪১০)। কেননা, এ রজনীতে সমগ্র সৃষ্টির প্রতি পরম দয়াময়ের পক্ষ হতে তার অপার করুণার বান বয়ে যায় এবং মানুষের জীবন-মরণ ইত্যাদি অন্যান্য বিষয়ে অজস্র চুক্তিনামা বা দলিলাদি স্বাক্ষরিত হয়। এ রাতকে শাফাায়াতের রাতও বলা হয়। লাইলাতুল বরাত অধিক মর্যাদাপূর্ণ রাত। এ রাতে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অনেক বরকত নাজিল হয়। অসংখ্য নেকি দান করা হয়। অনুগ্রহ ও দয়ার ভা-ার খুলে দেওয়া হয়। গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হয়। বিশেষ করে এ রাত গুনাহের কাফফারা হিসেবে পরিগণিত হয়।

শবে বরাতের উদ্দেশ্য : মহান রাব্বুল আলামিন মানবজাতিকে সৃষ্টি করে পৃথিবীতে অবস্থানকালীন কীভাবে চলতে হবে এবং কী কী আমল করতে হবে এবং কোন কোন কাজ পরিহার করতে হবে তা পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন। তবুও মানুষ শয়তানের ধোঁকায় পড়ে অনেক পাপ করে থাকে। আল্লাহ বড়ই দয়ালু। তিনি চান অপরাধ করার পর বান্দাদের একটি সুযোগ দিতে, যাতে তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তার কাছে তাওবা করে। তাই তারা যদি এই রাতে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে তিনি ক্ষমা করে দেবেন। আর এ জন্য রাতটি ক্ষমা প্রার্থনার রাত। সুতরাং পাপি পারে এ রাতে ক্ষমা চেয়ে নিতে মহান রাব্বুল আলামিনের কাছ থেকে।

শবে বরাতে করণীয় : প্রথমে গোসল করে নেওয়া মুস্তহাব। তবে রাত আগমণের আগেই আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন থাকলে তা ঠিক করে নিতে হবে। কারো হক থাকলে তা আদায় করে দিতে হবে। অন্তরকে কলুষমুক্ত করে নিতে হবে। হজরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোজা রাখ। কেননা এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিজিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিজিক দেব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদের ডাকতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ : ১৩৮৪)। তবে এ ক্ষেত্রে এই বিষয়টিও মনে রাখতে হবে যে, এ রাতের নফল আমলগুলো, বিশুদ্ধ মতানুসারে একাকীভাবে করণীয়। ফরজ নামাজতো অবশ্যই মসজিদে আদায় করতে হবে। এরপর যা কিছু নফল পড়ার তা নিজ নিজ ঘরে একাকী পড়বে। এসব নফল আমলের জন্য দলে দলে মসজিদে এসে সমবেত হওয়ার কোনো প্রমাণ হাদিস শরিফেও নেই আর সাহাবায়ে কেরামের যুগেও এর রেওয়াজ ছিল না। (মারাকিল ফালাহ-২১৯)।

শবেবরাতে বর্জনীয় : দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শবেবরাত একটি পুণ্যময় রজনি হওয়া সত্ত্বেও নানা পারিপার্শ্বিক কারণে তাতে এমন কিছু কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে, যা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। অন্যথায় এসব কার্যাবলি আমাদের ইহ ও পরকালের জীবনে কল্যাণ ও মুক্তির পরিবর্তে অকল্যাণ ও বিপদ বয়ে আনবে।

যেমন : ১. আতশবাজি। ২. হালুয়া-রুটির বিশেষ আয়োজন। ৩. প্রয়োজনাতিরিক্ত আলোকসজ্জা। ৪. মাজারে বা গোরস্তানে মেলা উৎসব করা। ৫. একাগ্রতার প্রতি লক্ষ্য না দিয়ে ইবাদত ইত্যাদিতে বাহ্যিক জাঁকজমকের দ্বারা অনুষ্ঠানসর্বস্ব করে তোলা। ৬. হা-ি-বাসন বদলানো। ৭. গলিকুচায়, শহরে-বন্দরে ঘোরাফেরা ও হই-হল্লা করা ইত্যাদি।

শবেবরাতে ক্ষমার অযোগ্য যারা : এ রাতে দয়াময় আল্লাহ অসংখ্য মানুষের অপরাধ ক্ষমা দিলেও খাঁটি অন্তরে তওবা না করা পর্যন্ত নিম্নœবর্ণিত অপরাধীদের ক্ষমা করবেন না বলে কোরআন ও হাদিসে উল্লেখ রয়েছে।

১. মুশরিক, ২. জাদুকর, ৩. গণক, ৪. হিংসুক, ৫. গায়ক-গায়িকা, ৬. যারা বাদ্যযন্ত্র বাজায় ও বানায়, ৭. রেখা টেনে ফালনামা দেখে ভাগ্য ভবিষ্যৎ নির্ধারণকারী, ৮. আত্মীয়তা ছিন্নকারী, ৯. পরস্পর শত্রুতা পোষণকারী, ১০. জালেম শাসক ও তার সহযোগী, ১১. মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয়কারী, ১২. পায়ের গিরার নিচে গর্বসহকারে জামা পরিধানকারী, ১৩. মদ্যপ, ১৪. পরস্ত্রীগামী, ১৫. মা-বাবার অবাধ্য সন্তান, ১৬. কৃপণ, ১৭. পরনিন্দাকারী, ১৮. অন্যায়ভাবে শুল্ক আদায়কারী। এছাড়া আরো অনেক অপরাধীর কথা বর্ণিত হয়েছে। যার সব কটি গুনাহে কবিরা। শবেবরাত ও শবেকদরের বরকতে সগিরা গুনাহ মাফ হয় বটে তবে গুনাহ থেকে ক্ষমা পেতে হলে খাঁটি মনে তাওবা করা আবশ্যক।

এ বরকতময় রাতে যেন আমরা আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতে পারি, কোরআন তিলাওয়াত করতে পারি, দেশ-জাতি ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য দোয়া করতে পারি, আল্লাহ আমাদের সে তাওফিক দান করুন। আমিন!

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close