নিতাই চন্দ্র রায়

  ২০ এপ্রিল, ২০১৯

পর্যালোচনা

বিল্ডিং কোডের যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি

অগ্নিদুর্ঘটনা পিছু ছাড়ছে না রাজধানী ঢাকার। মাত্র ৩৭ দিনের ব্যবধানে রাজধানী ঢাকায় ঘটল আরেকটি বিভীষিকাময় আগ্নিকান্ড। গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার আগুন কেড়ে নেয় ৭১ জনের প্রাণ। সেই শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ২৮ মার্চ বৃহস্পতিবার রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে আকাশচুম্বী ফারুক রূপায়ণ (এফ আর) টাওয়ারের অগ্নিকান্ড আবার কেড়ে নিল এক বিদেশি নাগরিকসহ ২৫ জনের জীবন। অগ্নিকান্ডে দগ্ধ হয়েছে আরো ৭০ জন। হতভাগাদের কারো মৃত্যু হয়েছে আগুনে পুড়ে, কারো মৃত্যু হয়েছে ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আবার কারো মৃত্যু হয়েছে বাঁচার জন্য ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে। দুর্ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। অগ্নিদুর্ঘটনাসহ সার্বিক নিরাপত্তা বিষয়ে ভবন মালিক ও ব্যবসায়ীদের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

বনানীর অগ্নিদগ্ধ ভবনটির মালিক ১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে ২৩ তলা নির্মাণ করেন। একটি বহুতল বাণিজ্যিক ভবনে যে পরিমাণ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা প্রয়োজন, তা পুরোপুরি ছিল না এফ আর টাওয়ারে। তবে দু-একটা ফ্লোরে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকলেও সেগুলো ছিল অকেজো। ভবনটিতে যদি অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকত এবং জরুরি সিঁড়ি থাকত, তা হলে এত হতাহতের ঘটনা ঘটত না। গত জানুয়ারি মাসেও এ ভবন কর্র্র্তৃপক্ষকে নোটিস দিয়ে ছিল ফায়ার সার্ভিস, কিন্তু তারা কোনো সাড়া দেয়নি। শুধু এফ আর টাওয়ারই নয়, ঢাকা মহানগরীর অন্তত ১১ হাজার বহুতল ভবন এখন অগ্নিকান্ডের ঝুঁকিতে। এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকান্ডকে ‘হত্যাকান্ড’ হিসেবে আখ্যায়িত করে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, বহুতল ভবনে অগ্নিকান্ড প্রতিরোধ-সংক্রান্ত সুপারিশ যারা বাস্তবায়ন করেননি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার। মনে হয়েছে এটা দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকান্ড। এ ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবু নাঈম মো. শহিদুল্লার কথা হলোÑ বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড মেনে বিল্ডিং করা হয়নি। একই সঙ্গে নিয়মিত ফায়ার ডিল করার নিয়ম থাকলেও তা পালন করা হয়নি। আবার ফায়ার ডোরও ছিল না। এসব কারণেই অগ্নিকান্ডে এমন হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। বিএনবিসি কোড অনুযায়ী হাইরাইজ বিল্ডিং বানানোর ক্ষেত্রে প্রতি পাঁচ তলার ওপরে একটি করে নিরাপদ এলাকা করা হলে মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঁচু ভবন থেকে লাফিয়ে পড়তে হতো না। কেউ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ছোটাছুটি করতেন না। ফায়ার সার্ভিসের উদ্বারকারী দল সহজেই উদ্বার করতে পারত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিটি উঁচু ভবনে প্রতি পাঁচ তলার ওপরে নিরাপদ এলাকা থাকে। ভবনে আগুন লাগলে ভবনের বাসিন্দারা ওই এরিয়ায় গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানে আগুন তো দূরের কথা, ধোঁয়াও প্রবেশ করতে পারে না। ফলে মানুষ মারা যায় না।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় ৯০ হাজার অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২ হাজার ৯৭৮ জন; এতে ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক ২ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। শুধু ২০১৮ সালে ১৯ হাজার ৬৪২টি অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ক্ষতি হয়েছে ৩৮৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে ১৩০ জনের। ২০১৮ সালে কেবল ঢাকা বিভাগেই ৬ হাজার ২০৮টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে।

কোনো বিল্ডিংকে যেকোনো ঝুঁকি সহনীয় করে গড়ে তুলতে বিল্ডিং কোডের প্রয়োগ করা হয়। ১৯৯৩ সালে হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউশনের মাধ্যমে সব পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ বিল্ডিং কোড প্রণীত হয়, যা মাঠপর্যায়ে প্রয়োগের জন্য ২০০৬ সালে আইনগত ভিত্তি পায়। কিন্তু বিল্ডিং কোড প্রয়োগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অদ্যবধি কোনো প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। বড় বড় শহরের পাশাপাশি উপজেলা শহর এমনকি গ্রামাঞ্চলের হাটবাজারে এখন উঁচু ভবন নির্মিত হচ্ছে। ছোট শহর তো দূরের কথা রাজধানী ঢাকা শহরেই বিল্ডিং কোডের নিয়মকানুন মানা হচ্ছে না। জাতীয় বিল্ডিং কোড তথা ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় বলা হচ্ছে, ৭ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের সময় ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদফতর, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিভাগের ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। এর চেয়ে উঁচু ভবনের ক্ষেত্রে এসবের সঙ্গে ফায়ার ডিটেক্টর, স্মোক ডিটেকটর, উচ্চগতির পানি স্প্রে সিস্টেম ও কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন সিস্টেম থাকাও বাধ্যতামূলক। কিন্তু রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন নগরীর বেশির ভাগ ভবন নির্মাণে এসবের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না।

২০০৬ সালে ফিনিক্স ভবন ধসের পর তৎকালীন সংসদে একটি আইন পাস হয়েছিল। ওই আইনে বলা আছে, যদি কেউ জাতীয় বিল্ডিং কোডের অংশবিশেষও সঠিকভাবে মানতে ব্যর্থ হন, তা হলে তিনি কমপক্ষে ৭ (সাত) বছরের জেল অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন । এমন একটি কঠিন আইন প্রণয়নের ১২ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও রাজধানীতে এ ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটা বাঞ্ছনীয় নয়। বিল্ডিং কোডের হালনাগাদের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০০৬ সালে। হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউশন জাতীয় বিল্ডিং কোড হালনাগাদের খসড়া তৈরির করে। কিন্তু এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি। হালনাগাদ কোডের খসড়ায় ৫ সদস্যের একটি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা হলেও তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। নগরের বিভিন্ন সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতাও জাতীয় বিল্ডিং কোড বাস্তবায়নের অন্তরায়। বিদেশে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসসহ সব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান মেয়রের নিয়ন্ত্রণে থাকে। প্রয়োজনে দেশের সব নগরে একরূপ নগর সরকার গঠন করে নগরের সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নগর সরকারের এক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে হবে।

উন্নত দেশগুলোতে আবাসিক ও বাণিজ্যিক দুই ধরনের ভবন নির্মাণেই আগুন নেভানোর সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। এ ব্যবস্থাকে বলা হয় অগ্নিনিরাপত্তা ও অগ্নিব্যবস্থাপনা। বহুতল ভবনে এসব ব্যবস্থা ছাড়া ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ভবন নির্মাণ ও ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। দুভাগ্যক্রমে যদি আগুন লেগেই যায়, তা হলে তা আগে থেকে টের পেতে ব্যবহার করা হয় ফায়ার অ্যালার্ম, স্মোক ডিটেকটর ও টেমপারেচার ক্যাপচার। এ প্রযুক্তিগুলো ঘরের সিলিংয়ের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। কোনো কারণে দালানে আগুন লাগলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঘরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এটি জানান দেয় ফায়ার অ্যালার্ম ও টেমপারেচার ক্যাপচার। আগুন লাগলেই পুরো দালানে অ্যালার্ম বেজে ওঠে। মানুষ নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ পায়। ব্যবহার করা হয় স্মোক ডিটেকটর। ঘরে ধোঁয়ার অস্তিত্ব টের পেলেই এটি সচল হয়ে যায়। এসব প্রযুক্তি সঙ্গে যুক্ত থাকে ওয়াটার স্প্রিঙ্কলার ও ফায়ার সাপ্রেশনার। দালানে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গেই এগুলো চালু হয়ে যায় এবং তীব্র বেগে পানি ও আগুন নেভানোর বিশেষ রাসায়নিক ঝরতে শুরু করে। এতে আগুন দ্রুত নিভে যায়। আগুন পুরোপুরি না নিভলেও পানি ও বিশেষ রাসায়নিক ফোম আগুনকে ছড়াতে দেয় না। এসব স্প্রিঙ্কলার চালু রাখতে দালানে রাখা হয় বিশেষ রিজার্ভ পানির ট্যাংক। মোটর দিয়ে এ ট্যাংক থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি উঠে এসে আগুন নেভাতে শুরু করে। বিদ্যুৎ না থাকলেও যেন এসব মোটর এক মুহূর্ত বন্ধ না থাকে, সেজন্য থাকে জেনারেটরের ব্যবস্থা। এ ছাড়া প্রতিটি ভবনে বিশেষ দরজা বা বেরোনোর পথ থাকে। আগুন লাগলেই ভবনের ভেতরের মানুষ এসব দরোজা দিয়ে দ্রুত বের হয়ে যেতে পারে। থাকে গ্রিল ছাড়া বিশেষ জানালা। জরুরি প্রয়োজনে এসব জানালা ভেঙে ভেতরে মানুষ যেমন বেরিয়ে আসতে পারে, তেমনি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাও এ পথে দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। দেয়ালে দেয়ালে থাকে প্রয়োজনীয়সংখ্যক অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র; যাতে ছোটখাটো আগুন লাগলে শুরুতেই নেভানো যায় বা আগুন ছড়ানোর মাত্রা কমিয়ে রাখা যায়। বহুতল ভবনের দালানের বাইরে থাকে বিশেষ ধরনের সিঁড়ি। কোনো কারণে ভবনের ভেতরের সিঁড়ি ধোঁয়া বা আগুনে বন্ধ হয়ে গেলে, তখন এই সিঁড়ি ব্যবহার করে সহজেই মানুষ বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। আমাদের দেশেও অনুরূপ অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।

অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি কমাতে ২০০৩ সালে অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ নামে একটি আইন প্রণয়ন করে সরকার। এ আইন অনুযায়ী ঢাকা মহানগরে বহুতল ভবন নির্মাণে ফায়ার সার্ভিস থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। মূলত ভবনের সামনে সড়কের প্রশস্ততা, নকশা অনুসারে ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা, ভবন থেকে বের হওয়ার বিকল্প পথ, কাছাকাছি পানির সংস্থান, গাড়ি ঢুকতে পারবে কি নাÑ এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে ছাড়পত্র দেয় ফায়ার সার্ভিস। তারপরই এ ছাড়পত্র দেখিয়ে রাজউক থেকে ভবনের নকশার অনুমোদন নিতে হয়। এরপর ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করতে হয়। নির্মাণকাজ আংশিক বা পুরোপুরি শেষ হওয়ার পর ভবনটি ব্যবহারের জন্য রাজউকের কাছ থেকে বসবাস বা ব্যবহারের সনদ নিতে হয়। এ সনদ দেওয়ার সময় নকশা অনুযায়ী ভবনটি নির্মিত হয়েছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব রাজউকের। কিন্তু এ ব্যাপারে রাজউকের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ দৃশ্যমান নয়। এজন্যই জাতীয় নির্মাণবিধি অমান্য করেই ঢাকা মহানগরীতে গড়ে উঠছে ব্যাঙের ছাতার মতো বহুতল ভবন নামের মৃত্যুকূপ। শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, ময়মনসিংহের মতো বিভাগীয় শহরেও গড়ে উঠছে অসংখ্য বহুতল ভবন। এসব ভবনে কতটুকু ভূমিকম্প ও অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলার ব্যবস্থা আছে, তা আমাদের জানা নেই। তবে বনানীর মতো অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে তার পরিণতি ঢাকার চেয়েও যে ভয়াবহ হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই ঢাকাসহ দেশের সব নগরে বিল্ডিং কোর্ডের নিয়মকানুন যথাযথভাবে অনুসরণ করেই যাতে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় এসব দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো পথ আমাদের সামনে খোলা নেই। খোলা নেই ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরের স্বপ্ন পূরণের পথ।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড, নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close