সাধন সরকার

  ১৩ এপ্রিল, ২০১৯

মুক্তমত

রাজধানীতে বাড়ছে উত্তাপ

আশি-নব্বইয়ের দশকের ঢাকার সঙ্গে এখনকার ঢাকার পার্থক্য অনেক। জনসংখ্যা বেড়েছে, মেগাসিটির তকমা পেয়েছে ঢাকা। বাস্তবতা হলো, পরিকল্পিত উন্নয়নের চেয়ে এখন অপরিকল্পিত উন্নয়নের খেসারত গুনতে হচ্ছে এ মহানগরকে। পরিবেশের বিভিন্ন সূচকে ঢাকার অবস্থান বিশে^র পেছনের সারির শহরগুলোর একটি। রাজধানীতে সবুজের আচ্ছাদন বছরের পর বছর কমছে! বাড়ছে দূষণের মাত্রা। শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ ও পানিদূষণের কারণে রাজধানীবাসীর প্রতিনিয়ত ভুগতে হচ্ছে। নির্দিষ্ট কয়েকটি পার্ক-উদ্যান বাদ দিলে রাজধানীতে সবুজের সমারোহ আর দেখাই যায় না! যতদূর চোখ যায় ইট-কাঠ-পাথরে মোড়া কংক্রিটের এক নগরী। ঢাকায় মানুষ আর মানুষ। অপরিকল্পিত নগরায়ণের প্রভাব পড়েছে সবখানে। এক তথ্যমতে, ১৯৮৮ সালে ঢাকা শহরের মোট আয়তনের প্রায় ৩৩ শতাংশ গাছপালায় আবৃত ছিল। ১৯৯৮ সালে তা ২৯ শতাংশে দাঁড়ায়। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ণের ফলে ২০০৮ সালে রাজধানীতে মোট আয়তনের মধ্যে সবুজের সমারোহ কমে দাঁড়ায় প্রায় ২৮ শতাংশ। ২০১৮ সালে সবুজের আচ্ছাদন নেমে এসেছে প্রায় ২২ শতাংশে।

ছোট্ট এই রাজধানী শহর নিয়ে শুধু পরিকল্পনা হয়েছে, কিন্তু সে পরিকল্পনা কাজে লাগানো যায়নি! খাল-জলাশয় ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে সুউচ্চ ভবন। চারপাশের নদ-নদীগুলোও দখল-দূষণে জর্জরিত। বিশে^র বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার স্থান প্রথম দিকে। লোভ ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ছাপ পড়েছে পার্ক-উদ্যান ও ভূমির ওপর। ফলে নগরের জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সার্বিক বাস্তুসংস্থানসহ প্রাকৃতিক পরিবেশের কাঠামো বদলে গেছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরে উত্তপ্ত এলাকার সংখ্যা বাড়ছে। গ্রীষ্ম বা শীত উভয় সময়েও ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় তাপমাত্রার ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ করা যাচ্ছে। বিভিন্ন অজুহাতে শহরের মধ্যে ‘এক টুকরো সবুজ’ বলে খ্যাত ‘সড়কদ্বীপ’গুলো ধ্বংস করা হচ্ছে! বিভিন্ন উন্নয়নের কারণে প্রতি বছরই গাছপালা কাটা পড়ছে। পার্ক-উদ্যানগুলোতেও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে গাছপালা কমে যাচ্ছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, একটি শহরে প্রত্যেক নাগরিকের সুস্থতার জন্য কমপক্ষে ৯ বর্গমিটার সবুজের আচ্ছাদন থাকা প্রয়োজন, যা ঢাকায় রয়েছে মাত্র ২ বর্গমিটার। রাজধানীতে সবুজের সমারোহ কমার পাশাপাশি বাড়ছে বায়ুদূষণ। বিশে^র রাজধানী শহরগুলোর মধ্যে বায়ুদূষণের দিক দিয়ে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। এ শহরে বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম ২.৫) ‘বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার’ বেঁধে দেওয়া মানের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। বায়ুদূষণের কারণে নগরবাসীর মধ্যে হৃদরোগ, শ^াসকষ্টজনিত জটিল সমস্যা, ফুসফুসে সংক্রমণ ও ক্যানসারের মতো জটিল রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ছে। বাসযোগ্য ঢাকা শহরের পরিবেশ রক্ষা ও প্রত্যেক নাগরিকের সুস্থতায় সবুজের সমারোহ বাড়াতে সবার আগে দরকার পরিকল্পনা। শুধু পরিকল্পনা করলেই হবে না, তা বাস্তবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে সবাইকে সচেতন হতে হবে। এককথায়, ঢাকা শহরে সবুজের সমারোহ না বাড়ানো গেলে এ শহরে টিকে থাকা কঠিন হবে। ধীরে ধীরে কংক্রিটের জঞ্জালে পরিণত হবে ঢাকা!

তাই যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে নদী ও খালগুলো রক্ষা করা গেলে শহরের বাসিন্দাদের বিনোদনের চাহিদা মেটানো যেমন সম্ভব; তেমনি এ শহরটাকে আধুনিক, বসবাসযোগ্য, পরিবেশবান্ধব ও জলসবুজে আকর্ষণীয় হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে। তাই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে চারপাশের নদ-নদী ও খালগুলো দখল-দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। নদ-নদী ও খালকেন্দ্রিক প্রাকৃতিক জলাধারগুলো ঘিরে সবুজের সমারোহ তৈরি করতে হবে। নদী-খালগুলো রক্ষা করে এর দুপাশ দিয়ে সারিবদ্ধভাবে গাছ লাগাতে হবে। তা হলে ধীরে ধীরে এগুলো জলসবুজে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। পাশাপাশি শহরের ফাঁকা জায়গাগুলোতে জোন বা সেক্টরভিত্তিক পার্ক, উদ্যান ও বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। শহরের রাস্তার মোড়ের ফাঁকা জায়গাগুলোতে সড়কদ্বীপ, ছোট পার্ক ও উদ্যান তৈরির উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে ভালো সমাধান হতে পারে। ঢাকা শহরের সবুজায়ন বৃদ্ধিতে ‘ছাদবাগান’ও (বাড়ির ছাদে, কার্নিশে, বারান্দায়, চিলেকোঠায়, জানালার পাশে, সিঁড়ির কিনারায় প্রয়োজনীয় গাছ লাগানো) ভালো কাজ দেবে। এ ছাড়া ব্যস্ত সড়কের ডিভাইডার অংশে ও ফ্লাইওভারের নিচে ফেলে রাখা ফাঁকা জায়গাগুলোতে সৌন্দর্য বাড়াতে ও সবুজায়ন করতে পরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এতে করে ঢাকা শহরের সবুজায়ন যেমন বৃদ্ধি পাবে; তেমনি বিনোদনপ্রত্যাশী মানুষের বিনোদনের চাহিদাও মিটবে। ঢাকা শহরকে বাঁচাতে হলে এবং বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হলে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটি প্রয়োজন, তা হলো এর সবুজায়ন। নান্দনিক ও সবুজ ঢাকা গড়তে আমাদের ঋতুভিত্তিক বৃক্ষ রোপণের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে নার্সারি প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় ও বায়ুদূষণ রোধে রাজধানী ঢাকাকে বাসযোগ্য সবুজ নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে সবার নিজ নিজ অবস্থান থেকে উদ্যোগের পাশাপাশি সচেতনতাও জরুরি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close