মো. ওসমান গনি

  ১২ এপ্রিল, ২০১৯

মতামত

হারিয়ে যাচ্ছে ঋতুবৈচিত্র্য

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের ঋতুচক্র ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে অসময়ে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। আবার ভরা মৌসুমে বৃষ্টির দেখা পাওয়া ভার। শীতও প্রচলিত সময়ের নিয়ম মানছে না। আর এর প্রভাব পড়ছে কৃষি অর্থনীতিসহ পুরো জীবনযাত্রায়। বাংলাদেশকে বলা হয় ষড়ঋতুর দেশ। এখন আর সেই ঋতুবৈচিত্র্য নেই বললেই চলে। ঋতুবৈচিত্র্যের এই বদলে যাওয়ার জন্য আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরাও দায়ী করছেন জলবায়ু পরিবর্তনকে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন বৃষ্টি, খরা, বন্যা, শীত, গ্রীষ্মের জন্য ঋতুর অপেক্ষার দরকার হয় না।

বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঋতু অনুযায়ী বর্ষা কিংবা শীত শুরু না হওয়ায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এখন বৃষ্টির দিন না হলেও কয়েক দিন ধরে ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মধ্যে শিলাও পড়ছে। এতে ধানসহ সব ধরনের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবনযাত্রার ওপর। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে কৃষিকাজে। ঋতুচক্রে ওলট-পালটে সর্বনাশ দেখছেন কৃষক। পরিবেশ বিবর্তনে তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি। ৫০-৬০ বছর পর যখন তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি বাড়বে; তখন ক্ষতিটা আরো বেশি হবে। ছয় ঋতুর দেশে এখন ঋতু দেখা যাচ্ছে চারটি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। যে কারণে নিয়ম মেনে বৃষ্টি হচ্ছে না। এখন চৈত্র মাস মাঝে মধ্যে দু-এক দিন বৃষ্টি হওয়া ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু কয়েক দিন ধরে দেখা যাচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে। এটা স্বাভাবিক নয়। এটা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এভাবে প্রতিদিন বৃষ্টি হলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হবে। এখন বোরো ধান পাকার সময় হচ্ছে। ১৫ এপ্রিলের দিকে ধান পাকবে। এ সময় যদি এভাবে বৃষ্টি হয়, তা হলে বোরোচাষিরা অবিশ্বাস্য ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। একই সঙ্গে আমসহ অন্যান্য কৃষিরও ব্যাপক ক্ষতি হবে।

জানা গেছে, নানা প্রতিকূলতার পর এবারও বোরো ধানের বাম্পার ফলনের প্রত্যাশা করেছিলেন কৃষকরা। কিন্তু মৌসুম শুরুর আগেই বজ্রপাত, বৃষ্টি ও শীলাবৃষ্টিতে আগাম বন্যার মহাহুমকিতে পড়েছেন হাওর পাড়ের বোরোচাষিরা। এ নিয়ে বাড়ছে দুশ্চিন্তাও। কারণ ২০১৭ সালের ভয়াবহ বন্যার দুঃসহ স্মৃতি তাদের এখনো তাড়ায়। ওই সময়ে বাম্পার ফলনের বোরো ধানের সঙ্গে মাছ, হাঁস, জলজপ্রাণী ও উদ্ভিদ কেড়ে নিয়েছিল আকস্মিক বন্যা ও দীর্ঘ জলাবদ্ধতা। ওই অকাল বন্যায় ঘরবাড়ি আর কৃষিখেতসহ সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিলেন তারা। তাই বোরো ধানের বাম্পার ফলন হলেই চাষিদের মনে জাগে নানা অজানা শঙ্কা। গত কয়েক দিনের আগাম বৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন হাওরের কৃষকরা। হাওরের সঙ্গে সংযুক্ত নদ-নদী, খালগুলোতে বাড়ছে পানি। এ রকম বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে আগাম বন্যার শঙ্কা করছেন তারা। হাওরের কৃষকদের মতে, ভারী বর্ষণ ও শিলাবৃষ্টিতে থোড়ওয়ালা ও আধাপাকা বোরো ধানেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আর অল্প কদিনের মধ্যেই কাটা শুরু হবে বোরো ধান। ২৮ ও গাজী ধানের ছড়ায় পচন রোগের প্রাদুর্ভাবের পরও ফলন ভালোর আশা করলেও বৃষ্টি, বন্যা ও বজ্রপাত মোকাবিলা করে তা গোলা পর্যন্ত তোলা নিয়ে তারা এখন চরম শঙ্কায়। এদিকে উপর্যুপরি শিলাবৃষ্টিতে আমের ব্যাপক ক্ষতির শঙ্কা করছেন উত্তরবঙ্গের আমচাষিরা।

কেন জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ? আমরা মোটেও পরিবেশ সচেতন নই। যারা দেশের পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বে আছেন, তারাও আশানুরূপ কিছু করছেন তা দৃশ্যমান নয়। তাই বাংলাদেশের পরিবেশ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। দিন দিন যেভাবে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে তাতে আমরা সত্যিই শঙ্কিত ও হুমকির সম্মুখীন। জলবায়ুও ভয়ংকরভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ ঝুঁকির মধ্যে থাকা বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জেলাগুলোর ১৩ কোটি ৩৪ লাখ মানুষের মাথাপিছু জিডিপি ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ হ্রাস পাবে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি মনে করছে, এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৭১ বিলিয়ন ডলার। তথ্য অনুযায়ী, ঝুঁকির শীর্ষে থাকা ১০ জেলা হলোÑ কক্সবাজার, বান্দরবান, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, নোয়াখালী, ফেনী, খাগড়াছড়ি, বরগুনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা। এর মধ্যে বেশি ঝুঁকির মুখে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের মানুষ। পরিবেশ নিয়ে ভাবনাটা আমাদের দেশে হয় না বললেই চলে। অন্য দেশের কার্বনের ভারে আমরা নতজানু। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ। এখানে কার্বন নিঃসরণের যে মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে কম পরিমাণে কার্বন নির্গত হয়। আবার আমাদের দেশে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। সুন্দর বনের গাছ, লতাগুল্ম, বনের মাটির প্রকৃতি, গাছপালার পরিমাণ প্রভৃতি হিসাব করে দেখা যায়, এই বনের কার্বন শোষণের ক্ষমতা রয়েছে অত্যাধিক। এর পরও আমরা উন্নত বিশ্বের নির্গত কার্বনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। বন্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে হিমালয়ের বরফগলা পানিসহ উজানের নেপাল ও ভারতের বৃষ্টিপাতের পানি, বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদী হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। এভাবে দেখা যায়, প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১০৯৪ মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং ১৫ লাখ হেক্টর চাষের জমি বন্যা ও জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন এ দেশের কৃষি খাতে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। মৌসুমি বৃষ্টিপাত এবং নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার কারণে এ দেশের প্রধান অর্থকরী ফসল হলো ধান। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাবে দিন দিন তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ধান চাষ। অসময়ে বন্যা, বৃষ্টি এবং প্রবল শিলাবৃষ্টির কারণেও ধান চাষ ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশের সোনালি আঁশ পাটের উৎপাদন কমে যাওয়ায় চাষিরা পাট চাষে বিমুখ হয়ে পড়ছেন। পাট চাষের ক্রমাবনতির জন্য বিশেষজ্ঞরা জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন। শীতকালের স্থায়িত্ব কমে যাওয়ায় রবিশস্যের জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার শৈত্যপ্রবাহের ফলে সরিষা, মসুর, ছোলাসহ বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসবের ফলে সারা বিশ্বে যে জলবায়ু পরিবর্তনের আলামত দেখা দিয়েছে তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ বা তার মতো দেশগুলো দায়ী নয়, দায়ী ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলো। কিন্তু এর খেসারত স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকেই বেশি দিতে হচ্ছে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও ক্ষতি মোকাবিলায় ধনী ও উন্নত দেশগুলো তেমন সহযোগিতা না করা অত্যন্ত হতাশার। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত সমস্যা একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। এ সমস্যা দূর করতে হবে। এ জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগের মধ্য দিয়ে পদক্ষেপ অত্যাবশ্যক।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close