জলবায়ুর পরিবর্তন বা পৃথিবী উষ্ণ হয়ে উঠছেÑ এই বিপদ নিয়ে কমবেশি সবাই কথা বলছেন। কথা বলছেন, প্রকৃতিবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, সচেতন নাগরিক সমাজ, সর্বোপরি যাদের কথা বলার কথা সেই পরিবেশবিদরাও। প্রকৃত সত্য প্রকাশ করে তারা ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন, শুধু তা-ই নয়। রীতিমতো আতঙ্কিত হওয়ার মতো বিষয় আমাদের সামনে তুলে ধরছেন, পৃথিবী আজ যতগুলো বিনাশী দুর্যোগের শিকার, জলবায়ু পরিবর্তন তার অন্যতম। মানুষের সভ্যতায় যোগ হয়েছে কল-কারখানা, যান্ত্রিক বাহন, পারমাণবিক নিরীক্ষা, বিলাসসামগ্রী আর এর থেকে নিঃসরিত কার্বন ডাই-অক্সাইড, সিএফসি, মিথেন প্রভৃতি গ্যাস। প্রভাব পড়ছে পৃথিবীর পরিবেশ ও জলবায়ুতে। বিনষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য।

  ২৫ মার্চ, ২০১৯

মতামত

জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিপূরণে সোচ্চার হতে হবে

এনিয়ে বই লেখা হচ্ছে, সভা-সেমিনার হচ্ছে, খবরের কাগজে কলাম লেখা হচ্ছে। আমারা গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ার কথা জানতে পেরেছি এবং জেনেছি এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কথা। তাতে স্বাভাবিকভাবে সমুদ্রের অভ্যন্তরে থাকা দ্বীপরাষ্ট্র বা নিম্নভূমির দেশের তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বা আশঙ্কা অনেক বেশি। এ তালিকার মধ্যে মালদ্বীপ, ভানুয়াতু, মার্শাল আইল্যান্ড, মিসর ও বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চল রয়েছে। আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি বদলাতে থাকবে। হবে অতিবৃষ্টি, হবে বন্যা, বেড়ে যাবে জলোচ্ছ্বাস এবং সাইক্লোন। এর প্রমাণ ইতোমধ্যেই বাংলাদেশসহ বিশ্ব দেখতে শুরু করেছে। এর ভয়াবহতার প্রমাণস্বরূপ প্রায়ই সবকিছু দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে প্রতিশোধ নেয় প্রকৃতি।

বাংলাদেশের পরিবেশ সম্পর্কে বা আমাদের সাধারণদের পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা, গাছ লাগানো বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। গাছ লাগানো এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা অবশ্যই পরিবেশের একটি ব্যাপার, কিন্তু যে পরিবেশ দুনিয়াব্যাপী বিশাল ব্যাপারে পরিণত হয়েছে; সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুব কম। মাঝে বিজ্ঞানীরা সোচ্চার হোন গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া নিয়ে। প্রাণী, উদ্ভিদ এবং জীবজগৎ সম্পর্কে আমাদের ভাবনার স্তরে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এই পরিবেশকে কেন্দ্র করে পৃথিবীব্যাপী এক বিশাল রাজনীতি দানা বেঁধে উঠেছে। উৎপাদন আর উন্নয়নের নামে প্রকৃতিবিধ্বংসী সব কর্মকান্ড চলছে ভোগবিলাসে মত্ত একশেণির পুঁজিপতিরা। তাদের কাছে পুঁজিই প্রধান। মানুষের বসবাসের এই গ্রহটিকে থাকল না ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করল, তাতে তাদের কিছুই যায় আসে না। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক নেতিবাচক রাজনীতির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের মতো ছোট দেশগুলো।

ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি-৫) এর তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের ছয়টি দুর্যোগপ্রবণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, খরা, বন্যা, নদীভাঙন আমাদের নিত্যসঙ্গী। এর সঙ্গে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। আগামী শতকগুলোয় বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ইত্যাদির জন্য বন্যা, খরা, সাইক্লোন, লবণাক্ততার ঝুঁকি বৃদ্ধির পূর্বাভাস রয়েছে। তাছাড়া প্রয়োজনীয় পরিবেশগত সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং শিল্প উন্নয়নের কারণে পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার ওপর ক্রমে চাপ বাড়ছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করা ও দেশের উন্নয়নের ধারা বজায় রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন উপাদান এ দেশের উন্নয়নে ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। ২০৩০ সালের মধ্যে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১০ শতাংশ ও ২০৭৫ সালের মধ্যে ২৭ শতাংশ বাড়তে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ১ লাখ ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হতে পারে। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ১৪ শতাংশ এলাকা বন্যা প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে সাইক্লোনের মাত্রা ও গতি ৫-১০ শতাংশ বাড়তে পারে। এসব উপাদান দ্বারা দেশের অধিকাংশ খাত প্রভাবিত হয়ে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির ক্ষতিসাধন করবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ খাত হলো কৃষি। উচ্চ তাপমাত্রা আউশ, আমন ও বোরো ধানের উচ্চফলনশীল জাতের ফলন হ্রাস পাবে। জলবায়ু পরিবর্তন, বিশেষত তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং বিকিরণ কীটপতঙ্গ, রোগ-জীবাণু ও অনুজীবগুলোর বৃদ্ধি ঘটায়। ধারণা করা হচ্ছে, ২১০০ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশের তাপমাত্রা ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি থেকে বেড়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে, যা একটি ভয়াবহ বার্তা। সবকিছু অক্ষুণœ রেখে যদি দেশের তাপমাত্রা বর্তমানের চেয়ে ১ ডিগ্রি বৃদ্ধি পায়, তবে ধানের মোট উৎপাদনের প্রায় ১৭ শতাংশ এবং গমের উৎপাদন ৬১ শতাংশ কমে যাবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি ঝুঁকিপূর্ণ খাত হচ্ছে বনাঞ্চল ও প্রতিবেশ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, উচ্চ তাপমাত্রা ও ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধির ফলে দেশের বনসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, জলবায়ু-সংবেদনশীল অনেক প্রজাতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং অনেক উঁচু বনভূমি এলাকায় মাটি ক্ষয় ও এর গুণগত মান হ্রাস পাবে। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, সুন্দরবন জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে লোনাপানির অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পাবে, যা বন ও এর বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রতিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

প্লাবনের ফলে ভূমি ও ভৌত কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেমন এক মিটার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে স্থলভূমির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ স্থায়ীভাবে প্লাবিত হবে; জমির পরিমাণে আশঙ্কাজনক ঘাটতির কারণে অর্থনীতির সব খাতে উৎপাদন হ্রাস পাবে এবং প্রকৃত জিডিপিতে অবনমন ঘটবে। স্থিতাবস্থা পরিস্থিতিতে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রকৃত জিডিপি প্রতি বছর শূন্য দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং ২১০০ সাল নাগাদ শূন্য দশমিক ৯৩ শতাংশ হ্রাস পাবে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং ফলস্বরূপ সৃষ্ট বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় এ দেশের অবকাঠামোগুলোর ওপর উল্লেখযোগ্য বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো যে ক্ষতির মুখে পড়ছে, তার জন্য এই দেশের মানুষজন বা সরকার একটুও দায়ী নয়। এর পেছনে রয়েছে নানা কারণ। তার অন্যতম হলো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কথার বরখেলাপ। নানা সময়ে বিশ্বব্যাপী সিএফসি বা কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা মানা হচ্ছে না। শুধু না মানাই নয়, এটি বরং উত্তরোত্তর একে অবহেলা করা হচ্ছে। অর্থাৎ সিএফসি বাড়ছে, এ রকম কাজের পরিধি আরো বাড়ছে। এ জায়গা থেকে সরে না এলে শুধু বাংলাদেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, মানুষের বসবাসযোগ্য পৃথিবী নামের এই গ্রহটিও পড়বে ঝুঁকিতে। এজন্য বিশ্বের সব নেতাকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। শুধু তাই নয়, এর কারণে বাংলাদেশের মতো দেশ যে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে প্রতিনিয়ত, তার মূল্য এই বিশ্বকে পরিশোধ করতে হবে। এ জন্য এই দাবির প্রতি সোচ্চার হতে হবে। সরকারি-বেসরকারি ফোরামে সরকারের পাশাপাশি দেশপ্রেমিক নাগরিকদের বিশ্বের সর্বত্র এই সত্য তুলে ধরতে হবে যে, বিশ্বনেতাদের ব্যর্থতার দায় বাংলাদেশ বহন করতে পারে না। এই বিশ্বকে বসবাসযোগ্য রাখতে বিশ্বের সব দেশের দায়িত্ব রয়েছে এবং একই সঙ্গে তাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এই দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার জন্য তার মূল্য অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। জোরালো করতে হবে কণ্ঠস্বর।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close