দিলীপ কুমার আগরওয়ালা

  ২৪ মার্চ, ২০১৯

পর্যবেক্ষণ

নদীর ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে

দেশে নদ-নদীসহ প্রাকৃতিক জলাশয়ের অস্তিত্ব ক্রমে বিপন্ন হচ্ছে। ফলে ভূগর্ভের পানির স্তর প্রতিনিয়তই নিচে নামছে। সন্দেহ নেই সমস্যাটি বিশ্বজনীন। দুই বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাকাশ সংস্থা (নাসা) বলেছে, পৃথিবীর ভূগর্ভে পানির যত মজুত আছে তার এক-তৃতীয়াংশই মানুষের কর্মকা-ের কারণে দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। ভূগর্ভের বাকি দুই-তৃতীয়াংশ পানির সঠিক পরিমাণ কত তা স্পষ্টভাবে জানা না থাকায় তা জানা এবং সে পানি কত সময় পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে তা বের করার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা।

নাসার মতে, পৃথিবীর ৩৭টি বৃহৎ পানির স্তরের মধ্যে ২১টির পানি ফুরিয়ে যাচ্ছে। এ স্তরগুলোর অবস্থান ভারত ও চীন থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের সীমানার মধ্যে। নাসা ১৩টি পানির স্তরকে আখ্যায়িত করেছে চরম সংকটাপন্ন স্তর হিসেবে, যেগুলো প্রায় শুকিয়ে গেছে। এ স্তরগুলো ব্যবহার উপযোগী করা অর্থাৎ প্রাকৃতিক উপায়ে স্তরগুলো পানিতে পরিপূর্ণ করার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। পানির স্তর নিচে নামার বিপদ থেকে নদ-নদীর দেশ বাংলাদেশও মুক্ত নয়। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকহারে নামছে নিচের দিকে। ওয়াসা সুপেয় পানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ভূগর্ভস্থ স্তর থেকে পানি উত্তোলনে বাধ্য হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। রাজধানীর নদীগুলোর পানি মাত্রাতিরিক্ত দূষিত হয়ে পড়ায় তা পরিশোধন করে ব্যবহার করাও কঠিন হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর যে বাড়তি চাপ পড়ছে তা অশনিসংকেত বলে বিবেচিত হচ্ছে। রাজধানীর পানির স্তর ক্রমান্বয়ে নিচে নেমে যাওয়ায় বিপদ সৃষ্টি হচ্ছে অন্যদিক থেকেও। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগের দূষিত পানি ভূগর্ভের শূন্য স্থানে প্রবেশ করে নাগরিক জীবনের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। এ ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারকারীরা নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছে। বাংলাদেশ যে পানির সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে তার প্রধান কারণ উজানে পানি প্রত্যাহারের ঘটনা। নদ-নদীর পানি ধারণক্ষমতা হ্রাসও এ বিপদের জন্য দায়ী। নদীদূষণ অবস্থাকে ভয়াবহভাবে বিপজ্জনক করে তুলছে। অস্তিত্বের স্বার্থে উজানে পানি প্রত্যাহার রোধে সরকারকে সক্রিয় হতে হবে। নদ-নদীর ধারণক্ষমতা বাড়ানো ও দূষণ বন্ধে নিতে হবে পদক্ষেপ। এ ক্ষেত্রে কোথাও হেলাফেলা কাম্য নয়।

চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগে হাজার হাজার নলকূপ বিকল, পানি নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গভীর নলকূপেও পানি ওঠছে না। এর প্রধান কারণ, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। চট্টগ্রাম ও খুলনা বলে কথা নয়, আসলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নেমে যাওয়ার সমস্যাটি কম-বেশি সারা দেশের। বর্ষাকালে সমস্যাটি বোঝা না গেলেও শুষ্ক মৌসুমে প্রতি বছরই খাবার পানির সংকট দেখা দেয়। সমস্যাটি সবচেয়ে বেশি উত্তরাঞ্চলে। দক্ষিণাঞ্চলে সমস্যার স্বরূপ ভিন্ন। সেখানে অতিমাত্রায় লবণাক্ততার কারণে খাবার পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। দেশের কোনো কোনো এলাকায় দেখা যায় নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের বিষ। পানিতে স্বল্পমাত্রায় আর্সেনিক খুব একটা ক্ষতিকর নয়। কিন্তু এটা যখন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায়, তখন সে পানি মারাত্মক স্বাস্থ্যহানিকর। আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করার ফলে দেখা দেয় আর্সেনিকোসিস রোগ। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় অসংখ্য মানুষ আজ এই রোগের শিকার।

পানিঘটিত সমস্যার স্বরূপ যাই হোক না কেন, সবই পরিবেশ বিপর্যয়ের সাক্ষ্য বহন করে। জলবায়ু পরিবর্তন তথা পরিবেশিক ভারসাম্যহীনতার সমস্যা আজ বিশ্বব্যাপী। জলবায়ুর পরিবর্তন হেতু সৃষ্ট বিপর্যয় মোকাবিলা বিশ্বমানবের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশেও সমস্যাটি প্রকট। বলার অপেক্ষা রাখে না, সমস্যাটিকে প্রবল করে তুলেছি আমরা নিজেরাই। পানির স্তর অস্বাভাবিক মাত্রায় নিচে নেমে যাওয়ার একটি বড় কারণ ব্যাপক হারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষি ব্যবস্থাকে আমরা করে তুলেছি প্রধানত সেচনির্ভর। নদী ও খালে পানি না থাকায় পাওয়ার পাম্পে সারফেস ওয়াটার সেচ এখন নেই বললেই চলে। নদী ও খাল-বিলের পারেও বসেছে গভীর নলকূপ। খাবার পানিও ওঠছে গভীর নলকূপে অথবা সাবমার্সিবল পাম্পে। এতে চাপ পড়ছে মাটির নিচের পানির স্তরে। এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার পথ একটাই, নদীসহ খাল ও অন্যান্য জলাশয়ে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা।

লেখক : পরিচালক, এফবিসিসিআই

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close