আবু আফজাল সালেহ

  ২৪ মার্চ, ২০১৯

মতামত

থামানো যাচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনা

থামানো যাচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনা বা নিয়ন্ত্রণও করা যাচ্ছে না। লেখালেখিও কম হচ্ছে না। অনেক উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষ বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ বিশেষ কারণে থমকে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পরবর্তীকালে শতভাগ বাস্তবায়ন হচ্ছে না বিভিন্ন কারণে। কারণগুলো চিহ্নিত করে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সজাগ হস্তক্ষেপ ছাড়া পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আনা খুবই কঠিন।

রাজধানীর বেশির ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা কী কারণে ঘটে থাকে, এর ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করেছেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই)। গবেষণায় রাজধানীতে বেশির ভাগ সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে ওঠে এসেছে বেপরোয়া বাস। বুয়েটের এআরআই থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৬৬টি দুর্ঘটনায় ৬৯৯ জন নিহত এবং ১ হাজার ২২৭ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৫৪টি দুর্ঘটনাই বাসের কারণে ঘটেছে। এছাড়া ১৩০টি মোটরসাইকেল, ১১৩টি ট্রাক, ৭৩টি পিকআপ এবং ৫৬টি ব্যক্তিগত গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে বলে এআরআই’র তথ্য। ২০১৬ সালের মার্চ থেকে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় ১২৩টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৩৭ জন, আহত হয়েছেন ৩৩৭ জন। ২০১৭ সালে ঢাকায় ২৬৩টি দুর্ঘটনা ঘটার তথ্য দিচ্ছে এআরই। তাতে ২৭৬ জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি ৩৫৮ জন আহত হয়েছিলেন। সে বছর ১৪৫টি দুর্ঘটনায় বাসের স¤পৃক্ততা ছিল। ২০১৮ সালে ঢাকায় ২৮০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৮৬ জন নিহত হন। আহত হয়েছিলেন ৫৩২ জন। সে বছর ১৩৪টি দুর্ঘটনার কারণ বাস।

ত্রুটিপূর্ণ বা ফিটনেসবিহীন যানবাহন এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। অনেক ক্ষেত্রে ড্রাইভিং লাইসেন্সও যথাযথভাবে দেওয়া হয় না বলে বিভিন্ন অনুসন্ধানে জানা যায়। ছানিপড়া বা অসুস্থ চালক গাড়ি চালাতে না পারার নির্দেশনা থাকলেও সেটা অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে মনে হয় না। ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তিতে উচ্চ পর্যায়ের মেডিকেল সনদ (বিশেষকরে ভারী যানবাহনের ক্ষেত্রে) নেওয়ার শর্ত আরোপ করা যেতে পারে।

সম্প্রতি দুই গাড়ির সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ভারী যানবাহনের ৯৬ দশমিক ৪ শতাংশ চালক ‘মূল চালকের’ সহকারী থেকে চালক হয়েছেন। তারা গাড়ি চালানোর কোনো নিয়ম জানে না। আর বুয়েটের হিসাব মতে, বাংলাদেশে যত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে তার মধ্যে ৬৮ দশমিক ৪১ শতাংশের জন্য বাস ও ট্রাক দায়ী। ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ দায়ী বাস এবং ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ দায়ী ট্রাক। আর চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে ৩৭ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে।

পরিবহন সংশ্লিষ্টদের মতে, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, বাস-মিনিবাস, লরি দিনে ১২ থেকে ১৬ বা ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত চলে। এ ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রতিটি যানে অন্তত দুজন চালক থাকার নিয়ম। কিন্তু কখনো একটি গাড়িতে দুজন চালক থাকেন না। একজন চালক থাকায় অনেক ক্ষেত্রে হেলপার গাড়ি চালান। এছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে গাড়ি চালানোর ক্লান্তি দূর করতে চালক ও সহকারীরা মাদক সেবন করেন। নেশার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। দেশে দক্ষ চালকের সংকট রয়েছে। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বিআরটিএ’র রেজিস্ট্রার্ড গাড়ির সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭৫ হাজার। ২০১৭ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৩৩ লাখে। প্রতি বছর এ সংখ্যা বাড়ছে। ১৯৮৭ সালে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল ১ লাখ ৯০ হাজার, ২০১৭ সালে এ সংখ্যা ২২ লাখ ৪২ হাজার ৪৬৫টিতে দাঁড়ায়। এর মধ্যে পেশাদার চালকের সংখ্যা ১০ লাখ ৪১ হাজার ৬৯৭। এ সংক্রান্ত কাপজপত্রে আরো দেখা যায়, ভারী গাড়ি চালনার লাইসেন্স আছে ১ লাখ ৩০ হাজার ৪৬৮টি। মাঝারি গাড়ি চালানোর লাইসেন্স ৪৬ হাজার ৫৫৩, হালকা যানের জন্য ১২ লাখ ৪৭ হাজার ৩৫০টি। থ্রি-হুইলার লাইসেন্স আছে ৪৯ হাজার ১২টি, মোটরসাইকেলের লাইসেন্স রয়েছে ৭ লাখ ৬৮ হাজার ২৭৬টি এবং অন্য ক্যাটাগরিতে আছে ৮০৬টি লাইসেন্স।

দেশে সারা বছর যে রকম মর্মান্তিক ও ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে তার জন্য বৈধ যানবাহনের চেয়ে অবৈধ যানবাহনও কম দায়ী নয়। কারণ বৈধ যানবাহনে তাও অনেক দক্ষ চালক থাকেন, কিন্তু অবৈধ যানবাহনে মূলত অদক্ষ-আনাড়ি চালকদের দ্বারাই পরিচালিত হয়। যে কারণে মুখোমুখি সংঘর্ষ বা অবিবেচকের মতো ওভারটেকের কারণে প্রায়ই বড় বড় সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। সরকারি হিসাবেই দেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৪ হাজার মানুষ মারা যান। আহত হন প্রায় ৫ হাজার মানুষ। এদের অধিকাংশই গ্রামীণ জনগোষ্ঠী। তবে এই সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বাংলাদেশে জিডিপির ক্ষতির পরিমাণ শতকরা ১ দশমিক ৬ ভাগ। সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে রুট পারমিটবিহীন, নিবন্ধনবিহীন এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহন শনাক্ত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালক দিয়ে গাড়ি চালানো নিশ্চিত করতে হবে। সারা দেশে হাজার হাজার অনুমোদনবিহীন স্থানীয়ভাবে নির্মিত ইঞ্জিনচালিত যানবাহন চলাচল করছে। যেমনÑ অটোরিকশা, টমটম, নসিমন, করিমনসহ নানা রকম যানবাহন হাইওয়ে বা আন্তঃজেলা সড়কগুলোতেও চলাচল করছে। এসব কারণেও অনেক সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। সড়কের পাশে অবৈধ হাট বা দোকানপাট উচ্ছেদ, অতিরিক্ত গতি এবং ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং রোধ করার জন্যও সংশ্লিষ্ট মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। অনেক সময় অতিরিক্ত ট্রিপ মারতে গিয়ে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে গিয়ে এবং চলন্ত অবস্থায় চালক মোবাইল ফোনে কথা বলতে গিয়েও দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। তবে দুর্ঘটনার জন্য কেবল যানবাহন বা চালকই দায়ী নন, এমনকি ত্রুটিপূর্ণ রাস্তার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে। রাস্তা প্রশস্ত করতে হবে। বিশেষ করে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাগুলোতে। ট্রাফিক সিগনাল উন্নত করতে হবে। তবে উল্লিখিত ত্রিপক্ষের সচেতনতা সবচেয়ে বড় অস্ত্র। এটিই নিরাপদ সড়কের মূলমন্ত্র।

সামগ্রিক বিচারে দেখা যাচ্ছে, এখানে তিনটি পক্ষ জড়িত। পরিবহন কর্তৃপক্ষ (মালিক-শ্রমিক), সরকার (বিআরটিএ-প্রশাসনসহ) ও পথচারী (জনগণ)। তিন পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে নিরাপদ সড়কের জন্য। তাই বলা চলে, এই ত্রিপক্ষীয় পার¯পারিক সচেতনতা, সহযোগিতার মাধ্যমে নিরাপদ সড়কের চিন্তা-ভাবনাকে এগিয়ে নিতে হবে, এক কাতারে দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। যে কোনো একপক্ষ নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে পারে না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদক্ষেপ মিলেই বিরাট পথ তৈরি হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close