এ টি এম মোসলেহ উদ্দিন

  ২২ মার্চ, ২০১৯

পর্যালোচনা

‘বর্ণবৈষম্য’ বিশ্বশান্তির অন্তরায়

মার্চ ২১ আন্তর্জাতিক বর্ণবৈষম্য বিলোপ দিবস। প্রতি বছরের মতো এ বছরও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়েছে। এই দিনটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৬০ সালের এই দিনে দক্ষিণ আফ্রিকার শার্পভ্যালিতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল পার্টির জারি করা বর্ণভিত্তিক আলাদা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণ একটি শান্তিপূর্ণ মিছিলের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। বিনা উসকানিতে সেই মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে ৬৯ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে এবং ১৮০ জনেরও অধিক মানুষকে আহত করে। এই মর্মান্তিক ঘটনাকে উল্লেখ করে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৬৬ সালে পৃথিবীর সব দেশের মানুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য কমানোর জন্য সব দেশের প্রতি জোরালোভাবে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এই দিনটি আন্তর্জাতিক বর্ণবৈষম্য বিলোপ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। তখন থেকে ২১ মার্চ সারা বিশে^ একযোগে যথাযোগ্য মর্যাদায় এই দিনটি পালন হয়ে আসছে। এই দিবস পালনের সময়কাল থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্য আইন বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়, যার ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচলিত বর্ণবাদ আইন এবং চর্চা বাতিল করতে বাধ্য হয়।

বর্ণবাদ হলো বৈষম্যমূলক সামাজিক স্তরবিন্যাস ও আগ্রাসী শক্তির হাতিয়ার। এটি এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি, যা নির্দ্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য কোনো গোষ্ঠী উঁচু বা নিচু, কে বেশি যোগ্য বা অযোগ্য, কে কার ওপর কর্তৃত্ব করার অধিকারী। কোনো মানুষের আচরণ যদি কখনো তার জাতি বা বর্ণ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়, সেটি অন্য কারো জন্য ক্ষতিকর না হলেও তাকে বর্ণবাদ বলা যাবে। বর্ণবাদের কথা শুনলেই আমাদের সামনে ফুটে উঠে আফ্রিকার কথা, সাদা-কালো মানুষের পার্থক্যের কথা, শে^তাঙ্গদের দ্বারা বিশ^ব্যাপী কৃষ্ণাঙ্গদের দাস বানানোর কথা, বর্ণবাদবিরোধী অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার কথা, এই উপমহাদেশে ইংরেজ কর্তৃক ভারতীয়দের খর্ব করে দেখা, দেশভাগের পর পাকিস্তানি কর্তৃক বাঙালিদের দমিয়ে রাখার চেষ্টার কথা ইত্যাদি। তবে পৃথিবীব্যাপী সবচেয়ে বেশি বর্ণবৈষম্যে গায়ের রং দিয়ে অর্থাৎ কালো আর সাদা চামড়ার মানুষের মধ্যে। তবে বর্ণবাদ শুধু গায়ের চামড়ার রঙের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, কখনো পেশা দিয়ে হতে পারে, কখনো আঞ্চলিকতা দিয়ে হতে পারে, কখনো গোত্র দিয়ে হতে পারে, কখনো বর্ণ দিয়ে হতে পারে। গায়ের রং দিয়ে বর্ণবাদ সবচেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আফ্রিকা, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায়। আর আমাদের উপমহাদেশে পেশার ভিত্তিতে হিন্দু ধর্মে বর্ণভেদের সৃষ্টি হয়েছিল।

বিশে^র সব দেশের প্রতিটি মানুষের কোনো প্রকার বৈষম্য ছাড়া মৌলিক মানবাধিকার ভোগ করার অধিকার আছে। কিন্তু তার পরও অনেক দেশের সরকারগুলোর আধিপত্যবাদী চরিত্র ও ব্যক্তি বিশেষের নাক উঁচু স্বভাবের কারণে বর্ণবৈষম্য পুরোপুরিভাবে রোধ করা এখনো সম্ভব হয়ে উঠছে না। উন্নত বিশে^র দেশগুলো নিজেদের মানবাধিকারের স্বর্গরাজ্য দাবি করলেও এখনো আমরা সেখানে শে^তাঙ্গদের দ্বারা কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি অবজ্ঞার চিত্র প্রতিনিয়ত খবরে দেখতে পাই। আমরা আমাদের আশপাশের দেশগুলোর দিকে তাকালে বর্ণবৈষম্যের ভয়াল চিত্র দেখতে পাই। বছর দু-এক ধরে আমাদের পাশের দেশ মিয়ানমারের সরকারের ইন্ধনে সেদেশের সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন আরাকান প্রদেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে শুধু বর্ণগত কারণে; যা আজ আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক ঘৃণিত ও সমালোচিত হয়েছে। অতি সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের একটি মসজিদে শুক্রবার জুমার নামাজে একজন উগ্রবাদী শে^তাঙ্গ সন্ত্রাসী কর্তৃক বন্দুক হামলায় ৪৯ জন নিহত হওয়ার পর তাকে গ্রেফতার করে পরদিন ওই সন্ত্রাসীকে আদালতে হাজির করা হলে সে তার হাতের আঙুল দিয়ে বর্ণবাদী চিহ্ন প্রদর্শন করে; যা বিশ^বিবেককে নাড়া দিয়েছে।

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। যেখানে ভিন্ন ভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের মানুষের বসবাস। দেশের স্বাধীনতার জন্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবার সক্রিয় অবদান রয়েছে। এ দেশের মানুষ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, পেশা নির্বিশেষে একে অন্যের সঙ্গে নানা সম্পর্কে জড়িয়ে আছে। গড়ে তুলেছে জীবনবান্ধব আন্তঃনির্ভরশীল এক সম্পর্ক। কিন্তু বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, পেশাজীবী মানুষের সহাবস্থান থাকলেও জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও পেশাগত ভিন্নতাকে সমভাবে গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে সব সম্পর্কের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যগুলোকে বিলোপ করা সম্ভব হয়নি। আমাদের দেশের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, হরিজন, দলিত, বেদে সমাজের মানুষ, দরিদ্র, প্রবীণ, প্রতিবন্ধী, ক্ষেত্রবিশেষে নারীরা এখনো বিভিন্নভাবে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এ ছাড়া জন্মস্থানের কারণেও আনেক সময় কটূক্তিমূলক কথা শুনতে হয়। এখনো আমাদের দেশে বিয়ের ক্ষেত্রে ফর্সা মেয়েদের প্রাধান্য দেওয়া হয়, কালো মেয়েদের অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। বাংলাদেশে শ্রম বৈষম্যের অন্যতম একটি জায়গা হলো চা বাগনগুলো। সেখানে শ্রমিকদের মজুরি অনেক কম। তাদের সন্তানদের শিক্ষার হার খুবই কম। সেখানে শিক্ষার ব্যাপারে তাদের খুব একটা উৎসাহিত করা হয় না। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ও জাতীয়ভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও প্রায় সব প্রকার ধর্মীয় চর্চা, ব্যক্তিবিশেষের চিন্তায়, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে এ বর্ণবাদ প্রথা বিদ্যমান থাকায় এখনো মানুষে বৈষম্য থেকে মুক্তি লাভ করতে পারেনি। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

সাংবিধানিকভাবে আমাদের দেশের অবস্থান বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে। নাগরিকদের প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপের জন্য ২০১৪ সালে বৈষম্য বিলোপ আইন ২০১৪ খসড়া তৈরি করা হয়েছিল, যা এখনো চূড়ান্তভাবে আইন আকারে অনুমোদিত হয়নি। এটি কার্যকর হলে বৈষম্যের শিকার ব্যক্তি মামলা করতে পারবেন। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অবহেলিত মানুষগুলো উপকৃত হবে। খসড়া আইনে বলা আছে, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, শারীরিক, মানসিক ও লিঙ্গীয় প্রতিবন্ধিকতা এবং কথিত অস্পৃশ্যতার অজুহাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বৈষম্যমূলক কাজ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। প্রস্তাবিত খসড়ায় অবহেলিত জনগোষ্ঠীর লোকদের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা লাভের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলে প্রথমবার দুই বছরের কারাদন্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড দেওয়া যাবে। শিক্ষা ও চিকিৎসা গ্রহণে বাধা, কর্ম লাভে বাধা, জনস্থল, সার্বজনীন উৎসব, নিজ উপাসনালয়ে প্রবেশ ও অংশগ্রহণে বাধা প্রভৃতি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। এই আইন যত দ্রুত সম্ভব পাস করার ব্যবস্থা নিতে হবে। গত মাসে ঢাকায় বাংলাদেশ অ্যাজমা অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলনে আমাদের আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, বৈষম্য বিলোপ আইন তৈরির কাজ শেষপর্যায়ে রয়েছে এবং অতি শিগগিরই তা পাস হবে। এটা আমাদের দেশের জনগণের জন্য খুবই আশাব্যঞ্জক।

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে বিদ্যমান সব ধরনের সাংস্কৃতির ভিন্নতাকে মূলধারায় যুক্ত করতে হবে। সমাজে একে অন্যের সঙ্গে নানাবিধ নির্ভরশীল সম্পর্কের ভেতর দিয়ে টিকে থাকে। এ সম্পর্ককে আমরা যখন উদারভাবে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে পারব, তখনই জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, পেশা, ভাষা প্রভৃতির পারস্পরিক মঙ্গলজনক সহাবস্থান নিশ্চিত হবে। প্রতিটি মানুষের

সমমর্যাদা ও সমসুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে পৃথিবী থেকে বর্ণবৈষম্যকে পরিপূর্ণভাবে বিদায় জানাতে হবে। তবেই বর্ণবৈষম্য বিলোপের আন্দোলনে জীবন উৎসর্গকারীদের আত্মত্যাগ সার্থকতায় উপনীত হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close