মোতাহার হোসেন

  ১৭ মার্চ, ২০১৯

মতামত

টুঙ্গিপাড়ার সেই শিশুটি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়, বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্থপতি তিনি। তাকে ঘিরেই বাঙালির অহংকারের এসব অর্জন। তাই কবির কবিতায় যথার্থই ফুটে উঠেছে, ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা/গৌরী মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান...’। জাতির পিতার ৯৯তম জন্মদিনের নিবেদনে এ প্রত্যাশা তার মেয়ে শেখ হাসিনার হাত ধরেই এখন বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। তাই তাকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছি। তার জন্য করি পরম করুণাময় আল্লাহর দরবারে। একই সঙ্গে তার পরিবারের অপরাপর সদস্যদের জন্যও।

বাংলা ও বাঙালির কাছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামটি চিরজাগরূক হয়ে থাকবে। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, তত দিন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এ বাঙালির অবদানের পাশাপাশি তার জন্মের তিথিও চিরজাগরূক থাকবে বাঙালির প্রাণের স্পন্দনে। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বাঙালির জন্য একটি আশীর্বাদের দিন। আনন্দের দিনও বটে। এদিন হাজার বছরের শৃঙ্খলিত বাঙালির মুক্তির দিশা নিয়ে জন্ম নিয়েছিল মুজিব নামের এক দেদীপ্যমান আলোক শিখা। এ আলোক শিখা ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র, নিকষকালো অন্ধকারের মধ্যে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে পথ দেখাতে থাকেন পরাধীন জাতিকে। অবশেষে বাংলার পূর্বাকাশে পরিপূর্ণ এক সূর্য হিসেবে আবির্ভূত হয় স্বাধীনতা, বাঙালি অর্জন করে মুক্তি। স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আজ নেই, কিন্তু সে সূর্যের প্রখরতা আগের চেয়েও বেড়েছে অনেক গুণ। তার অবস্থান এখন মধ্যগগনে। সেই সূর্যের প্রখরতা নিয়েই বাঙালি জাতি আজ এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে।

আজ সেই ঐতিহাসিক ১৭ মার্চ। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৯তম জন্মবার্ষিকী, জাতীয় শিশু দিবস। ১৯২০ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ পরিবারে জন্ম নেওয়া খোকা নামের শিশুটি কালের আবর্তে হয়ে উঠেছিলেন নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালির ত্রাণকর্তা ও মুক্তির দিশারি। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ এবং জনগণের প্রতি মমত্ববোধের কারণে পরিণত বয়সে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। এক বর্ণাঢ্য সংগ্রামবহুল জীবনের অধিকারী এ নেতা বিশ্ব ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার হিসেবে।

একাত্তরের এই দিনে জনৈক এক বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে জানতে চান, আজ ৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচেয়ে বড় কামনা কী? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’ অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না। আমার জন্মদিনে মোমবাতি জ্বালাই না, কেকও কাটি না।’ বঙ্গবন্ধু আরো বলেন, ‘আমি জনগণেরই একজন। আমার জন্মদিনই কী, আর মৃত্যুদিনই কী! আমার জনগণের জন্যই আমার জীবন ও মৃত্যু। আপনারা জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যেকোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে....।’ ২০০ বছরের পরাধীনতার জিঞ্জির ছিঁড়ে এ বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাকামী বাঙালির দীর্ঘ নয় মাস মৃত্যুপণ জনযুদ্ধের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে অর্জিত হয়েছিল মহামূল্যবান স্বাধীনতা। ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান এবং অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাঙালি জাতি অর্জন করে তাদের হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতা। বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। লাল-সবুজে আচ্ছাদিত হয় বাঙালির হৃদয়।

একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে পাকিস্তানি জল্লাদরা কারাবন্দি বঙ্গবন্ধুর কবর খুঁড়েও যাকে হত্যা করার সাহস পায়নি; অথচ স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় সেই হিমালয়সম ব্যক্তিত্বের অধিকারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা হত্যা করে ক্ষমতার পালাবদল করেছিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের হয়ে কাজ করা ঘাতকচক্রের বুলেটে সেদিন ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের হৃৎপিন্ড। কিন্তু তার পরও একটি জাতি ও অবহেলিত মানুষের মুক্তির অগ্রদূত হিসেবে বঙ্গবন্ধু শুধু দেশে নয়, সারা বিশ্বেই ইতিহাস হয়ে রয়েছেন।

শৈশব থেকে তৎকালীন সমাজজীবনে বঙ্গবন্ধু জমিদার ও মহাজনদের প্রজাপীড়ন প্রত্যক্ষ করেছেন। গ্রামের হিন্দু, মুসলমানদের সম্মিলিত সামাজিক আবহে তিনি দীক্ষা পান অসাম্প্রদায়িকতার। বস্তুতপক্ষে সমাজ ও পরিবেশ তাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম করতে শিখিয়েছে। তাই পরবর্তী জীবনে কোনো শক্তির কাছে মাথা নত করেননি। চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়রা খাতুনের তৃতীয় সন্তান। ৭ বছর বয়সে তিনি পার্শ্ববর্তী গিমাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরবর্তীতে মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুল, গোপালগঞ্জ সরকারি পাইলট স্কুল ও পরে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে লেখাপড়া করেন। মাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনার সময় বঙ্গবন্ধু চোখের রোগে আক্রান্ত হলে কলকাতায় তার চোখের অপারেশন করা হয়। এ সময়ে কয়েক বছর তার পড়াশোনা বন্ধ থাকে। ১৯৪২ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে কলকাতায় গিয়ে বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন এবং সুখ্যাত বেকার হোস্টেলে আবাসন গ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি বিএ পাস করেন। শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ সময়ে তিনি শীর্ষ রাজনীতিক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমের মতো নেতাদের সংস্পর্শে আসেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং এ দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের একমাত্র চাওয়া-পাওয়া। যার জন্য জীবনে তিনি জেল-জুলুম-হুলিয়া কোনো কিছুই পরোয়া করেননি। দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রামে শত যন্ত্রণা, দুঃখ, কষ্ট-বেদনা সহ্য করেছেন, ফাঁসির মঞ্চ, মৃত্যুও ছিল যার কাছে তুচ্ছ।

’৭৫-পরবর্তী ইতিহাসের এ রাখাল রাজার নাম মুছে ফেলার অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের সব ষড়যন্ত্রই ব্যর্থ হয়েছে। কারণ বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব। ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে ‘জাতীয় শিশু দিবস’ এবং সরকারি ছুটি ঘোষণা করে। কিন্তু ২০০১ সালে যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় এসেই বিএনপি ছুটি বাতিল করে দেয়। ২০০৯ সালে ভূমিধস মহাবিজয় নিয়ে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার আবারও সরকারি ছুটি ঘোষণা করে। সেটি এখনো অব্যাহত। এই দিনকে যথাযোগ্য মর্যাদায় ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবেই পালন করা হচ্ছে। প্রগতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীসহ জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, কূপমূন্ডকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াইয়ের দুর্জয় প্রেরণা, ইস্পাত কঠিন প্রত্যয় আর সব ষড়যন্ত্রের কুহেলিকা ভেদ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ বিনির্মাণের দৃপ্ত শপথ নিয়ে কৃতজ্ঞ বাঙালি আজ স্মরণ করবে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বাংলা, বাঙালি ও বঙ্গবন্ধু এক বৃন্তে তিনটি ফুল, বাংলার মেহনতী জনতার হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।

বিশ্ব গণমাধ্যমের চোখে বঙ্গবন্ধু ক্ষণজন্মা এক পুরুষ। অনন্য সাধারণ এ নেতাকে ‘স্বাধীনতার প্রতীক’ কিংবা ‘রাজনীতির ছন্দকার’ খেতাবেও আখ্যা দেওয়া হয়। বিদেশি ভক্ত, কট্টর সমালোচক এমনকি শত্রুরাও তাদের নিজ নিজ ভাষায় তার উচ্চকিত প্রশংস করেন। বিংশ শতাব্দীর কিংবদন্তি পুরুষ কিউবার বিপ্লবী নেতা প্রয়াত ফিদেল ক্যাস্ট্রো বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয়কে দেখিনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ ১৯৭৩ সালে আলজিরিয়ায় জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ক্যাস্ট্রোর সাক্ষাৎ ঘটে।

শ্রীলঙ্কার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী লক্ষণ কাদির গামা (নৃশংস হত্যাকান্ডের শিকার) বাংলাদেশের এ মহান নেতা সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছিলেন, দক্ষিণ এশিয়া গত কয়েক শতকে বিশ্বকে অনেক শিক্ষক, দার্শনিক, দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক, রাজনৈতিক নেতা ও যোদ্ধা উপহার দিয়েছে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সব কিছুকে ছাপিয়ে যান, তার স্থান নির্ধারিত হয়ে আছে সর্বকালের সর্বোচ্চ আসনে। আর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ অর্থাৎ ‘ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেসকো। জনকের জন্ম দিনে তাকে স্মরণ করার পাশাপাশি তার স্বপ্ন সোনার বাংলা বিনির্মাণে তার সুযোগ্য কন্যা আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন করে বাঙালির জেগে ওঠা এবং বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শপথ নেই।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close