নিতাই চন্দ্র রায়

  ১১ মার্চ, ২০১৯

বিশ্লেষণ

বায়ুদূষণ ও আমাদের ভবিষ্যৎ

প্রতি বছর বিভিন্ন অসুখ-বিসুখে পৃথিবীতে যত মানুষ মারা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি মারা যায় পরিবেশ দূষণের কারণে। বর্তমান বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর পঞ্চম কারণ হলো বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণের প্রভাবে এ বছর পৃথিবীতে ৭০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বায়ুদূষণ। গ্রিনপিসের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নির্বাহী পরিচালক ইয়েব সানোর মতে, বায়ুদূষণ মানুষের জীবিকা ও ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিচ্ছে। মানুষের মৃত্যু ছাড়াও বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বব্যাপী চিকিৎসা বাবদ খরচ হচ্ছে ২২৫ বিলিয়ন ডলার। বায়ুদূষণের মারাত্মক প্রভাব পড়ছে আমাদের স্বাস্থ্য ও সঞ্চিত অর্থের ওপরও।

‘বৈশ্বিক বায়ুমান সূচক-২০১৮’ অনুসারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজধানীর মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বাতাসের রাজধানী শহর হলো ভারতের দিল্লি। আর দ্বিতীয় শীর্ষ বায়ুদূষণের রাজধানী শহর হলো বাংলাদেশের ঢাকা। সম্প্রতি (৪.৩.২০১৯) সুইজারল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্রিনপিস ও এয়ার ভিজুয়াল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৩ হাজার ৯৫টি শহরের বায়ুর গুণগত মান নিয়ে গবেষণা করে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ৩০টি শহরের মধ্যে ২২টি ভারতের, পাঁচটি চীনের, দুটি পাকিস্তানের এবং অন্য একটির মধ্যে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর রয়েছে। দূষণের শীর্ষে থাকা ৩০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৭তম।

বাতাসে ২ দশমিক ৫ মাক্রোমিটার ব্যাসের সূক্ষ¥ কণাকে পিএম ২ দশমিক ৫ বলা হয়। অতি সূক্ষ্ম হওয়ায় সহজেই এ কণা মানবদেহে প্রবেশ করে। বায়ূদূষণে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো সূক্ষ্ম এসব কণা। প্রতিবেদন অনুয়ায়ী বিভিন্ন দেশের রাজধানীর মধ্যে এ ধরনের সূক্ষ্ম কণা সবচেয়ে বেশি আছে দিল্লির বাতাসে, প্রতি ঘনমিটারে ১১৩ দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রাম। রাজধানী হিসেবে এরপরই সর্বোচ্চ অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা রয়েছে ঢাকার বাতাসে, প্রতি ঘনমিটারে ৯৭ দশমিক ১ মাইক্রোগ্রাম। তৃতীয় সর্বোচ্চ সূক্ষ্ম বস্তুকণা রয়েছে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের বাতাসে, প্রতি ঘনমিটারে ৬১ দশমিক ৮ মাইক্রোগ্রাম।

বিশ্ব সংস্থার মান অনুয়ায়ী, বাতাসে অতি সূক্ষ্ম কণার ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে ১০ মাইক্রোগ্রাম হলে তাকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরা হয়। সে হিসেবে ঢাকার বাতাসে যে মাত্রায় অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা রয়েছে, তা খুবই অস্বাস্থ্যকর মাত্রা নির্দেশ করে। এসব কণা কঠিন ও তরলের মিশ্রণে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ফোঁটা আকারে বাতাসে ভেসে বেড়ায়। চুলের মতো চওড়া জায়গার মধ্যে ৪০টি পিএম ২ দশমিক ৫ বস্তুকণা আটাআটিভাবে সংযুক্ত হয়ে থাকতে পারে। এই কণা অতি সহজেই নিঃশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। চিকিৎসকদের মতে, বাতাসে সহনীয় মাত্রার অতিরিক্ত অতি সূক্ষ্ম এ বস্তুকণা স্বল্পমেয়াদে মাথাব্যথা, শ্বাসতন্ত্রের রোগসহ নানা ব্যাধির জন্য দায়ী। এর প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদে ফুসফুস ক্যানসার, হার্ট অ্যাটাক, অ্যাজমা, ব্রংকাইটিসের মতো জটিল রোগ হতে পারে। বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞদের মতে, বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণার কারণে হাঁপানিসহ শ্বাসতন্ত্রের রোগ বেশি হয়। শ্বাসতন্ত্র ছাড়াও বায়ুদূষণের কারণে কিডনি ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগের কারণও বায়ুদূষণ।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলেন, সনাতন ইটভাটা, পুরাতন যানবাহন, কল-কারখানার কালো ধোঁয়া, অপ্রতুল গাছপালা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও নির্মাণকাজ রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। সনাতন পদ্ধতির ইটভাটার কারণে শতকরা ৫৮ ভাগ বায়ুদূষণ হয়। পুরোনো গাড়ির জন্য বায়ুদূষণ হয় ২০ ভাগ। আর অবকাঠামো নির্মাণকাজে বায়ুদূষণ হয় শতকরা ২০ ভাগ এবং শিল্প-কারখানার কারণে বায়ুদূষণ হয় শতকরা ১০ ভাগ। এ ছাড়া বাতাসের সিসার উপস্থিতি ও বায়ুদূষণ মাত্রাকে বৃদ্ধি করে। ব্যাটারি শিল্প বাতাসে বায়ুদূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে তুলছে। সমলোচকরা বলছেন, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিবেশবাদীদের সমন্বয়হীনতার কারণে রাজধানী ঢাকার পরিবেশ পরিস্থিতির কোনো দৃশ্যমান উন্নতি হচ্ছে না। বায়ুদূষণকে সহনীয় পর্যায়ে আনতে হলে সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, গ্যাস কোম্পানিগুলো, বিদ্যুৎ বিভাগ, বিআরটিএ, কারখানা পরিদর্শন অধিদফতর ও পুলিশের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। আর আমারা মনে করি, পরিবেশ দূষণ রোধে রাজধানীর সব সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে নগর সরকারের মতো একটি একক ছাতার নিচে নিয়ে আসা প্রয়োজন।

বায়ুদূষণের কারণগুলো বন্ধ করার জন্য সরকার ও জনগণ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। সনাতন ইটভাটার পরিবর্তে আধুনিক প্রযুক্তির দিকে যেতে হবে আমাদের। দেশের দেড় হাজারের বেশি সনাতন ইটভাটা দ্রুত বন্ধ করা উচিত। ইটের বিকল্প ব্লক এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে। ব্লকের ব্যবহার বাড়াতে পারলে বায়ুদূষণ রোধের সঙ্গে রক্ষা পারে দেশের উর্বর কৃষিজমি, বৃক্ষরাজি ও বনাঞ্চল। বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। আর বায়ুদূষণের কারণে শিশুমৃত্যুর হারের দিক থেকে পাকিস্তানের পরই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহর হলো ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের গুরুগ্রাম। যেখানে বাতাসে পিএম ২ দশমিক ৫-এর মাত্রা ২০০-এর বেশি। তালিকায় শীর্ষ ১০টি দূষিত শহরের মধ্যে গুরুগ্রামের পরই রয়েছে দিল্লিসংলগ্ন ভারতের আর একটি শহর গাজিয়াবাদ। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তানের ফয়সালাবাদ। এরপর চতুর্থ, পঞ্চম , ষষ্ঠ ও সপ্তম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ভারতের ফরিয়াবাদ, ভিবাডি, নয়ডা ও পাটনা। অষ্টম স্থানে আছে চীনের হুতাম শহর এবং নবম স্থানে রয়েছে ভারতের লক্ষেèৗ ও দশম স্থানে রয়েছে পাকিস্তানের লাহোর শহর। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার মহাখালী, ফার্মগেট, মগবাজার, সোনারগাঁও এবং সায়েন্স ল্যাব এলাকার বাতাসে বিষাক্ত গ্যাসের আধিক্য স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি এবং এসব এলাকায় বসবাসকারী মানুষ সর্বাধিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৭০ লাখ লোক এখন হাঁপানি রোগে ভুগছে, যার অর্ধেকই শিশু। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের এক হিসাব অনুযায়ী বলা হয়, যদি বায়ুদূষণের পরিমাণ ২০ ভাগ কমানো যায়, তাহলে স্বাস্থ্যরক্ষার খরচ বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার কমে আসবে। বায়ুদূষণ নীতিমালা প্রণয়ন ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে নির্মল বায়ু ও পরিবেশের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৪৬ কোটি ৪ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও বায়ুদূষণ রোধে তার অগ্রগতি তেমন দৃশ্যমান নয়। নির্মল বায়ু এবং টেকসই পরিবেশ ব্যতীত টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই বায়ুদূষণ থেকে রক্ষা পেতে হলে আরো ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বায়ুদূষণ রোধে কিছু বাস্তব ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বেইজিংয়ের বাতাসের গুণগত মানের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। ২০১৭ সালে বেইজিংয়ের বাতাসে অন্যতম দূষক পিএম ২ দশমিক ৫-এর গড় ঘনত্ব ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৫৮ মাইক্রোগ্রাম, যা ২০১৬ সালের তুলনায় ২০ শতাংশ কম। জ্বালানি ,শিল্প ও যোগাযোগ কাঠামো সুসংহত করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বায়ুদূষণ রোধে কাজ করা হয়েছে প্রচুর। গত বছর পরিচ্ছন্ন জ্বালানির সংস্কার, গ্রামে কয়লা ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংস্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া বেইজিং কর্তৃপক্ষ কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ, পরিবেশবান্ধব প্রতিষ্ঠান বা কর্মকান্ডকে অর্থনৈতি প্রণোদনা প্রদান এবং পরিবেশ সুরক্ষার মানদন্ড প্রণয়ন করাসহ বিভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগের মাধ্যমে বায়ুর গুণগত মান সার্বিকভাবে উন্নত করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে বেইজিং শহর কর্তৃপক্ষ অব্যাহতভাবে পিএম ২ দশমিক ৫ দূষণমুক্ত করতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আইন, অর্থনীতি ও বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে দূষণকারী পদার্থের নির্গমন কমানোর কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নগর কর্তৃপক্ষ, যার মাধ্যমে ২০২০ সালে বেইজিং শহরে পিএম ২ দশমিক ৫-এর গড় ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে ৫৬ মাইক্রোগ্রামে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আমাদের কথা হলো, চীন যদি বেইজিংয়ের বায়ুদূষণ মাত্রা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমাতে পারে, তাহলে ঢাকার বায়ুদূষণও কমানো সম্ভব। প্রয়োজন শুধু সময়মতো সঠিক ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।

লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড, নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close