আজহার মাহমুদ

  ১০ মার্চ, ২০১৯

শব্দ-সন্ত্রাস

শ্রবণশক্তি কেড়ে নিচ্ছে

শব্দদূষণ। খুব সহজেই আমরা এ দূষণের সঙ্গে মানিয়ে চলি। কিন্তু এই শব্দদূষণ বর্তমানে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, একে ‘শব্দ-সন্ত্রাস’ নামে অভিহিত করা যায়। এটা আমার কথা নয়, পরিবেশবাদীরাই এ কথা বলছেন। আবাসিক, অনাবাসিক এলাকা, অফিসপাড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি হাসপাতালের আশপাশেও শব্দদূষণের তীব্রতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। শব্দদূষণের মাত্রা এখন সবস্থানেই ছড়িয়ে যাচ্ছে। যা জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে।

পরিবেশ অধিদফতরের হিসেব মোতাবেক যে কোনো শহরে শব্দের মাত্রা দিনে সর্বোচ্চ ৪৫ ডেসিবেল এবং রাতে ৩৫ ডেসিবেল পর্যন্ত সহনীয়। অপরদিকে শয়নকক্ষের জন্য আলাদা পরিমাপ রয়েছে। সেটি ২৫ ডেসিবেলের ওপরে অনুমোদিত নয়। অফিস-আদালতের ক্ষেত্রে ৩৫ থেকে ৪০ এবং হাসপাতালের জন্য অনুমোদিত শব্দের পরিমাপ ধরা হয়েছে ২০ থেকে ২৫ ডেসিবেল। অথচ এসবের ধারেকাছেও নেই নগরীগুলোর শব্দের মাত্রা। বরং বহুগুণ শব্দের তা-বে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।

মানুষের শ্রবণযোগ্য শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল হলেও বর্তমানে আমরা অনায়াসে ৬০ থেকে ৭০ ডেসিবেল শব্দের মাত্রা সহ্য করে যাচ্ছি। অথচ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মতে, ৭৫ ডেসিবেল কিংবা তার বেশি মাত্রার শব্দদূষণ হলে মানুষ ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ৮০ ডেসিবেলের অতিরিক্ত মাত্রার শব্দ মানুষের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। তথাপিও আমাদের তা শ্রবণ করতে হচ্ছে। যা দেশের সবস্থানেই এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাস্তার পাশে কিংবা অলিতে-গলিতে সাউন্ডবক্সের আওয়াজ মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। নিয়ম লঙ্ঘন করে যত্রতত্র গাড়ির হর্ন বাজানো হচ্ছে। টাইলস বসানো, ইটভাঙার মেশিন কিংবা বড় বড় দালান নির্মাণের ক্ষেত্রে পাইলিং মেশিনের উচ্চমাত্রার আওয়াজ মানুষকে নাজেহাল করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। এটা শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম এলাকায় হচ্ছে তা কিন্তু নয়। দেশের সর্বত্রই একই অবস্থা। রাস্তা-ঘাটে বেরুলেই যত্রতত্র শোনা যায় মাইকিং, ভটভটি বা নসিমন গাড়ির অস্বস্তিকর আওয়াজ, বিয়ে কিংবা গায়ে-হলুদে উচ্চস্বরে গান-বাজনা, সবমিলেয়ে ভয়ংকর এক অবস্থা। এসব আওয়াজ অনবরত শ্রবণের ফলে মানুষ তার শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে। এ ধরনের বিরতিহীন শব্দদূষণের ফলে মানুষ উচ্চরক্তচাপ, শিরঃপীড়া, মানসিক অসুস্থতা, স্নায়ুবিক বৈকল্য, আত্মহত্যার প্রবণতা, আক্রমণাত্মক মনোভাবের উদ্রেক, হৃদরোগসহ নানা জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। অনবরত শব্দদূষণের ফলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদেরও ক্ষতি করে। তাদের নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটে। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। মহল্লায় বা কোনো এলাকায় উচ্চ ভলিওমে সিডি প্লেয়ার বাজালে, মাইকিং হলে এলাকার লোকদের স্বাভাবিক কাজকর্মে বাধার সৃষ্টি করে। বিশেষ করে যারা অসুস্থ বা পরীক্ষার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন তাদের শব্দদূষণে বেশি ক্ষতি হয়। আমাদের আশপাশে অনেকেই রয়েছেন, যারা দূরে কোথাও গাড়ি করে গেলে মাথা ঘুরায় এবং বমি করেন এবং অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এটাকে আমরা সহজভাবেই নিই। আমাদের ধারণা যারা দুর্বল তারা গাড়িতে চড়লে এমন করেন। কিন্তু আসলে তা নয়। মূল কথা হচ্ছে এদের মস্তিষ্ক শব্দ সহ্য করতে পারে না। আর তাই গাড়ির শব্দ শুনার কারণে এমনটা হয়। দীর্ঘক্ষণ গাড়ির শব্দ শুনতে শুনতে অনেকের মস্তিষ্কে এ সমস্যা হয়। ফলে বমি, মাথাব্যথা, মাথা ঘুরানো ইত্যাদি সৃষ্টি হয়।

অপরদিকে শব্দদূষণের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। শিশু-কিশোরদের মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে শব্দ দূষণের তা-বে। বেশির ভাগ শিশু সম্প্রতি কানে কম শোনা রোগে ভুগছে বলে শিশু বিশেষজ্ঞ ও ডাক্তাররা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। শব্দদূষণের ফলে কানের নানা ধরনের ব্যাধির কথা এখন শোনা যায়। কানের পর্দা ফেটে যায় অসহনীয় শব্দ হলে। বয়স্কদের মধ্যে গ্যাস্ট্রিক, আলসার এবং ডায়াবেটিস রোগ হওয়ার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে শব্দদূষণ একটি বড় কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা বলছে। উচ্চশব্দ হলে হার্টের বিট বেড়ে যায়। ফলে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়। শুধু মানুষই নয় জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রেও শব্দদূষণ মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শব্দদূষণে এত খারাপ দিক থাকা সত্ত্বেও এর প্রতিকারের জন্য অদ্যাবধি ব্যাপক কোনো কর্মসূচি সরকারিভাবে গ্রহণ করা হয়নি। অবাধে এ দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়া দেখে মনে হচ্ছে দেশে এ বিষয়টা দেখার কেউ নেই।

শব্দদূষণের ব্যাপারে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা যথেষ্ট সোচ্চার। সংস্থাটি এ ব্যাপারে সতর্কবাণী প্রেরণ করছে বিশ্বের সমগ্র দেশে। শব্দদূষণের ক্ষতির দিক চিহ্নিত করতে ইউনিসেফ এবং বিশ্বব্যাংক একাধিকবার গবেষণায় জড়িত হয়েছে। গবেষণায় দেখা যায়, ৩০টি জটিল রোগের অন্যতম কারণ পরিবেশ দূষণ। তার মধ্যে শব্দদূষণ অন্যতম। জরিপে দেখা যায়, শব্দদূষণের শিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরাও। সেখানে এরই মধ্যে ১১ শতাংশ লোক তাদের শ্রবণশক্তি হারিয়েও ফেলেছে। দুর্ভাগ্যজনক সত্যটি হচ্ছে, আমাদের দেশে এ ধরনের পরিসংখ্যান না থাকাতে তার সঠিক হিসাব জানা যায়নি আজ অবধি। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোনোক্রমেই আমাদের দেশে শব্দদূষণে আক্রান্তের সংখ্যা কম নয়।

কিন্তু এভাবে আর কত দিন? এই অবস্থা থেকে অবশ্যই আমাদের পরিত্রাণ পেতে হবে। দেশবাসীকে একটি স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ দিতে হলে অবশ্যই শব্দদূষণ রোধ করার বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে এবং এই আইনের বিধান লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক আরেকটি আইন জারি করতে হবে। তাই শব্দদূষণ থেকে দেশের মানুষকে বাঁচাতে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। গণমাধ্যমেও এর কুফল এবং সমস্যাগুলো তুলে ধরতে হবে। তাতে শব্দদূষণের মাত্রা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close