এস এম মুকুল

  ০৬ মার্চ, ২০১৯

পর্যালোচনা

প্রেমের উপাখ্যান

গবেষণায় পাওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, ঘনিষ্ঠ হওয়ার আগে যেসব যুগল একে অপরকে জানতে পারে, সে সম্পর্ক স্থায়ী হওয়ার সুযোগ বেশি। তবে মাঝে মাঝে খুব অল্প সময়ের পরিচয়ও প্রকৃত ভালোবাসায় পরিণত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে আইওয়া ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক অ্যান্থনি পেইক বলেন, ‘মানুষের চরিত্রের কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে শারীরিক সম্পর্কে জড়ানোর আগে অপেক্ষা করার সঙ্গে সম্পর্কের স্থায়িত্বের বিষয়টি জড়িত।’ তবে সম্পর্কের সূচনায় শারীরিক মেলামেশা নেতিবাচক কোনো প্রভাব ফেলে গবেষণা থেকে এমন কিছু বেরিয়ে আসেনি। পেইকের এ গবেষণা সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চে প্রকাশ হয়। গবেষণায় অংশ নেওয়া ৬৪২ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে ৫৬ শতাংশই জানান, সম্পর্ক গভীর হওয়ার জন্য প্রতীক্ষা করতে হবে। অন্যদিকে ২৭ শতাংশ জানান, সাধারণ দেখা-সাক্ষাতের সময়ও তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়। আর ১৭ শতাংশ ভালোবাসার সম্পর্ক ছাড়াই শারীরিকভাবে ঘনিষ্ঠ হয়।

ভিক্টর হুগো রোমান্টিক সাহিত্য ধারাতে অবগাহন করেছেন অনায়াসে। রোমান্টিসিজমের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করে সঠিক নির্যাস বের করে আনতেন অপূর্ব দক্ষতায়। রুপালি পর্দার গল্পের মতোই ধনী-গরিবের পার্থক্য তাদের মধ্যে দেয়াল হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। পাশ্চাত্যে প্রচলিত রূপকথার গল্পে আছে, এক রাজকুমারী রাস্তায় পড়ে থাকা একটি ব্যাঙকে চুমু খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙটি রাজপুত্র হয়ে যায়। ওয়েস্টলিংয়ের বেলায়ও তাই ঘটেছে। রাজকুমারী ভিক্টোরিয়ার ছোঁয়ায় তিনি সামান্য শরীরচর্চার প্রশিক্ষক থেকে যুবরাজ হয়ে গেলেন। খাদ্যাভ্যাসের কারণে বিপর্যস্ত ভিক্টোরিয়া একসময় তার অবসর কাটাতে রাজধানী স্টকহোমের একটি ব্যায়ামাগারে যাতায়াত শুরু করেন। সেখানেই ড্যানিয়েলের সঙ্গে তার দেখা এবং ভালোলাগা, ভালোবাসা। রাজার মেয়ের প্রেম বলে কথা! ২০০২ সালে সুইডিশ সংবাদমাধ্যম ভিক্টোরিয়া-ড্যানিয়েলের সম্পর্কের কথা ফাঁস করে দেয়। সঙ্গে তাদের ছবিও ছাপা হয়। ভিক্টোরিয়ার বাবা ক্ষমতাসীন রাজা ষোড়শ গুস্তাভও (৬৪) তাদের সম্পর্কের মাঝে ‘ভিলেন’ হিসেবে আবির্ভূত হন। কারণ তখন ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে ডেনমার্কের রাজপুত্রের বিয়ের কথা চলছিল। তার বদলে কোনো অজপাড়াগাঁয়ের নাম-পরিচয়হীন যুবক তার মেয়েকে বিয়ে করতে এসেছে। গ্রাম্য এ যুবকের সঙ্গে রাজপরিবারের সম্পর্কের কথা ভাবতেও পারছিলেন না গুস্তাভ। পোস্ট অফিসের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী ড্যানিয়েলের মা আর স্থানীয় কাউন্সিলের সাবেক কর্মচারী বাবা স্টকহোম থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার উত্তরে ওকেলবো অঞ্চলে থাকেন। এত সব চাপের মুখে ২০০৪ সালে একবার ভিক্টোরিয়া-ড্যানিয়েলের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার জোগাড় হয়। তবে ঘুরে দাঁড়ান ভিক্টোরিয়া। ড্যানিয়েলকে তিনি রাজপরিবারের শিষ্টাচার শেখানো শুরু করেন। অভিজাত সমাজে খাওয়া, বলা, চলার আদবকেতা শেখানো হয় ড্যানিয়েলকে। সুইডেনের ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কেও জ্ঞান দেওয়া হয়। পাশাপাশি চলতে থাকে রাজাকে বোঝানো। শেষ পর্যন্ত ভিক্টোরিয়া বাবাকে বোঝাতে সক্ষম হন। ড্যানিয়েলই তার সত্যিকারের প্রেম। মেয়ের প্রত্যয়ের কাছে হার মানেন বাবা। পরে শুভদিন দেখে বাগদানও হয়ে যায়। ১৯৮১ সালে প্রিন্স চার্লস ও ডায়ানার বিয়ের পর সবচেয়ে বড় ও ধুমধামে রাজকীয় বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে প্রস্তুত হচ্ছে ইউরোপ। এবারের কুশীলব সুইডেনের সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী প্রিন্সেস ভিক্টোরিয়া এবং একসময়ের সাধারণ গ্রাম্য তরুণ ড্যানিয়েল ওয়েস্টলিং। ১৯ জুন ২০১৮, রাজধানী স্টকহোমের রাজপ্রাসাদে বসে তাদের বিয়ের আসর। চলে তিন দিন। রূপকথার এ বিয়ে ঘিরে ধুমধাম হয়েছে বলা যায় রূপকথার মতোই।

১. রোমান্টিসিজমের অগ্রদূত ও ঊনিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী কবি ফরাসি সাহিত্যক ভিক্টর হুগো। ফরাসি এ লেখক ছিলেন একাধারে সাহিত্যক, রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকার কর্মী। তার সময়ের বহু তরুণ লেখকের মতো হুগোও গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন রোমান্টিসিজম নামক সাহিত্যিক ধারার অগ্রপথিক। হুগো যৌবনে এ প্রতিজ্ঞাও করেছিলেন যে, তিনি হয় স্যাচুব্রায়ান্ডের মতো হবেন অথবা কিছুই হবেন না। ঈযধঃবধঁনৎরধহফ-এর মতো হুগোও রোমান্টিসিজমের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যান। তার রচনায় এ রকম অকালপক্ব আবেগ এবং বাগ্মিতার কারণে অল্প বয়সেই সাফল্য এবং খ্যাতি অর্জন করেন হুগো। ১৮২৬ সালে প্রকাশিত ঙফবং বঃ ইধষষধফবং বইটিই তাকে একজন মহান কবি, সুরকার এবং গীতিকার হিসেবে সবার কাছে উন্মোচিত করে দেয়। সারা বিশ্বে ভিক্টর হুগোর পরিচিত এক অসাধারণ ঔপন্যাসিক হিসেবে। কিন্তু তার মেধা অনেক দিকেই পরিব্যাপ্ত ছিল, যা আজও শিল্পবোদ্ধাদের চিত্তাকর্ষণ করে অনন্য মহিমায়। ভিক্টর মারি হুগো ঠরপঃড়ৎ-গধৎরব ঐঁমড় ১৮০২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের বেসানকনে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম যোসেফ লিওপল্ড সিগিসবার্ট হুগো এবং মাতা সোফি ট্রেবাচেট। যদিও হুগো তাদের বৈধ সন্তান ছিলেন না। ভিক্টরের বাবা ছিলেন নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বাবার চাকরির সুবাদে তাদের পরিবারটি কখনোই এক জায়গায় স্থায়ী ছিল না। এর ফলে শৈশবেই হুগোর ভ্রমণজনিত অভিজ্ঞতা বেশ হৃদ্ধ হয়। রিপাবলিকানিজমের সমর্থক হিসেবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। একই কারণে নির্বাসনেও যেতে হয় তাকে। কবিতা, উপন্যাস, নাটক আর অনন্য চিত্রকর্ম দিয়ে বিশ্বজয়ের মালা পরেছিলেন কালজয়ী এ ফরাসি লেখক। অল্প বয়সেই সাহিত্যের বিশাল দুনিয়ায় পেয়েছেন অগাধ পরিপক্বতা। ১৮২২ সালে প্রকাশিত প্রথম কাব্য ভলিউম ‘ওড অ্যাট পজেসিস ডাইভার্স’ থেকে সহজেই তা অনুমেয়। ১৮২৩ সালে ২১ বছর বয়সে তার প্রথম উপন্যাস ‘দি হ্যান্ড আইল্যান্ড’ প্রকাশিত হয়। ১৮২৬ সালে প্রকাশিত ‘অড টু ব্যালাডস’ তার কাব্য প্রতিভার অনন্য প্রকাশ। এর প্রতিটি ছত্রে বিকশিত হয়েছে জীবন বাস্তবতা, নিসর্গ প্রেম আর মানবিক সৌন্দর্যের অনুভূতি। ১৮৩০ সালে তিনি তার বিবেক সত্তার তাড়নায় লিখেন ‘হাঞ্চ ব্যাক অব নটর ডেম’। সামাজিক দায়বোধের চেতনা থেকে লিখে ফেলা এই উপন্যাস তাকে এনে দেয় বিশ্বজোড়া খ্যাতি। এরপর লিখেছেন বিশ্ব সাহিত্যের ক্লাসিক উপন্যাস ‘লা মিজারেবল’। সমাজের চতুর্কোণে লুকায়িত ঘনীভূত অপরাধ, সামাজিক সমস্যা, মানুষের জীবন বিড়ম্বনা, অপরিমেয় প্রাণ প্রাচুর্য আর উত্থান-পতনের এক মহা উপাখ্যান এই ‘লা মিজারেবল’। লা মিজারেবল রচনা করতে গিয়ে তাকে জীবনের ১৭ বছর সাধনা করতে হয়েছে। ১৭ বছরের প্রচেষ্টায় ১৮৬১ সালে এই মহাকাব্যিক উপন্যাস প্রকাশিত হয়। সে কারণেই এই গ্রন্থ যুগের পর যুগ পাঠকের কাছে মহাসম্পদ হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। উপন্যাসটিকে এখনো বিশ্ব সাহিত্যের এক কালজয়ী সম্পদ মনে করা হয়। তার অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে ‘টয়লার্স অব দ্য সি’ এবং ‘দ্য ম্যান হু লাফস অন্যতম’। সাহিত্য সমালোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন ‘ফিলোসফি অব লিটারেচার’।

২. নাম তার রোজ। গোলাপ ফুল তার খুব পছন্দ। তার স্বামী তাকে প্রতিটি ভ্যালেন্টাইনস ডেতে একগুচ্ছ গোলাপ পাঠাত আর সঙ্গে থাকত একটি করে কার্ড, যেখানে লেখা থাকত সে তাকে কতটা ভালোবাসে। এক দিন তার স্বামী মারা যায়। কিন্তু স্বামী মারা যাওয়ার এক বছর পরের ভ্যালেন্টাইন ডেতেও রোজ একইভাবে কার্ডসহ গোলাপের তোড়া পেল, কার্ডে লেখা ছিলÑ ‘আমি গত বছরের এই দিনে তোমাকে যতটুকু ভালোবাসতাম, এখন তার থেকে আরো বেশি ভালোবাসি। প্রতিটি বছর পার হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমার জন্য আমার এই ভালোবাসা আরো বাড়বে’। রোজ ভাবল, তার স্বামী হয়তো মারা যাওয়ার অনেক আগেই তার জন্য গোলাপের অর্ডার দিয়ে রেখেছিল আজকের দিনটির জন্য। সে মন খারাপ করে ভাবল এটাই তার শেষ ভ্যালেন্টাইন ডে। এটাই স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া গোলাপের তোড়া। সে ফুলগুলোকে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখল আর তার স্বামীর ছবি দেখেই দিনটি কাটিয়ে দিল। এভাবে আরো এক বছর কেটে গেল। এই এক বছর ভালোবাসার মানুষটিকে ছাড়া একা একা থাকা রোজের জন্য ছিল খুবই কষ্টের।

আবার এলো সেই দিন। ভ্যালেন্টাইনস ডে। সকালে তার বাসায় কেউ একজন বেল বাজাল। সে দরজা খুলে দেখতে পেল দরজার সামনে কার্ডসহ গোলাপের তোড়া রাখা। সে অবাক হয়ে কার্ডটি পড়ে দেখল এটা তার স্বামী পাঠিয়েছে। এবার সে রেগে গেল, কেউ তার সঙ্গে মজা করছে ভেবে। সে ফুলের দোকানে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে জানতে চাইল, এই কাজ কে করেছে। দোকানদার তাকে বলল, ‘আমি জানি আপনার স্বামী এক বছর আগে মারা গেছেন, আমি এও জানি আপনি আজকে আমাকে ফোন করে সব জানতে চাইবেন। আপনার স্বামী আগে থেকেই সব পরিকল্পনা করে রাখতেন। তিনি অনেক আগেই আমাকে বলে রেখেছিলেন আপনাকে যেন প্রতি ভ্যালেন্টাইন ডেতে আমার দোকান থেকে গোলাপ ফুল পাঠানো হয়। তিনি আগাম টাকা পরিশোধ করে গেছেন। আরো একটি জিনিস আছে, যা আপনার জানা দরকার। আপনার স্বামী আমার কাছে আপনার জন্য একটি বিশেষ কার্ড লিখে রেখে গেছেন, তিনি বলেছিলেন যদি আমি কখনো জানতে পারি যে, তিনি মারা গেছেন, শুধু তাহলেই যেন কার্ডটি আপনাকে দেওয়া হয়। আমি আপনাকে কার্ডটি পাঠিয়ে দেব।’

রোজ কার্ডটি হাতে পেল। সে কাঁপা কাঁপা হাতে কার্ডটি খুলে দেখতে পেল, সেখানে তার স্বামী তার জন্য কিছু লিখেছে, ‘আমি জানি আমার চলে যাওয়ার এক বছর পূর্ণ হয়েছে, এই এক বছরে তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে। কিন্তু মনে রেখ, আমি তোমাকে সব সময় সুখী দেখতে চেয়েছি, তোমার চোখের পানি নয়। তাই প্রতি বছর তুমি আমার কাছ থেকে ফুল পাবে। যখনই তুমি ফুলগুলো পাবে, তখন ফুলগুলোকে দেখে আমাদের ভালোবাসার কথা মনে করবে। মনে করবে আমাদের একসঙ্গে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলোকে। সব সময় হাসিখুশি থাকতে চেষ্টা করবে, আমি জানি, এটা অনেক কঠিন হবে, তবু আমি আশা করি তুমি পারবে। প্রতি বছর তোমাকে গোলাপ পাঠানো হবে একবার করে। তুমি যদি ফুলগুলোকে কোনো এক দিন না নাও, তাহলে দোকানি সেদিন তোমার বাসায় পাঁচবার যাবে, দেখার জন্য যে তুমি বাইরে গেছ কি না। শেষবার দোকানি অবশ্য জানবে তুমি কোথায়। সে তখন ফুলগুলোকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে আসবে, যেখানে তুমি আর আমি আবার একবারের মতো একসঙ্গে হব চিরদিনের জন্য। তুমি সব সময় মনে রাখবে, আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি’...

লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close