হাসান জাবির

  ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

পর্যালোচনা

আইএনএফ চুক্তির অবসানে...

গত কয়েক মাস থেকেই বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দ্র ছিল আইএনএফ চুক্তি বা ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস ট্রিটি। তখন থেকেই রুশ-মার্কিন এ দ্বিপক্ষীয় চুক্তি থেকে একতরফাভাবে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিল আমেরিকা। অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ায় বিশ্বে অস্ত্র প্রতিযোগিতা তীব্র হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ দীর্ঘদিন থেকে ইউরোপের পরমাণু যুদ্ধের নিবারক হিসেবে কাজ করে আসা আইএনএফ চুক্তি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এ চুক্তির আনুষ্ঠানিক অবসান হলে পাল্টে যাবে বৈশ্বিক সামরিক প্রেক্ষাপট। যে কারণে এ চুক্তি উত্তর বিশ্ব বিঘিœত করবে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া। একই সঙ্গে ক্রমেই অনিরাপদ করে তুলবে বিশ্ব। আমরা যদি এ চুক্তি স্বাক্ষরের ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে লক্ষ করব, গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে রুশ ভূখন্ডের ইউরোপীয় অংশের প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল এসএস-৪ ও এসএস-৫। পরবর্তী সময়ে রাশিয়া তৈরি করে ওই সিরিজের মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এসএস-২০। ১৯৭৭ সালে এ অস্ত্র পূর্ব ইউরোপে মোতায়েন করে রাশিয়া। ফলে পশ্চিম ইউরোপের সামরিক নিরাপত্তাসংক্রান্ত মার্কিন দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ইউরোপের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের নিয়ে ওই সমন্বিত বৈঠকে বসে ন্যাটো। তারা ওয়ারশভুক্ত দেশগুলোতে এসএস-২০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা মোতায়েনের বিরোধিতা করে। যে কারণে এ উৎকণ্ঠা অবসানে শুরু হয় রুশ-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় আলোচনা। ৮২ সালে আমেরিকা প্রণীত চারটি খসড়ার ভিত্তিতে ১৯৮৭ সালের ৮ ডিসেম্বর সম্পাদিত হয় পরমাণু অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ-সংক্রান্ত ঐতিহাসিক ‘ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস’ বা আইএনএফ ট্রিটি। এ চুক্তির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপের ভূমিতে পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম ৫৫০ থেকে ১ হাজার কিংবা ৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটার গতির ক্ষেপণাস্ত্র কিংবা স্বাধীনভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র মোতায়েন না করা। একই সঙ্গে এ ধরনের অস্ত্রের উৎপাদন, মজুদ সীমিত করা। যদিও ইউরোপের জলভাগকে এ চুক্তির আওতার বাইরে রাখা হয়েছিল। উল্লেখ্য, স্নায়ুযুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী যুগে আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পাদিত নিরস্ত্রীকরণ-সংক্রান্ত চুক্তিগুলো যেমনÑ সল্ট, এবিএম, স্ট্যার্ট-১ ও ২ ইত্যাদির সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সম্পৃক্ত আইএনএফ চুক্তিটি। অতি সম্প্রতি রাশিয়ার বিরুদ্ধে শর্ত ভঙ্গের অভিযোগ এনে আমেরিকা একতরফাভাবে এ চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেছে। চুক্তি টিকিয়ে রাখার পক্ষে ক্রেমলিনের বক্তব্য, আইএনএফ চুক্তিটি অকার্যকর হলে নিরস্ত্রীকরণের যাবতীয় প্রক্রিয়াই বাধাগ্রস্ত হতে পারে। উভয় দেশের সংসদের বাধ্যতামূলক অনুসমর্থনের শর্ত পূরণ হওয়ার পর ১৯৮৮ সালের ১ জুন থেকে চুক্তিটি কার্যকর হয়। ওই চুক্তির আলোকেই ১৯৯১ সালের মধ্যে উভয় দেশ প্রায় ২ হাজার ৬৯২টি কৌশলগত মজুদ অস্ত্র ধ্বংসের ব্যাপারে একমত হয়। কিন্তু হঠাৎ করে কংগ্রেশনাল অনুমোদন ছাড়াই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়েছেন। এ ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করছেন কিনা, তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। এরচেয়েও বড় ব্যাপার হচ্ছে, আমেরিকা কি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণ করতে এ চুক্তি থেকে বের হতে চাইছে। এ ব্যাপারে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ উত্থাপন ছাড়াও হোয়াইট হাউস চীনের ভূমিকা নিয়ে মৃদু স্বরে আপত্তি উপস্থাপন করেছে। রুশ-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় আইএনএফ চুক্তিতে চীন সংযুক্ত নয়। ওয়াশিংটন মনে করছে, এতে করে বেইজিংয়ের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র-সংক্রান্ত সামরিক অভিপ্রায় আইনি সীমাবদ্ধতায় সীমিত হচ্ছে না। আইএনএফের আওতায় আমেরিকা ও রাশিয়া অস্ত্র সংবরণ করলেও এশিয়ায় চীন তার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা বাড়িয়েই নিচ্ছে। যে কারণে এশিয়ার দিকে নজর দিতে যুক্তরাষ্ট্র এ কাজে উৎসাহিত হতে পারে, এমন আভাস দিচ্ছে পশ্চিমা গণমাধ্যমের বিভিন্ন বিশ্লেষণ। সর্বশেষ সাংগ্রিলা নিরাপত্তা সম্মেলনে এশিয়ার নিরাপত্তা কাঠামোর ধরন নিয়ে প্রকাশ্য বিবাদে জড়ায় পেন্টাগন ও পিএলএ প্রধান। ওই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘চীন ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ব্যাপকভিত্তিক মোতায়েনের মাধ্যমে প্রতিবেশীদের ভয় দেখাচ্ছে।’ তার এ বক্তব্যে স্পষ্ট হয় চীনের ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতায় ওয়াশিংটনের উদ্বেগ আছে। অন্যদিকে সম্প্রতি অনুষ্ঠেয় মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনেও চীনের ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা নিয়ে আলোচনা হয়। ওই আলোচনায় জার্মানির পক্ষ থেকে চীনের ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন হ্রাস করার দাবি করা হলেও চীন এ প্রস্তাব তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করে। এশিয়ার নিরাপত্তাসংক্রান্ত নয়া মার্কিন নীতির কেন্দ্রীয় লক্ষ্যই হচ্ছে নিজের আঞ্চলিক মিত্র ও বেইজিংয়ের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত দেশগুলোর নিরাপত্তা উৎকণ্ঠার অবসান করা। এ সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য অর্জনে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ায় নিজের অবস্থানগত ভারসাম্য বজায় রাখতে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

এসব ঘটনার পর্যালোচনা থেকে অনুমান করা সম্ভব যে, আমেরিকা প্রয়োজনে এশিয়ায় প্রচলিত ও অপ্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে প্রস্তুত। এ ক্ষেত্রে আইএনএফ চুক্তি বয়কট, সে ক্ষেত্র তৈরিতে সহায়তা করবে। ফলে ইউরোপের পরমাণু নিরাপত্তাসংক্রান্ত উত্তাপ ছড়িয়ে পড়তে পারে এশিয়ায়। এমনটি হলে চীনা ক্ষেপণাস্ত্রের হুমকিতে থাকা এশীয় দেশগুলোকে একাট্টা করা সক্ষম হবে। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে ইউরোপের নিরাপত্তা উদ্বেগ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অপেক্ষাকৃতভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ। লক্ষ করা যাচ্ছে, ইইউয়ের প্রথম সারির দেশগুলোর সঙ্গে আমেরিকার সামরিক-অর্থনৈতিক মতবিরোধ বাড়ছে। যে কারণে মার্কিন পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার পাচ্ছে পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো। অবশ্য পূর্ব ইউরোপের দেশ পোল্যান্ড ও রুমানিয়ায় মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের মধ্য দিয়েই আইএনএফ চুক্তিটির কার্যকারিতা ঝুঁকির মুখে পড়ে গত দশক থেকে।

এ কথা সবারই জানা যে, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার হাতে আছে এমন সব অত্যাধুনিক অস্ত্র, যা দিয়ে পৃথিবীকে কয়েকবার ধ্বংস করা সক্ষম। এ অস্ত্রগুলো মার্কিন ও রুশ ভূখন্ডের যে কোনো স্থান থেকেই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। এতদসত্ত্বেও কৌশলগত কারণে উভয় দেশের কাছেই চুক্তিটি গুরুত্বপূর্ণ। চুক্তি অকার্যকর হলে রাশিয়ার ঝুঁকি ও দুশ্চিন্তা বেশি। এ চুক্তির অবসান হলে রাশিয়া মুক্তভাবে তার অস্ত্র মোতায়েন করতে পারবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছেÑ মস্কো কোথায় এসব অস্ত্র মোতায়েন করবে? পূর্ব ইউরোপের বর্তমান বাস্তবতা ভিন্ন। আবার রাশিয়া নিজ ভূখন্ডের ইউরোপীয় অংশে এসব অস্ত্র মোতায়েন করে থাকতে পারে। সম্ভবত এটি ন্যাটোর দৃষ্টি গ্রাহ্য হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রুশ ভূখন্ডে অস্ত্র মোতায়েনের জন্য রাশিয়া কোনো চুক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকবে না। এ ক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতিতে ন্যাটো কিংবা আমেরিকা আইনি সংকটের সুযোগে পূর্ব ইউরোপে আইএনএফ চুক্তির অন্তর্ভুক্ত বিজিএম-১০৯জি অথবা আইবি ক্ষেপণাস্ত্র কিংবা অন্য অস্ত্রগুলো মোতায়েন করতে চাচ্ছে। যা রাশিয়ার জন্য গুরুতর হুমকির সৃষ্টি করবে। ফলে প্রচলিত-অপ্রচলিত যুদ্ধের সমীকরণ পাল্টে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়বে রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা। রাশিয়া হয়তো পাল্টা ব্যবস্থায় সেন্ট্রাল এশিয়ায় তার সাবেক প্রজাতন্ত্রগুলোয় এ ধরনের অস্ত্র অর্থাৎ এসএস-২০, এসএস-২৩, এসএসসি-এক্স-৪ মোতায়েনের চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আবার রুশ-মার্কিন পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ-সংক্রান্ত ঝামেলা বৃদ্ধি পেলে সেটি হবে ইউরোপের জন্য অত্যন্ত দুঃসংবাদ। নতুন করে রুশ হুমকির মুখে থাকা ইউরোপ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে আরো বেশি মাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। রাশিয়ার চিন্তার কারণটি হচ্ছে পূর্ব ইউরোপ। মস্কো নিশ্চিত করেই জানে এ অঞ্চলে আমেরিকা তার ওইসব ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করলে প্রচলিত যুদ্ধের সমীকরণ রাশিয়ার অনুকূলে রাখা কঠিন হবে। এতে করে পূর্ব ইউরোপজুড়ে রাশিয়ার সেনা সক্ষমতাকে নিশ্চিতভাবেই টেনে ধরতে চাইছে ন্যাটো।

লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও

নিরাপত্তাবিষয়ক বিশ্লেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close