মোতাহার হোসেন

  ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

বিশ্লেষণ

রাজধানীর বাতাস অস্বাস্থ্যকর

ঢাকার জনজীবন প্রতিনিয়ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আক্রান্ত হচ্ছে। এর অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে যানবাহনের কালো ধোঁয়া আর দূষিত বাতাস। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে একটি প্রকল্পের আওতায় ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বসিয়ে ঢাকার বাতাসে দূষণ ও বিপদের মাত্রা, সেই সঙ্গে তাৎক্ষণিক করণীয় সম্পর্কে জানান দিয়েছে। ইন্টারনেটে এটি রিয়াল টাইম এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) নামে পাওয়া যাচ্ছে। ‘সার্বক্ষণিক বায়ুমান সূচক’ হিসেবে এ নিবন্ধে ব্যবহার করা হয়। এই মানই এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ও নির্ভরযোগ্য বায়ুমান সূচক হিসেবে দেশে দেশে স্বীকৃত। ১৫ দিনের বেশির ভাগ সময় ধরে এই সূচকের দিকে তাকিয়ে হতাশ হতে হয় প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষের আবাসস্থল এ ঢাকার বাতাসে দূষণ বা বিষাক্ত পরিবেশ দেখে।

মানুষের অবস্থা দেখে। মাত্র এক দিনের বায়ুমান সূচকে দেখা যায়, ঢাকার ওই সূচক হয়ে আছে লাল, মানে ঢাকার বাতাস অস্বাস্থ্যকর। বিশ্বের ১০ হাজার শহরের বায়ুমান জানায় কয়েকটি রং ও বাতাসে ভাসমান ক্ষতিকর বস্তুকণার (ওজন গ্যাস, হাইড্রোজেন সালফাইড, সিসা, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড) পরিমাণ দিয়ে। বায়ুমান ভালো হলে সবুজ, মোটামুটি ভালো হলে হলুদ আর অস্বাস্থ্যকর হলে কমলা, সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর হলে লাল রং ধারণ করে। অতি অস্বাস্থ্যকর হলে বেগুনি আর বিপজ্জনক হলে খয়েরি রং দিয়ে সূচকে চিহ্নিত করা হয়। গড়ে ১৫ দিনের ৩৬০ ঘণ্টার কোনো একটি মুহূর্তও সূচকটিতে ঢাকার রং সবুজ তো দূরের কথা হলুদ এমনকি কমলাও দেখা যায়নি। বেশির ভাগ সময় দেখা গেছে, বেগুনি রং, মানে অতিমাত্রায় অস্বাস্থ্যকর। এরপর বেশি দেখা গেছে লাল রং বা অস্বাস্থ্যকর। আর বিপজ্জনক রং খয়েরি দেখা গেছে লালের চেয়েও বেশি সময়। ওইদিনের সূচকে ৩৬ ঘণ্টার ঢাকার গড় বায়ুমান দেখানো হয়েছে বেগুনি রঙে অর্থাৎ অতি অস্বাস্থ্যকর। সূচকে অস্বাস্থ্যকর বায়ুর কারণে ঢাকার বাসিন্দারা স্বাস্থ্যগত সমস্যায় পড়তে পারেÑ এমন হুশিয়ারিও দেওয়া হয়। বায়ুদূষণের ফলে বক্ষব্যাধির রোগী ও শিশুদের নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ সময় ফুসফুসজনিত ও বক্ষব্যাধি রোগীদের বাইরে যেতে পুরোপুরি বারণ করা হয়। এ ছাড়া সুস্থ ব্যক্তিরাও বাইরে গিয়ে অসুস্থ হতে পারেÑ এমন সতর্কতাও দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্ষব্যাধি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কে এম মোশাররফ হোসেনের মতামত হচ্ছে, ‘বায়ুদূষণের ফলে সবচেয়ে বেশি রোগাক্রান্ত হয় শিশুরা। ঢাকা শহরের দূষিত বায়ুর কারণে প্রাথমিকভাবে অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে দূষিত বায়ুর মধ্যে থাকলে ফুসফুস, লিভার বা কিডনির ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’

বাংলাদেশে লাং ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক-বিষয়ক সম্পাদক ডা. সাইফুদ্দিন বেননূর বলেন, ‘বায়ুতে থাকা সিসা মস্তিষ্কের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এর ফলে মানুষ অল্প বয়সে, অসময়ে বয়স বাড়ছে, মস্তিষ্কের ক্ষমতা বা চিন্তা করার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। শিশুরা দুর্বল বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বেড়ে ওঠে। এ ছাড়া বায়ুতে থাকা ক্ষতিকর বস্তুকণা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে ফুসফুস শক্ত হয়ে অক্সিজেন প্রবেশে বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে ক্যানসারসহ নানা রোগে সংক্রমণ হচ্ছে।’ ঠিক এর পরদিন ওই সূচকের দিকে তাকিয়ে থেকে দেখা যায়, বিকেল ৩টা পর্যন্ত ঢাকা হয়ে আছে বেগুনি। আর সন্ধ্যা ৬টার দিকে হয়ে ওঠে খয়েরি, মানে বিপজ্জনক। এই দিনের সূচকে ঢাকার ৪৮ ঘণ্টার গড় বায়ুমান সূচক দেখানো হয় খয়েরি রঙে অর্থাৎ বিপজ্জনক। এমনি অবস্থায় ঘরের বাইরে বের হওয়া বিপজ্জনক। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এমন পরিস্থিতিতে ঢাকার মানুষ স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করছে, এ নিয়ে নগরবাসীর মাথাব্যথা নেই। রিপোর্ট অনুযায়ী শনিবার ছুটির দিনে সূচকে ঢাকার গত ৪৮ ঘণ্টার গড় বায়ুমান দেখানো হয়েছে বেগুনি রঙে অর্থাৎ অতি অস্বাস্থ্যকর। ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা, সড়কের ধুলা, যানবাহন এবং বায়োগ্যাস পোড়ানোকে দায়ী করে প্রতিবেদনে। ঢাকার বায়ুদূষণে ইটভাটা ৫৮ শতাংশ, সড়কের ধুলা ১৮ শতাংশ, যানবাহনের ধোঁয়া ১০ শতাংশ, বায়োগ্যাস পোড়ানো ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণ ৬ শতাংশ দায়ী বলে জানানো হয়। ইন্টারনেটের তথ্য অনুযায়ী, অন্যান্য দেশে বায়ুমান সূচক বিপজ্জনক এমনকি অস্বাস্থ্যকর দেখালেই ব্যাপক সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। শহরের উন্নয়নকাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রেও মানা হয় পরিবেশ সম্পর্কিত সব আইনকানুন। প্রতিবেশী দেশ ভারতের ১০টি শহরের বায়ুর মান দেখানো হয় একিউআইতে। সেখানকার বাতাস বিপজ্জনক বা অস্বাস্থ্যকর হলেই স্কুল-কলেজ ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি থাকলে বিদেশে স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। অথচ আমাদের দেশে বিষয়টি নিয়ে সরকারি কোনো সংস্থার মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। এ ছাড়া বায়ুদূষণ কমাতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর, আবহাওয়া অধিদফতরেরও কোনো ধরনের কর্মসূচি নেই। অথচ সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময় দেওয়া হয় আবহাওয়ার পূর্বাভাস। বায়ুর মান নিয়ন্ত্রণে নির্দিষ্ট কোনো কর্মসূচি না থাকার বিষয়টি সিটি করপোরেশন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর এবং আবহাওয়া অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন।

পরিবেশ অধিদফতরের ভাষ্যমতে, ‘বায়ুদূষণ পরিমাপের কোনো প্রকল্প এখন পরিবেশ অধিদফতরের হাতে নেই। উন্নয়ন প্রকল্প এলাকার ধূলিকণা ও মালামাল বায়ুদূষণের বড় কারণ। মেট্রোরেল, সড়ক উন্নয়ন, ভবন ভাঙাসহ বেশ কয়েকটি কারণে ঢাকার বায়ুর মান নিম্নতর। প্রকল্প এলাকায় পানি ছিটানোর ব্যাপারে এরই মধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এটি নিশ্চিত না করলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব বলা হলেও এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারটি দৃশ্যমান হচ্ছে না।

অবশ্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ চাইলে আবহাওয়া ও পরিবেশ অধিদফতরের মাধ্যমে বায়ুদূষণের মাত্রা জনগণকে অবহিত করতে পারে। পাশাপাশি বায়ুদূষণ, ঢাকার চার পাশের নদীদূষণ রোধ, ধুলোবালির থেকে পরিত্রাণে নগরীর সড়কসমূহে পানি ছিটানো, যানবাহনের কালো ধোঁয়া থেকে পরিত্রাণে মেয়াদ উত্তীর্ণ যানবাহন চলাচল বন্ধ করা, পাশাপাশি উন্মুক্ত স্থানে স্থাপিত হোটেল, মোটেলের চুলা, চিমনি থেকে নির্গত ধোঁয়া বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে সিটি করপোরেশনকে। পাশাপাশি এসব উদ্যোগে নগরবাসীকে সম্পৃক্ত করার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি, প্রচার-প্রচারণা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদরাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি বিআরটিএ, পরিবেশ অধিদফতর, বনবিভাগ, সড়ক বিভাগ, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, আবহাওয়া অধিদফতর, নিজ নিজ সংস্থার পক্ষ থেকে উদ্যোগী হলে এ ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে অনেকাংশে পরিত্রাণ সম্ভব। এটা এজন্যই দরকার, যেখানে ‘ঢাকার বেশির ভাগ মানুষ জানেই না যে তারা কত ভয়ংকর বায়ুদূষণের মধ্যে বাস করছে। অন্যান্য দেশের পরিবেশ ও আবহাওয়া বিভাগ থেকে তথ্য নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালানো হয়। আমাদের দেশে এসবের বালাই নেই। তাই শহরবাসী থাকে চরম ঝুঁকির মধ্যে। বাংলাদেশ আবহাওয়া বা পরিবেশ অধিদফতর থেকে বায়ুর মান সম্পর্কে কোনো পূর্বাভাস দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। এমনকি বায়ুদূষণের তীব্রতা পরিমাপের নির্দিষ্ট প্রযুক্তিও নেই দেশে। ২০০৯ সালের দিকে জাতীয় সংসদ ভবনের ছাদে বায়ুমান পরিমাপের যন্ত্র বসানো হলেও তা থেকে কোনো তথ্য পায় না আবহাওয়া অধিদফতর। আমাদের প্রত্যাশা ঢাকার নগরজীবনকে দূষণমুক্ত রাখতে উপরোক্ত পদক্ষেপসমূহ দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবেই নগরবাসীর স্বস্তিদায়ক জীবন ফিরে পাবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close