মোহাম্মদ আবু নোমান

  ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

পর্যালোচনা

এমন তো কথা ছিল না

কেউ শিকারের খোঁজে বা খ্যাপের ভাবনা ও ধ্যানে বের হলে, তার ভাবখানা সে রকমই হয়! সামনে পেলেন সুন্দর একটি ছিমছাম প্রাইভেট কার। যাতে বসে আছেন কিছু নিরীহ ছেলেপেলে। ব্যস, বুঝে নিলেন, খ্যাপ পেয়ে গেছি! ভাবলেন দ্রুত ৩০ লাখ টাকা কামাতে হবে! দাম-দর শুরু করলেন, অবশেষে ৭০ শতাংশ ডিসকাউন্টে বিরাট দয়া দেখিয়ে ১০ লাখে রাজি হলেন! গাজীপুরে তিন বন্ধুকে অপহরণ করে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবির মামলায় গ্রেফতার করা হয় কালিয়াকৈর থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আবদুল্লাহ আল মামুন এবং টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার এএসআই মুসফিকুর রহমান। এ রকম অপহরণ, নির্যাতন, নিপীড়নের ঘটনায় শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে ভীষণভাবে দাগ কাটে, মন-মেজাজকে উত্তেজিত করে, ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে! সাধারণ মানুষ হতাশ আর ক্ষুব্ধ হয়। বিষয়টি অধিকতর তদন্তের স্বার্থে ইতোমধ্যে থানা থেকে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে স্থানান্তর করা হয়েছে।

দীর্ঘদিন যাবত জনগণ অভিযোগ করছে, পুলিশ ও ডিবি পরিচয়ে অপহরণ ও মুক্তিপণের কথা। জনগণ মিথ্যা অভিযোগ করেনি। টাকা না দিলে ক্রসফায়ার, সন্ত্রাসী বা জঙ্গি হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হতো। বিপরীত দিক থেকে প্রচার হতো, অপরাধীরা নকল ডিবি পুলিশ সেজে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় করছে। এখন প্রমাণ হলো, অপহরণের সঙ্গে কতিপয় আসল পুলিশ জড়িত। জনৈক ভুক্তভোগী বলেন, ‘বর্তমান সময়ে মূর্তমান আতঙ্কের নাম পুলিশ। পুলিশ ও ডিবি পরিচয়ে দেশে কী যে ঘটছে, তা বলে বোঝানো যাবে না। যারা এর শিকার শুধু তারাই হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছেন।’

সর্বশেষ তিন বন্ধুকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করার ঘটনায় পুলিশের দুই সদস্যের সঙ্গে ওই তরুণদের আরো দুই বন্ধু, যারা আগে থেকেই পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতেন, তারাও জড়িত ছিলেন বলে গাজীপুর বিচারিক হাকিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। অপহৃত তিন বন্ধুর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ওই দুই পুলিশ সদস্যের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেন তরুণদের অপর দুই বন্ধু মো. তরিবুল্লাহ ও মনির হোসেন এবং মজনু মিয়া।

পুলিশে চাকরি নেওয়ার পর টানা চার মাস বেতন না তোলায় ডেকে পাঠানো হলো জনৈক পুলিশকে। জানতে চাওয়া হলো এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ। ওই পুলিশ বলল, এ চাকরিতে বেতনও পাওয়া যায় নাকি! চাকরিতে যোগ দিয়ে ইউনিফর্ম আর পিস্তল পেয়ে আমি তো ভেবেছিলাম, আমার কর্ম হলো, ‘এখন যেভাবে পারো, করে খাও’! কৌতুক কৌতুকই! তবু এ কথা অনস্বীকার্য কৌতুক সমাজের প্রকৃত বাস্তবতার আবহ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই তৈরি হয়ে থাকে। ইতোপূর্বে প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল (পিপিএম) পাওয়া ফরিদপুর জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) সুভাষ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী রীনার ব্যাংকে স্থায়ী আমানত বা এফডিআর হিসাবে প্রায় ৯ কোটি টাকার হদিস মিলেছিল। এভাবেই ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তারা নিজে, স্ত্রী, শ্যালক, ভাই, ভাগিনা ছাড়াও নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে আছেন। ইতোপূর্বে কক্সবাজারের টেকনাফে এক ব্যক্তিকে অপহরণের অভিযোগে মুক্তিপণের ১৭ লাখ টাকাসহ পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাতজনকে আটক করা হয়েছিল।

বিষয়টা খুব লজ্জাজনক। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত, অপরাধ তদন্ত করে যারা সত্য উদ্ঘাটন করবে, তারাই কি না অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় করছে। এরা কীভাবে, কোন যোগ্যতায় প্রমোশন নিয়ে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মানজনক পদক ‘প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল’ পেতে পারল! শুধু এদেরই বিচার নয়! কিসের ও কত কারেন্সির বিনিয়োগে প্রমোশন হয়েছিল, তাদেরও শনাক্ত করা জরুরি। নিয়মতান্ত্রিকভাবে পুলিশে নিয়োগপ্রাপ্ত সদস্যরা এ রূপ অর্থলোভী হতে পারে না। ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে একজন এএসআই পদে নিয়োগ হচ্ছে, শোনা যায়। এসব ঘটনায় পুলিশের ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। জনগণের কথা বাদ দিয়ে, পুলিশের নিজেদের ইমেজের স্বার্থেই এসবের একটা বিহিত হওয়া উচিত।

স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের মানুষ হয়েও নানা ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়। নিরাপত্তাহীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকাই যেন এখানকার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়কে-মহাসড়কে চলতে নিরাপত্তা নেই, নদীতে নিরাপত্তা নেই, বাসাবাড়িতে নিরাপত্তা নেই, কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আগে ১৪ বার নিরাপত্তার কথা ভাবতে হয়, কিছু খাওয়ার, পান করার আগে নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত থাকতে হয়। মা-বাবাকে স্কুলপড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের অপহরণজনিত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়, তাহলে জনগণের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে কি? সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন করা স্বাভাবিক, আমাদের প্রশাসন থাকা আর না থাকা একই কথা কি?

এখন চাকরি ক্ষেত্রে মেধার মূল্যায়ন নেই, লাগে ঘুষ কিংবা মামা-ভাগ্নের সম্পর্কের মতো জাদুর ছোঁয়া। একটা মেথর নিয়োগ থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়োগে চলে বাণিজ্য আর অপরিসীম দুর্নীতি। ঠিকাদারদের মন্ত্রী, আমলা, ইঞ্জিনিয়ার, স্থানীয় মাস্তানদের পার্সেন্টিস ও চাঁদা দিয়ে কাজ করতে হয়। রাজনীতিবিদের গোয়েবলসীয় কায়দায় মিথ্যাকে সত্য এবং সত্যকে মিথ্যা বলে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়বে না। অবৈধ লোন দিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের পয়সা কামানো। জাল সার্টিফিকেটে শিক্ষকতা, ভুয়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ। এমনিতর শতসহস্র বাঁধভাঙা অনৈতিক ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

গাজীপুরে তিন বন্ধুকে অপহরণ ও ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবির মামলা অধিকতর তদন্তের স্বার্থে ইতোমধ্যে থানা থেকে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে স্থানান্তর করা হয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা পুলিশ তদন্ত করতে পারে না। তবে বাংলাদেশ পৃথিবীতে এ ব্যাপারে অদ্বিতীয়। এ যেন শুঁটকির নৌকায় বিড়াল পাহারাদার! গাজীপুরের পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মামুন ও মুসফিকুর রহমান একসময় গাজীপুর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) একসঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। ওই সময় থেকে তাদের মধ্যে সখ্য। ডিবিতে দায়িত্ব পালনের সময় তারা নিরীহ মানুষদের ধরে নিয়ে টাকা আদায় করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা গাজীপুর গোয়েন্দা পুলিশে থাকার সময় আসামি ধরতে গিয়ে আসামির বাড়ি থেকে টাকা, স্বর্ণালঙ্কার লুটপাট করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। থানা পুলিশ বা ডিবি পুলিশ কেউ আইনের পরোয়া করে না। সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেফতার করা বে-আইনি। আগে একটা কথা ছিল ‘বাঘে ধরলে এক ঘা, পুলিশে ধরলে ১৮ ঘা’। আবহমান কাল থেকে বাংলায় এ প্রবাদ চলে আসছে। কারণ বাঘে ধরলে আহত হয়ে তাও বাঁচার সম্ভাবনা আছে, কিন্তু পুলিশের খপ্পরে পড়লে...।

মুক্তিপণ, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নিখোঁজ নাগরিকের সন্ধান দিতে না পারা ও পুলিশের হেফাজতে মৃত্যু কোনো স্বাধীন, সভ্য দেশে হবে পারে না। মানবাধিকার সুরক্ষায় সাংবিধানিকভাবে সরকার দায়বদ্ধ। নাগরিক নিখোঁজ থাকবে আর তার পরিবার-পরিজন দ্বারে দ্বারে কান্নাকাটি করবে, বিচার চাইবে, এটি সভ্য সমাজের লক্ষণ নয়।

বলা হয় দরিদ্র্যের কারণে অনেকে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়। বাস্তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় উচ্চ পদাধিকারী, শিক্ষিত, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক এবং সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরাই অধিক দুর্নীতিগ্রস্ত। এ উচ্চবিত্তদের দুর্নীতি যে দারিদ্র্য বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ ও দুর্নীতি বিমোচনে প্রধান অন্তরায়, তাতে সন্দেহ নেই। দেশের প্রতিটি সরকারি বিভাগ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রোগটি ছড়িয়ে গেছে, আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উচ্চপর্যায়ের উচ্চ বেতনভুক্ত কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক প্রভাব এসব দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। ইতোপূর্বে গবেষণা সংস্থা দ্য ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের এক প্রতিবেদনে এসেছে, আইন লঙ্ঘনের দায়ে পুলিশকে শাস্তি দেওয়ার ঘটনা বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে কম।

এক বালতি পানিতে যেমন এক ফোঁটা ‘চোনা’। তেমনই পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট করতে এএসআই মামুন এবং মুসফিকুরের মতো এমন দু-চারজন পুলিশই যথেষ্ট। রাষ্ট্রের নিপীড়নকারী বাহিনীগুলোর বিচারের শেষ সীমানা যদি হয় শুধু ‘প্রত্যাহার’, তাহলে বুঝতে হবে জ্ঞানভিত্তিক এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন আমাদের জন্য এখনো সুদূর কল্পনামাত্র। তার পরও পুলিশের স্বল্প কিছু অর্জন থাকলেও এসব দুষ্কৃতকারীর জন্য ধুলায় মিশে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, ঘুষখোর ও চাঁদাবাজ পুলিশ সদস্যের অপকর্মের দায় পুরো বাহিনীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর ওপর অবিচারের নামান্তর।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close