নিতাই চন্দ্র রায়

  ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

বিশ্লেষণ

হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়

নদীর সঙ্গে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্য, পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য এবং কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কৃষি, মৎস্য চাষ, যোগাযোগ, পণ্য পরিবহন ও সুপেয় পানি সরবরাহে নদীর ভূমিকা অপরিসীম। বর্ষায় বৃষ্টিতে বা বন্যায় নদী-নালা ও খাল-বিলে যে বিপুল পানি প্রবাহের সৃষ্টি হয়, সেই পানিরই একটি অংশ চুইয়ে ভূগর্ভে জমা হয়। অবৈধ দখলে নদী-নালা, খাল-বিলগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে চলে যাচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে গভীর নলকূপের সাহায্যেও মাটির নিচ থেকে পানি উত্তোলন করা সম্ভব হবে না। অভাব দেখা দেবে সুপেয় পানির। ব্যাহত হবে সেচকাজ ও কল-কারখানার উৎপাদন। নদীগুলো মারা গেলে এ দেশে সবুজ শস্যক্ষেত্র, গাছপালা ও লতাগুল্ম কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। পরিবেশের মারাত্মক অবনতি ঘটবে। মরুভূমিতে পরিণত হবে নদীমাতৃক বাংলাদেশ, যার কিছু কিছু আলামত দেখা যাচ্ছে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। এ ধরনের সংকট শুরু হয়েছে পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে। পাকিস্তানের আর্থিক রাজধানী করাচির জনবহুল ও অবহেলিত অঞ্চলের নারী ও শিশুদের প্রতিদিন পানির সন্ধানে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হচ্ছে। পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি শহরে এ দৃশ্য দেখা যায়। সরকারি এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশটির সীমান্ত এলাকায় প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষের বাড়িতে খাবার পানির সরবরাহ নেই এবং ৭০ শতাংশ পানিই দূষিত।

সম্প্রতি হাইকোর্টের এক রায়ে নদী দখলকারীদের নির্বাচন করার ও ঋণ পাওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করেছেন। সেই সঙ্গে দেশের নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় রক্ষায় জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনকে আইনগত অভিভাবক ঘোষণা করেছেন উচ্চ আদালত। নদ-নদী, খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত ও সমুদ্র উপকূল সুরক্ষায় সম্প্রতি হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন, তা সত্যই সময়োপযোগী ও প্রশংসার দাবিদার। এ রায় বাস্তবায়ন ছাড়া নদ-নদী সুরক্ষা, নদী দূষণের হাত হতে পরিত্রাণ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার আর কোনো উপায় নেই।

জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন মনে করে, নদীরক্ষা সম্পর্কে মানুষের মনের কথাই বলেছেন আদালত। এ ব্যাপারে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্য হলো, এত দিন নদীর কোনো অভিভাবক ছিল না। এ পরিস্থিতির অবসান হয়েছে। হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের পর কমিশনকে এখন থেকে দেশের সব নদ-নদীর অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতে হবে। এ দায়িত্ব যেমন মহৎ, তেমনি অনেক বড়। কমিশনের এক সদস্য শারমিন মুরশিদের মতে, তাদের প্রত্যাশার চেয়েও আদালত বেশি দিয়েছেন। এতে তাদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। নদীরক্ষায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজে সমন্বয়ের সমস্যা হতো। সেই সমস্যা আর হবে না। জনবল ও অর্থায়নের সমস্যাও দূর হবে। রায় সম্পর্কে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, হাইকোর্টের এ রায়ে নদীরক্ষার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। প্রভাবশালীদের মধ্যে যারা নির্বাচনে অংশ নিতে ইচ্ছুক, তাদের কেউ নদী দখলে যুক্ত থাকলে নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার আশঙ্কায় এ অপরাধ থেকে বিরত থাকবেন।

গত ৩ জানুয়ারি তুরাগ নদ রক্ষা নিয়ে এক রিট মামলার রায়ে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ ঐতিহাসিক নির্দেশনা দেন। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে এ মামলার শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তুরাগ নদকে ‘লিগ্যাল পারসন, জুরিসটিক পারসন ও জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে দেশের নদ-নদীরক্ষায় প্রতিরোধমূলক বেশ কয়েক দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে দেওয়া রায় দেশের ইতিহাসে এই প্রথম। এতে একজন মানুষের মতো নদীও আইনগত অধিকার পাওয়ার সুযোগ পেল। সংবিধানের ১৮ (ক), ১৯ ও ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জনগণের জানমাল, সম্পদ, স্বাস্থ্য, পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাই রায়ে ডকট্রিন অব পাবলিক ট্রাস্টকে ল অব দ্য ল্যান্ড ঘোষণা করে বেশকটি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন আদালত। এতে বলা হয়েছে, দেশের সব নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্রসৈকত, বন, খাল-বিল, জলাশয়-জলাধারের মালিক হিসেবে ট্রাস্টির দায়িত্ব পালন করবে রাষ্ট্র। নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয় রক্ষার আইনগত অভিভাবক হবে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন। নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়ের সুরক্ষা, সংরক্ষণ, অবৈধ দখল উচ্ছেদ, শ্রীবৃদ্ধিসহ সব দায়িত্ব পালন করবে নদীরক্ষা কমিশন। স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নদীরক্ষা কমিশন যাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, তা নিশ্চিত করতে রায়ে সরকারকে চার দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয় দখলকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে এর কঠিন সাজা ও জরিমানা নির্ধারণ করতে হবে। এসব বিষয় যুক্ত করে ২০১৩ সালের নদীরক্ষা কমিশন আইন সংশোধন করে ছয় মাসের মধ্যে তা হলফনামা আকারে আদালতে দাখিল করতে হবে। নদ-নদীর পাশে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের অনাপত্তিপত্র নিতে হবে। বিষয়টি সরকারের সব বিভাগকে চিঠি দিয়ে জানাতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আদালত বলছেন, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশের সব নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়ের অবস্থান চিহ্নিত ও নির্ণয় করে একটি ডিজিটার ডেটাবেইজ তৈরি করতে হবে। সেই ডেটাবেইজ দেশের সব ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা, জেলা ও বিভাগে নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। যেকোনো নাগরিক যেন নির্দিষ্ট ফি দিয়ে নদ-নদীর ম্যাপ, তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে।

নদী ও জলাশয়ের দখল বন্ধ করতে কিছু প্রতিরোধমূলক নির্দেশনাও দিয়েছেন আদালত। এসব নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদকে নিজের এলাকার নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়ের অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিত করে তাদের নামের তালিকা জনসম্মুখে ও পত্রিকায় প্রকাশ করতে হবে। নদী বা জলাশয় দখলকারী বা অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারীরা ব্যাংকঋণ পাওয়ার অযোগ্য বিবেচিত হবেন। ঋণ আবেদনকারীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেকোনো নির্বাচনে প্রার্থীর বিরুদ্ধে নদী দখলের অভিযোগ থাকলে তাকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতি দুই মাসে কমপক্ষে ১ ঘণ্টা নদীরক্ষা, সুরক্ষা, দূষণ প্রতিরোধ, নদ-নদীল প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সচেতনতামূলক পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে। দেশের সব শিল্প-কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীর অংশগ্রহণে প্রতি দুই মাস এক দিন ১ ঘণ্টা সচেতনতামূলক সভা বা বৈঠক করতে হবে। শিল্প মন্ত্রণালয় এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে। প্রতিটি ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা, জেলা ও বিভাগে তিন মাসে একবার নদী বিষয়ে দিনব্যাপী সভা-সমাবেশ, সেমিনার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে। আদালতের আরেক রায়ে বলা হয়েছে, নদীর সীমানার জায়গায় ক্রয়সূত্রে অন্যের মালিকানাস্বত্ব সৃষ্টি হয় না। ঢাকার চার নদ-নদীর রিট মামলার রায়, সংবিধানর ১৮(ক) অনুচ্ছেদ, পরিবেশ আইন, ১৯৯৫ ও জলধার আইন, ২০০০-এর বিধান অনুযায়ী নদ-নদীর সীমানা দখল সম্পূর্ণ বেআইনি ও পরিবেশবিরোধী। রায়ে আদালত পক্ষভুক্ত হওয়া তুরাগতীরে থাকা ১৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে তাদের স্থাপনা ৩০ দিনের মধ্যে নিজ খরচে সরিয়ে নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যথায় জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন ওই সব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের খরচায় উচ্ছেদের ব্যবস্থা করবে।

নদীর জমি উদ্বারের পর, যাতে কেউ পুনরায় দখল করতে না পারে, সেজন্য সীমানা চিহ্নিত করে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে করা হবে পরিকল্পিত বনায়ন। পাশাপাশি তৈরি করা হবে ওয়াকওয়ে ও ইকোপার্ক। ইতোমধ্যে ৮৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে পরিকল্পনা কমিশন। এ প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে দুই বছর। এ ধরনের প্রকল্প অন্যান্য নদীতীরেও গ্রহণ করা উচিত। শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা শহরের নদীতীরের অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ নয়; সারা দেশের সব নদীতীরের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নদীতে শিল্প-কারখানার তরল বর্জ্য ও পয়োবর্জ্য ফেলা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। নিয়মিত নদী খননের ব্যবস্থা নিতে হবে। উজানের কোনো দেশ, যাতে আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করতে না পারে; সে ব্যাপারেও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। গ্রামাঞ্চলের যেসব নদীতে মানুষ পাড় কেটে বোরো ধানের চাষ করছে, তাও বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের রায়ের আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের নদ-নদীগুলো দখল ও দূষণমুক্ত হোক। জলজ জ্যোৎস্নায় আবার হেসে উঠুক দেশÑ এ প্রত্যাশা সচেতন নদীপ্রেমিক মানুষের।

লেখক : কৃষিবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close