অলোক আচার্য

  ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

প্রকৃতি

কবির ক্যানভাসে বসন্ত

হয়তোবা সব ফুল এখনো ফোটেনি, হয়তো সব কোকিল এখনো ডাকেনি, হয়তো কোনো প্রেমিক হৃদয় আজও তার প্রেমিকাকে খুঁজে পায়নি তবুও সময়ের পরিক্রমায়, কালের নিয়মে বসন্ত এসেছে। ঋতুরাজের আগমন ঘটেছে। তাই ‘ফুল ফুটুক, আর না-ই ফুটুক আজ বসন্ত’- কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা কবিতায় বসন্তের চিরচেনা শাশ^ত রূপ। বসন্ত! প্রেম আর আবেগের নাম। শীতের হিম হিম জড়তায় মানুষ আর প্রকৃতি যখন জুবুথুবু হয়ে থাকে, গাছপালা, আকাশ মাঠঘাট যখন কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকে তখন বসন্তের আগমনে সবকিছু জেগে ওঠে। নতুন করে প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে পায় সবাই। শুরু হয় বসন্তের গুণগান। এমন মোহময় রূপ বাংলায় কেবল বসন্তেই আসে। বসন্ত আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও মেতে উঠি। পৃথিবীজুড়ে বসন্তকে ঋতুরাজ বলা হয়। রং, রূপ আর প্রাচুর্যে অন্য সব ঋতু থেকে আলাদা হওয়ার কারণেই বসন্ত ঋতুরাজ। আর সব ঋতুর চেয়ে বসন্ত একটু আলাদা, একটু আদুরে। বসন্তের রং রূপ অন্য ঋতুর চেয়ে ভিন্ন। লাল টকটকে পলাশ, শিমুল প্রকৃতিতে যেন আগুন ঝরায়। বসন্ত আগমনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির অভূত পরিবর্তন ঘটে। ঢেকে থাকা ফুলের রেণু জেগে ওঠে। ফুলের ঘ্রাণে ছুটে আসে পাখিরা। গায়কের কণ্ঠে সুর ওঠে। সে সুর ছড়িয়ে পরে আমাদের প্রাণে। মুখ খুলে গেয়ে উঠি ’বসন্ত বাতাসে সই গো, বসন্ত বাতাসে...’।

কবির কবিতায় বসন্তের গুণগান হয়। বাংলা সাহিত্য, গানে বসন্ত বন্দনা হয়েছে বহুবার। প্রায় সব খ্যাতিমান কবিই তাদের কবিতায় বসন্তের বন্দনা করেছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতা গানে বারবার বসন্ত ঋতুর প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেছেন। আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে, কবিতায় লিখেছেন, ‘অতি নিবিড় বেদনা বনমাঝে রে/আজি পল্লবে পল্লবে বাজে রে-দূরে গগনে কাহার পথ চাহিয়া/আজি ব্যাকুল বসুন্ধরা সাজে রে।’ বসন্তের আগমনে প্রকৃতির অধীর আগ্রহের অবসান হয়। এ চঞ্চলতা শীতের জড়তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া। এ চঞ্চলতা কাউকে কাছে পাওয়ার। প্রকৃতির মিলন মেলায় ভালোবাসার পাখিরাও গান গেয়ে ওঠে। কোনো এক গাছের ডালে বসে কোকিল তার সঙ্গিনীকে খুঁজে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল স্বরে ডাকতে থাকে। কোকিলের ডাকে সাড়া দিয়ে হয়তো কোনো সাথীবিহীন কোকিলাও ছুটে আসে তার কাছে।

বিশ^কবির বর্ননায়- ‘যে বসন্ত একদিন করেছিল কত কোলাহল/লয়ে দলবল/আমার প্রাঙ্গণ তলে কলহাস্যে তুলে/দাঁড়িয়ে পলাশগুচ্ছে কাঞ্চনে পারুলে/নবীন পল্লবে বনে বনে...।’ বসন্তের প্রতীক্ষাও যে বড় কষ্টের। বসন্তের আগমনের জন্য আগেভাগেই প্রকৃতির কত আয়োজন। বসন্ত তবে প্রেমের দূত। কবিগুরুর ‘ওরে তোদের ত্বর সহে না আর?’ কবিতায় বলেছে- বসন্ত সে আসবে যে ফাল্গুনে/দখিন হাওয়ার জোয়ার জলে ভাসি/তাহার লাগি রইলি নে দিন গুনে/আগে-ভাগেই বাজিয়ে দিলি বাঁশি।’

বসন্ত নিয়ে কেবল কবিগুরুই মাতামাতি করেননি। মেতেছেন বহু কবি। কবি নির্মলেন্দু গুণও লঘুচালে বসন্তের রূপের বন্দনা করেছেন তার ’বসন্ত বন্দনা’ কবিতার মাধ্যমে। এ কবিতায় তিনি লিখেছেন, হয়তো ফুটেনি ফুল রবীন্দ্রসংগীতে যত আছে/হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে/বনের কুসুমগুলি ঘিরে। আকাশে মেলিয়া আঁখি/তবুও ফুটেছে জবা,-দুরন্ত শিমুল গাছে গাছে/তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্ত পথিক।

বসন্ত কেবল বাঙালি কবি সাহিত্যিকদের মনেই প্রভাব বিস্তার করেনি। বসন্ত শীতপ্রধান দেশেও তার রূপ দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেছে। সে প্রভাব বাঙালির চেয়েও তীব্র। কারণ মনে হয় শীত যেখানে যত তীব্র বসন্তের অনুভূতি সেখানে তত তীব্র। শীতপ্রধান দেশে বসন্ত তাই জড়তা থেকে মুক্তির সময়কাল। সঙ্গে উচ্ছ্বাস আর প্রাণচাঞ্চল্য তো আছেই। রবার্ট ফ্রস্ট তার ‘এ প্রেয়ার ইন স্প্র্রিং’ কবিতায় বসন্তের কাছে প্রার্থনা করেছেন- ‘তুমি আমাদের পুষ্পের আনন্দ দাও, তুমি আমাদের ভালোবাসা দাও, ভালোবাসার চেয়ে ভালো কিছুই হয় না।’ আবার উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ তার প্রাক-বসন্তে লেখা কবিতায় বলছেন, ‘বসন্ত আসে স্বয়ং স্বর্গ থেকে, প্রকৃতি পবিত্রতায় পুষ্পিত হয় অতএব এখন শোক করবার সময় নয়।’

একটা বিষয় তো স্পষ্ট বসন্ত মানে প্রকৃতির নির্মল প্রকাশ, বসন্ত মানে ফুলে ফুলে সাজিয়ে তোলা, বসন্ত মানে পবিত্রতা। চিরকাল দারিদ্রতা আর নিঝুম মনের অধিকারী জীবনানন্দের মনেও দোলা দিয়েছে বসন্ত। তিনি তার সবিতা কবিতায় বসন্তকে তুলে ধরেছেন এভাবে- ‘বসন্তের রাতে, যেমন দেখি.../সবিতা, মানুষ জন্ম আমরা পেয়েছি/মনে হয় কোন এক বসন্তের রাতে/ভূমধ্যসাগর ঘিরে সেই সব জাতি/তাহাদের সাথে/সিন্ধুর আঁধার পথে করেছি গুঞ্জন...। মোট কথা বসন্ত বন্দনার কোনো শেষ নেই বাংলার লেখক কবিদের। বাস্তবিকপক্ষে বাংলার মানুষই যে বসন্ত পাগল। একটি ফুল, বাসন্তী শাড়ি, প্রেমিকের হাত, শিমুলের রং সব মিলিয়ে এ এক অন্য প্রকৃতি। বসন্তে প্রকৃতি যেমন মানুষকে সাজায় তেমনি নিজেও সাজে। বসন্ত এলে পরে নিসর্গে যেমন নির্মেঘ রোদ্দুর জেগে ওঠে, ¯িœগ্ধ বাতাসের পরশে সকাল সন্ধ্যা দেহে মনে লাগে মিষ্টি দোলা, তেমনি কবিরা আগের সব যাতনা ভুলে নতুন করে কবিতায় মগ্ন হয়। সে যেন তখন এক সদ্য যৌবনা তরুণী। কোনো তরুণের অপেক্ষায় প্রতি বছর পালা করে আমাদের মাঝে আসে। অথবা এমন হতে পারে প্রতি বছর কোনো অতৃপ্ত মনের তৃপ্ত করার জন্যই পালা করে প্রকৃতিতে হাজির হয়। বসন্তের মাঝে এই প্রাণের হিল্লোল, এই উন্মাতাল সুর এসব কি কবির চোখ এড়াতে পারে। তাই বসন্তকে নিয়ে কখনো গান, কখনো কবিতা লেখা হয়েছে যুগে যুগে। বৃক্ষ প্রেমিক কবিগুরু বারবার প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ ঋতু, প্রকৃতির রানিকে চিনছেন আপন ঢঙে। উন্মাতাল করা, আবেগে ভাসিয়ে দেওয়া ঋতু বসন্তের আগমনে বাঙালির অধীর আগ্রহের অবসান ঘটেছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close