স্বপ্না রেজা

  ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

মতামত

ধর্ষণকেও জিরো টলারেন্সে নিয়ে আসুন

টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠনের পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের শোধরানোর আহ্বান জানিয়েছেন। দুর্নীতি নিয়ে সমাজের সর্বস্তরে অস্বস্তি রয়েছে, এ চরম সত্য বুঝি আর আড়াল করার নয়, যায়ও না। প্রধানমন্ত্রীও আড়াল করেননি। উল্লেখ করলেন তার প্রথম ভাষণে, যা আমরা শুনলাম এবং পরদিন পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হতে দেখলাম। দুর্নীতির অশুভ ফল ও লাগামহীন ছোবল প্রকৃত উন্নয়নকে নিশ্চিত করে না। বরং ব্যাহত করে এবং করছেও। কখনোই দুর্নীতি মঙ্গলজনক হয় না, হয়নিও। সম্ভবত সেই বাস্তবতার আলোকে তিনি তার প্রথম ভাষণে উল্লেখ করেছেন, আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতি উচ্ছেদ করা হবে। ইতোমধ্যে মাদক, জঙ্গি তৎপরতা এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করে অভিযান পরিচালনা করে সফলতা অর্জন করেছে সরকার। এ অভিযান চলবে। সরকারপ্রধান বলিষ্ঠ কণ্ঠে সে কথা শোনালেন।

প্রধানমন্ত্রী তার দেওয়া প্রথম ভাষণে দুর্নীতি নিয়ে সমাজের সর্বস্তরে যে অস্বস্তির কথা উরেøখ করেছেন, এ সত্য উপলব্ধির আচরণটি রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম এবং সেই সুবাদে তিনি নিঃসংকোচিতভাবে প্রশংসা পাওয়ার দাবিদার। তিনি চাইলেই পারতেন বলতে, দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়েছি। কিন্তু তিনি তা ঘুণাক্ষরেও বলেননি। অকপটে সত্য বলেছেন, দুর্নীতি নিয়ে সমাজের সর্বস্তরে অস্বস্তি রয়েছে। সত্য বলার জন্য সৎ সাহস লাগে। তিনি সেই সাহস দেখিয়েছেন। দুর্নীতি বহু প্রকারের, আকারের যেমন আছে, তেমন আছে দুর্নীতির বহু উৎপত্তিস্থল, উৎপাদনকারক ব্যক্তি-গোষ্ঠী। মন্ত্রণালয়ের যে দুর্নীতি, তা একাধারে পিয়ন-কেরানি থেকে শুরু করে ওপর পর্যন্ত বিস্তৃত। চাকরিতে নিয়োগ, বদলি, প্রমোশন, প্রকল্প আদায়, অনুদান বরাদ্দ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, টেন্ডার ইত্যাদিতে রয়েছে দুর্নীতি। সাধারণত মন্ত্রী, আমলারা নিজ এলাকার মানুষদের সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিতে বেশি খুশি থাকেন। অগ্রাধিকার দেন, নিজেরাও উপকৃত হন। শিক্ষা, বন, সড়ক, ব্যাংক, শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতি সেক্টরে দুর্নীতি আছে। সবচাইতে আতঙ্কের জায়গা হলো, পুলিশ প্রশাসন। সচরাচর সহজে মানুষ এ ক্ষেত্রে সহায়তা পেতে আগ্রহী হন না। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষ সেখানে হয়রানির শিকার হন, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহায়-সম্বল হারান, নিঃস্ব হয়ে পড়েন। আবার বিচার ব্যবস্থাকে যখন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়, তখন দুর্নীতি তার সীমা অতিক্রম করে এবং জীবনকে ঠেলে দেয় মানবেতর পর্যায়ে। পরিত্রাণের উপায় যেমন থাকে না, তার চেয়ে অধিক থাকে না নিরাপত্তা বিধানের ন্যূনতম সম্ভাবনা। সাধারণ মানুষ আশাহতভাবে বেঁচে থাকে। থাকতে বাধ্য হয়। আমি নিশ্চিত, প্রধানমন্ত্রী সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আছেন।

শুধু ভাষণেই নয়, প্রধানমন্ত্রী তার নবগঠিত মন্ত্রিপরিষদ, রাষ্ট্রযন্ত্রের সব সদস্যকে হুশিয়ার করে দিয়েছেন যে, কে কী করছেন সবই তিনি দেখবেন। আমরা সাধারণ মানুষ আশা করব প্রধানমন্ত্রীর চোখকে যেন কেউ ফাঁকি দিতে না পারে। সেই ধৃষ্টতা যেন কেউ না দেখান। যদিও প্রশ্ন থেকে যায় তার একার পক্ষে সব দেখা সম্ভব কি না। কিংবা সরকারের মধ্য থেকে সব দেখা সম্ভব কি না। এখানে একটি কথা বলা দরকার, সবকিছু দেখে ও বলে সম্ভবত প্রচারমাধ্যম এবং তার সংবাদকর্মীরা। রাজনৈতিক বিভাজন প্রচারমাধ্যমে থাকলেও সব প্রচারমাধ্যম কিন্তু এই অনিষ্টকর রোগে আক্রান্ত নয়। নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন, দেশের প্রতি দায়বোধ এখনো অনেক প্রচারমাধ্যম ধারণ করে চলেছে। সরকারপ্রধান চাইলে এসব সংবাদকর্মীর সহায়তা নিতে পারেন। আবার সরকারপ্রধান পারেন তার রাষ্ট্রযন্ত্রকে সংবিধানসম্মতভাবে পরিচালিত হতে, তার নেতৃত্বে আহ্বানের পথ অনুসরণ করাতে, কাজ করাতে। যদি কেউ ব্যর্থ হন, অমনোযোগী হন, স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নেন কিংবা বিপরীত পথে হাঁটেন; তাহলে সরকারপ্রধান পারেন তৎক্ষণাৎ তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে, অব্যাহতি দিতে। এমন উদ্যোগ কিংবা পদক্ষেপ অত্যন্ত দ্রুত কার্যকর হয়ে ওঠে গোটা রাষ্ট্রকে দুর্নীতিমুক্ত করতে। অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ে যদি শাস্তির বিধান নিয়ে ভয়, ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করা না যায়, তাহলে অপরাধ ও অপরাধীর সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাবে। একজন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারীর কোটি কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালান্স, সম্পদশালী হওয়ার পেছনে কিন্তু ভীত হওয়ার কোনো কারণ ছিল না, বরং সে দাপটে বিত্তবান হয়েছেন এবং অনৈতিক কাজে ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন।

যাই হোক, প্রধানমন্ত্রী যদি তার প্রথম ভাষণে কঠোরভাবে ধর্ষণের বিরুদ্ধেও কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করতেন, তাহলে আরো বেশি নিরাপদবোধ করত সবাই। স্বস্তি পেত। আশ্বস্ত হতো। কারণ দুর্নীতির মতো ধর্ষণ নিয়েও কিন্তু সমাজের সর্বস্তরে চরম আকারের অস্বস্তি আছে, ভয় আছে। আছে আতঙ্ক, উৎকণ্ঠা। আড়াই বছরের শিশুও ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পায়নি, পাচ্ছে না। অতি সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, নতুন বছরের শুরুতে জানুয়ারিতেই দেশে ৭৯ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ তথ্য আবারও বলে দেয়, নারী ও শিশুর নিরাপত্তার চাইতে ধর্ষকের ধৃষ্টতা লাগামহীন। বহু লেখালেখি হয়েছে এ বিষয়ে। পরিবার, গণপরিবহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, পথঘাট, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর হেফাজত, হাসপাতাল, ক্লাব, হোটেল ইত্যাদি জায়গাগুলোতে নারী নিরাপদÑ এ কথা বোধহয় আজ আর জোর দিয়ে বলা যায় না। কেউ বলতে পারবেন বলেও মনে হয় না।

ধর্ষণ নতুন কোনো অপরাধ নয়। বহুকাল ধরে নারীর প্রতি নিকৃষ্ট পুরুষের এ পাশবিকতা চলে আসছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর ব্যাপকতা বাড়ছে। বাড়ছে ভয়াবহতা। কারণ বোধহয় একটাই, ধর্ষণকে চরম অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় না আনতে পারা, এর বিরুদ্ধে তেমন আইন প্রয়োগ না থাকা এবং ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত করতে দীর্ঘসূত্রতা, কোথাও কোথাও এর ব্যর্থতা। দেখা যায়, সমাজের একজন নিকৃষ্ট পুরুষ যেমন ধর্ষণের কাজটি করে থাকে সামাজিক অবক্ষয়ের শিরোনামে, ঠিক তেমনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিরোনামে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য অবলীলায় ধর্ষণকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে রাজনৈতিক দলগুলো। এটা কিন্তু অবিশ্বাস্য কোনো ব্যাপার নয়, বরং দৃশ্যত সত্য। নজির আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর দুঃসাহস আছে নিঃসন্দেহে। আমার জানা নেই, এ পর্যন্ত সব সরকার আমলে কজন রাজনৈতিক ধর্ষককে বিচারের আওতায় এনে চরম শাস্তি কার্যকর করা হয়েছে, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কতটা সুষ্ঠু তদন্ত হয়েছে, চার্জশিট হয়েছে, রায় হয়েছে, বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে, পুলিশ প্রশাসন টাকা না খেয়ে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। যদি শাস্তিমূলক পদক্ষেপের দৃশ্যমান প্রকাশ থাকত, তাহলে সম্ভবত নতুন করে ধর্ষকের জন্ম হতো না। কঠিন শাস্তির ভয় তো মানুষ মাত্রই থাকে। তাই না? পারছি কি আমরা সেটা করতে, প্রশ্ন থেকে যায়।

সন্ত্রাস তো সেটাই, যা মানুষকে ভীত করে, আতঙ্কিত করে প্রাণনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, প্রাণনাশ ঘটায়। সমাজ ও ব্যক্তি জীবনকে করে দেয় বিপন্ন, বিধ্বস্ত। যেখানে সভ্যতার ছোঁয়া থাকে না। ধর্ষণ তো তেমনই এক সন্ত্রাস, যা নারীর জীবনকে করে বিপন্ন, বিধ্বস্ত। যার প্রভাব পড়ে পরিবার ও গোটা সমাজে। কাজেই ধর্ষণ-সন্ত্রাসটাও জিরো টলারেন্স হিসেবে ঘোষণা হওয়া জরুরি। শুধু ধর্ষক নয়, ধর্ষণে সহায়তাকারী, ধর্ষককে শাস্তির আওতায় আনার ব্যর্থতা, উদাসীনতা, অবহেলা কিংবা টাকা খেয়ে ধর্ষককে না ধরার পাঁয়তারাÑ এসবের কোনোটাকেই জিরো টলারেন্সের বাইরে রাখা যাবে না। রাখাটাও আরেক ধরনের অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত।

পরিশেষে বলি, প্রধানমন্ত্রী, দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ, মাদক ও সন্ত্রাসের মতো ধর্ষণবাদকেও জিরো টলারেন্সে নিয়ে আসুন! যে নারী সমাজ আপনার উন্নয়নধারাকে এগিয়ে নিয়েছেন, আপনার স্বপ্নপূরণে সহযোগী হয়েছেন, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন সর্বাগ্রে!

লেখক : কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close