রায়হান আহমেদ তপাদার
বিশ্লেষণ
মানবতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার
সাধারণ মানুষের অধিকার সুরক্ষার জন্য শক্তিশালী গণতন্ত্র অপরিহার্য। আর গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন আইনের শাসন। প্রকৃত গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে রাষ্ট্রের নাগরিকদের মানবাধিকার পদে পদে ভূলুণ্ঠিত হয়। এই তো দেখেন না সৌদি সমাজ কাঠামো পুনর্গঠন করা এবং দেশটিকে ইসলামের চরমপন্থি ধারা থেকে বের করে নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে অতীতের সমাজব্যবস্থার ওপর আধুনিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে; যার লক্ষ্য হবে একটি মুক্ত সমাজ, উদারনৈতিক ইসলাম তথা সামাজিক উদারবাদী নীতি প্রবর্তনের মাধ্যমে সৌদি আরবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিস্তৃত আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন বিন সালমান। সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকাবস্থায়ই সৌদি শাসনের এবং যুবরাজ বিন সালমানের ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার মতো কমপক্ষে দুটি ঘটনা ঘটে গেছে সৌদি আরবে। সারা বিশ্বের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরিমন্ডলে আলোড়ন সৃষ্টিকারী দুটি ঘটনার একটি হলো সৌদি নাগরিক ও খ্যাতিমান সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকান্ড এবং অন্যটি হলো সৌদি তরুণী রাহাফ মোহাম্মদ আল কুনুনের কানাডায় আশ্রয় গ্রহণ। বিন সালমানের সংস্কার কর্মসূচিরও কঠোর সমালোচক ছিলেন সাংবাদিক খাশোগি। কারণ সংস্কারের কথা বলা হলেও দেশটিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের কোনো সুযোগ নেই বলেই মনে করতেন খাশোগি। রাজতন্ত্র ও সরকারি কার্যকলাপের সমালোচনা করার কোনো অধিকার জনগণের নেই। বাক ও মত প্রকাশের যেমন সুযোগ সৌদি শাসনে নেই, তেমনি উদারীকরণ নীতির কথা বলা হলেও সৌদি নারীদের ব্যক্তিগত কোনো প্রকার অধিকার না থাকার বিষয়টি নিয়ে সমালোচনামূলক লেখালেখি এবং গণতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তন করা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করতেন বলেই বিন সালমান ও সৌদি রাজপরিবারের চক্ষুশূল ছিলেন সাংবাদিক জামাল খাশোগি।
পাঠকরা নিশ্চয় অনুধাবন করতে পারছেন, রাজনৈতিক কারণেই খাশোগিকে জীবন দিতে হয়েছে বলে মনে করছে সচেতন মানুষরা। আচমকা শাসন ক্ষমতার শীর্ষে চলে আসা যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে সৌদি আরবের রাষ্ট্র ও শাসন ব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে, সর্বত্র হবে আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী সংস্কারÑ এমনটাই ব্যক্ত করেছিলেন যুবরাজ বিন সালমান। আমরা মডারেট ইসলামের ভিত্তিতে সৌদি আরবকে গড়ে তুলতে চাই, যেখানে সব ধর্র্মেরজন্য, সর্বোপরি সারা বিশ্বের জন্য সৌদি আরবের দরজা উন্মুক্ত হবেÑ এমন প্রত্যয়ী অঙ্গীকার সুলভ বক্তব্য দিয়ে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কেড়েছিলেন প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতার শীর্ষে চলে আসা যুবরাজ বিন সালমান। বিন সালমান তার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার পরিকল্পনা ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করেছিলেন, যার মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের ওপরই জোর দেওয়া হয়। এ সংস্কার পরিকল্পনায় রাজনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নে কিছু বলা হয়নি। দুটি ঘটনার সঙ্গে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কঠোরতার নীতির সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিন সালমান সংস্কারের মাধ্যমে উদারনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বললেও বাস্তবে তার সংস্কার কর্মসূচি দেশটির সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো বা ব্যবস্থায় যে খুব একটা পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারেনি, তার প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হচ্ছে বর্ণিত দুটি ঘটনাকে। সাংবাদিক খাশোগিকে যুবরাজ বিন সালমানের ইঙ্গিতে তুরস্কে সৌদি আরবের কনস্যুলেটে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। খাশোগি হত্যাকান্ডটি রাজনৈতিক কারণেই সংঘটিত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কেননা, খাশোগি মূলত রাজতন্ত্রবিরোধী এবং যুবরাজ বিন সালমানের কঠোর সমালোচক ছিলেন।
যুবরাজের ক্ষমতার শীর্ষে ওঠে আসাটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয় বলেই তিনি মনে করতেন। খাশোগি, যুবরাজ সালমানের ক্ষমতার শীর্ষে ওঠে আসার ঘটনাকে ‘প্রাসাদ কু্যু’ হিসেবে অভিহিত করে বিশ্বের বিখ্যাত সব পত্রিকা, বিশেষ করে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট ইত্যাদি পত্রিকায় কলাম লিখেছিলেন। রাষ্ট্রের আধুনিকায়ন, মডারেট ইসলামের ধারায় সামাজিক সংস্কার তথা একটি উদারনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা বিন সালমানের লক্ষ্য বলে ভিশন-২০৩০-এ বলা হলেও সৌদি সমাজে মূলত নারীরা যে এখনো ব্যক্তিগণ অধিকার থেকে বঞ্চিতই রয়েছেন সেটির প্রকাশ ঘটেছে পরিবার থেকে পালিয়ে গিয়ে কানাডায় আশ্রয় নেওয়া সৌদি তরুণী রাহাফ মোহাম্মদ আল কুনুন। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কুয়েত গিয়েছিলেন রাহাফ এবং সেখান থেকে তিনি পরিবারের সদস্যদের ফাঁকি দিয়ে চলে যান। অনেক চেষ্টার পর তিনি কানাডায় আশ্রয় পেয়েছেন। তিনি মনে করেন, এখন তিনি আরো স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারবেন। কানাডায় দৈনিক পত্রিকা টরন্টো স্টারকে রাহাফ বলেন, এটা এমন কিছু, যার মূল্য ঝুঁকি নেওয়ার কারণে আমি পাচ্ছি। আমার কিছুই হারানোর নেই। রাহাফ আরো বলেন, ‘আমরা বস্তুর মতো বিবেচিত হই, যেন একজন দাস। আমি মানুষকে আমার ও সৌদি নারীদের কাহিনি বলতে চাই।’ টরন্টো স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ সৌদি তরুণী বলেন, ‘আমি কখনো ভাবিনি, এক শতাংশ সুযোগও আছে এমনটা হওয়ার। প্রকৃত অর্থে, দুটি ঘটনাই প্রমাণ করে সৌদি আরবে সংস্কারের কথা বলা হলেও একটি আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণ থেকে দেশটি এখনো অনেকদূরে আছে। আধুনিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য দরকার শাসন ব্যবস্থায় যুগান্তকারী সংস্কার এবং গণতান্ত্রিক বিধিবিধান চালু করা।
সরকার নির্বাচনে জনগণের পছন্দ করার স্বাধীন অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। দিতে হবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নিশ্চিত করতে হবে নারী-পুরুষের সমানাধিকার। সেসব অনুপস্থিত সৌদি আরবে। জেন্ডার বৈষম্য সৌদি আরবে প্রবল। পুরুষরা যে ন্যূনতম অধিকারটুকু ভোগ করে, নারীদের সে অধিকারটুকুও ভোগ করার সুযোগ নেই বলে নারী শিক্ষা, বিবাহ, চাকরি, কর্মক্ষেত্র ইত্যাদিতে পুরুষের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। যদিও বিন সালমানের সামাজিক উদারনৈতিকতার কারণে নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ সংস্কারের আওতায় নারীরা মাঠে গিয়ে খেলা দেখার অনুমতি পেলেও একজন পুরুষ সঙ্গী সঙ্গে না থাকলে নারীরা খেলা দেখার সুযোগ পাবে না বলে যে ব্যবস্থা রয়েছে; সেটি কিন্তু নারীদের স্বাধীনতার ও মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণœ করছে এবং নারীরা যে পুরুষনির্ভরই রয়ে গেছে, তা প্রমাণ করে। রাহাফ তো বলেই ফেলেছেন তার দেশের নারীরা দাসতুল্য। প্রায় সাড়ে ৩২ মিলিয়ন জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশটিতে প্রায় অর্ধেকই নারী। এ অর্ধেক জনসংখ্যার নারীদের সংস্কারের বাইরে রেখে, নারীদের যাবতীয় মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে একটি লিবারেল বা উদার সমাজ প্রতিষ্ঠা অথবা বিনির্মাণ করা কীভাবে সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সমাজসচেতন বিশেষজ্ঞজনরা। সৌদি আরবের শাসন ব্যবস্থায় রাজপরিবারের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত রয়েছে সেই ১৯৩২ সালে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। এখানে রাজনৈতিক দল গঠন করার কোনো সুযোগ নেই। সরকার পরিবর্তন করার কোনো গণতান্ত্রিক অধিকারও দেশের জনগণকে দেওয়া হয়নি। তবে সাম্প্রতিক কালে দেশের তরুণ ও নব প্রজন্মের মধ্যে চেতনা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশটির সমাজ ব্যবস্থায়ও একটি পরিবর্তনের আকাক্সক্ষার সৃষ্টি হয়েছিল।
এমনকি দাবি ওঠেছিল গণতান্ত্রিক সংস্কারের। দাবি ওঠে মহিলাদেরও নাগরিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার দিতে হবে। এ দাবিগুলো ক্রমেই বাড়তে থাকে। শাসক কর্তৃপক্ষের ওপর সৃষ্টি হয় দেশি-বিদেশি চাপ। অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ও জনসংখ্যা সংকটজনিত কারণেও শাসন কর্তৃপক্ষের ওপর সংস্কার এবং আধুনিকীকরণের চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। দেশের অর্থনীতি পুরোপুরি তেলনির্ভর হওয়ায় ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় কর্ম বয়সী যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য যে, দেশটির মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩২ মিলিয়ন এবং এর অর্ধেকই ২৫ বছর বয়সের। এ ২৫ বছর বয়সের যুবক-যুবতীদের তেলনির্ভর অর্থনীতির কারণে কাজ দিতে না পারায় দেশে বেকার হার বেড়ে যায় প্রায় ৩০ শতাংশ, যদিও সরকারিভাবে ৬ শতাংশ বলা হচ্ছে। মূলত এক-তৃতীয়াংশ যুবক-যুবতীই কর্মহীন। কাজেই তাদের কর্মসংস্থানের দাবিও জোরদার হচ্ছিল। সংস্কারের এ অব্যাহত দাবির প্রেক্ষাপটেই বিন সালমান অর্থনীতি এবং সামাজিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন ও সংস্কার সাধন করার উদ্যোগ নেন। সামগ্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করা হলেও এই ভিশন পরিকল্পনায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ, রাজতন্ত্রের বিলোপ বা মহিলাদের ব্যক্তিগত অধিকারের স্বীকৃতির বিষয়টি অনুল্লেখিত থাকায় রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে যেমন পরিবর্তন আসেনি বা আসার কোনো লক্ষণও দেখা যায়নি; তেমনি উদারনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করারও কোনো সুযোগ সৃষ্টি হয়নি বিন সালমানের ভিশন-২০৩০ কর্মসূচিতে। একটা আধুনিক গণতান্ত্রিক এবং জনবান্ধব রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য, সত্যিকার সামাজিক উদারীকরণের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় সংস্কারের পাশাপাশি রাষ্ট্র ও শাসন ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক সংস্কার অতি অপরিহার্য।
রাষ্ট্র জনগণের রাষ্ট্র হয়ে ওঠতে পারে, যেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তার মৌলিক মানবিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করতে পারবে বিনা বাধায়। মূলত গণতান্ত্রিক সংস্কার, শাসনে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হওয়ায় তথা মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের স্বীকৃতি না থাকার বলি হলেন জামাল খাশোগি এবং সমাজ উদারীকরণের কথা বলা হলেও দেশটির মহিলারা যে এখনো দাসীতুল্য এবং সর্বপ্রকার অধিকারহারা, সে বিষয়টি ঘর পালানো রাহাফ প্রমাণ করে দিলেন। সব মিলে এটি বলা যায় যে, সৌদি রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার সংস্কার বিষয়টি এখনো অনেক দূরের পথ। বিন সালমান সে পথে হাঁটবেন বলে কোনো লক্ষণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। আসলেই অগণতান্ত্রিক সরকার আমলানির্ভর। সামরিক বা আধাসামরিক সরকার যারা বাহুবলে বলীয়ান, কিন্তু জনসমর্থনের দিক থেকে দুর্বল, তেমন সরকার চায় নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কর্মকর্তাদের নিজেদের পক্ষে রাখতে। কর্মকর্তাদের বশে রাখার অন্যতম উপায় ঘন ঘন পদোন্নতি দেওয়া। আজ যুগে উঁচু পদমর্যাদার কর্মকর্তার সংখ্যা বিপুল। পদ নেই, তবু প্রমোশন। গণতন্ত্রের জন্যও জিনিসটি ক্ষতিকর। নিরপেক্ষ আমলাতন্ত্র ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ছাড়া আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যত অর্থনৈতিক উন্নয়নই করুক, জনগণের কল্যাণ করতে পারবে না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
"