মো. মাঈন উদ্দিন

  ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

মতামত

রোহিঙ্গা সমস্যা ও বাংলাদেশ

১৯৯৩-৯৪ সালের কথা। সেসময় একজিমা, যা বিখাউজ নামে প্রচলিত ছিল। এ বিখাউজ হলে ধুতরার ফুল রান্না করে খাওয়াত। মানুষের বিশ^াস ছিল ধুতরার ফুল রান্না করে খেলে বিখাউজ ভালো হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে এ ধুতরার ফুল খেলে মানুষের সাময়িক মস্তিষ্কহানি দেখা দিত। এতে করে মানুষ পাগলামি শুরু করে দিত। তো আমার চাচাত ভাইয়ের ঘরের সবাই তখন বিখাউজ রোগে ভুগছিলেন। যথারীতি চাচাত ভাই ধুতরার ফুল রান্না করে সন্ধ্যা রাতে স্ত্র¿ী-সন্তানদের খাওয়ালেন। আধঘণ্টা পরে শুরু হয়ে গেল মাতলামি। একেকজন উল্টাপাল্টা কথা বলে আর চাচাত ভাই তা দেখে হাসেন। আনন্দে তিনি আমাদের ডেকে নিয়ে বলেন, দেখো, সবাই কেমন পাগলামি করছে। ধীরে ধীরে পাগলামির পরিমাণ বাড়তে লাগল। একপর্যায়ে দেখা গেল, পাগলামি করতে করতে একেকজন একেক দিকে ছোটাছুটি শুরু করে দিল। চাচাত ভাই একা আর কুলিয়ে উঠতে পারলেন না। শেষে তার মেজাজ বিগড়ে গেল। তিনি লাঠি হাতে নিয়ে সবাইকে মারতে উদ্যত হলেন। সাময়িক আনন্দ অবশেষে বিষাদে পরিণত হলো।

আমাদের হয়েছে ঠিক একই ঘটনা। রোহিঙ্গা মুসলিমরা যখন রাখাইন থেকে আসতে লাগল। আমরা অনেকেই সহানুভূতিশীল হয়ে পড়লাম (অবশ্য সহানুভূতিশীল না হয়ে উপায় ছিল না)। অনেকে ধারণা করেছিলাম, হয়তো রোহিঙ্গা সমস্যা ততটা গভীর হবে না। অনেকে মনে করেছিলাম, আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবেই। অনেকেই মনে করেছিলাম, এমন হৃদয়বিদারক ঘটনায় সারা বিশ^ বাংলাদেশকে সমর্থন দেবে। কিন্তু বাস্তবে এর ছিটেফোঁটাও হয়নি। পাল্টা চীন ও রাশিয়া (স্বার্থের খাতিরে যুগল বন্ধু) মিয়ানমারের দিকে হেলে গেল। তারা দ্বৈতনীতি গ্রহণ করল। কাজের কাজ কিছুই হলো না। ১০ লাখ রোহিঙ্গা আজাও রয়ে গেল ১৭ কোটি মানুষের ছোট্ট এ দেশে। যে দেশের রাস্তায় চলতে গেলে মানুষের কাঁধে কাঁধ লেগে যায়। আমাদের সরকারের শত আন্তরিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো। উল্টো বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সরকার যে পরিস্থিতি সৃৃষ্টি করছে, তাতে রোহিঙ্গাদের ফেরা রুদ্ধ হতে চলেছে বলেই মনে হচ্ছে।

প্রতিবেশী দেশ ভারত। ভারতের সঙ্গে আমাদের বর্তমান সম্পর্ক আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো। তবু ভারতের কাছ থেকে আমরা প্রত্যাশা অনুযায়ী পদক্ষেপ পাচ্ছি না। এই পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেই ভারতের শরণাপন্ন হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুর স্থায়ী সমাধানের জন্য ভারতের কাছে নতুন প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। তিন দিনের ভারত সফর শেষে শনিবার বিকেলে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের এ কথা জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ভারতের সহায়তা চেয়েছি। আমরা চাই রোহিঙ্গারা তাড়াতাড়ি নিজ দেশে ফিরে যাক। এজন্য রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে নতুন একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ভারতের সহায়তা চেয়েছি। আমরা চাই, রোহিঙ্গারা তাড়াতাড়ি নিজ দেশে ফিরে যাক। ভারতের কাছে দেওয়া নতুন প্রস্তাবের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সেফ হেভেন বা নিরাপদ এলাকা তৈরি করে সেখানে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক। ওই এলাকায় রোহিঙ্গারা নির্ভয়ে, নিরাপদে, টেকসই জীবন নির্বাহ করতে পারছে কি না, তা দেখভালের দায়িত্ব নিক মিয়ানমারের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো।

একই প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন বলেন, আমি সুষমা স্বরাজকে বিস্তারিত সব বলেছি। বলেছি, ২৪ হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে, ১৮ হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে, সোয়া লাখ বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ১ লাখ ২০ হাজার বাড়ি ধ্বংস হয়েছে, ৮ লাখ মানুষ বাংলাদেশে চলে এসেছে। মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথিবীর বড় বড় নেতাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশ ধনী রাষ্ট্র নয়। দেশটা ঘনবসতিপূর্ণও। এ বাস্তুচ্যুতদের ফিরে যেতে হবে। না হলে সৃষ্টি হবে অরাজকতা, অনিশ্চয়তা। মৌলবাদ মাথাচাড়া দেবে।

তার মতে, প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের কাজ সম্পন্ন না হলে এ অঞ্চল সবার জন্য নিরাপদ থাকবে না। নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা না থাকলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ঘটবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো দরকার।

এখন প্রশ্ন হলো, ভারত সরকার এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে কতটা আন্তরিক হয়ে কাজ করবে? ভারত কাজ করলে ভালো। কিন্তু ভারত যদি তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য রোহিঙ্গা ফেরতে কাজ না করে কিংবা তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়; তাহলে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে অবশ্যই এ রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নচেৎ অদূর ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের দ্বারা এ অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে; যার উত্তাপে নিশ্চিত করে পুড়বে বাংলাদেশ।

লেখক : প্রশাসনিক কর্মকর্তা

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close