ইয়াসমীন রীমা

  ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

বিশ্লেষণ

ভালোবাসার নানারূপ

বিধাতা নারীকে আপন ভাগ্য জয় করার অধিকার দেননি বলে রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে দীপ্রথম বিশ্বাস নিয়েই তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘ভালোবাসা প্রেমে হও বলী/ চেয়ো না তাহারে। আকাক্সক্ষার ধন নহে আত্মা মানবের।’ যত দিন না নারী-পুরুষ সমানভাবে শিক্ষিত হবে, তত দিন ভালোবাসার ক্ষেত্রে নৈরাজ্যও বন্ধ করা যাবে না। মানুষের বিধ্বস্ত মানসিক জীবনে শান্তি পাওয়ার জন্য একমাত্র বস্তু ভালোবাসা। এ বিশ্বজনীন অনুভূতিকে পুষ্টিদান করতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রেমের জীবনকে সুস্থিত ও প্রদীপ্ত করা। হতে পারে স্বাধীন নারী তার আত্মার মুক্তির জন্য গার্হস্থ্য বন্ধন ছিন্ন করে ঘরের বাইরে চলে যাবে, কিন্তু সেখানও তো সে স্বপ্ন সন্ধানী মানুষের সন্ধানেই যাবে যার জন্ম ভালোবাসায়। এ বিশ্বের সর্বস্তরে পরস্পরের যে আকর্ষণ তাই সমগ্র বিশ্বকে ধরে রেখেছে। আর বিকর্ষণ যা তা তো আকর্ষণের ফলেই।

শিক্ষিত ও পরিশীলিত জীবনই একমাত্র ভালোবাসার পথকে প্রশস্ত করতে পারে। সে শিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি না থাকলেও চলবে। সে জীবন হবে পরীক্ষিত জীবন। নারী ও পুরুষকে দীর্ঘস্থায়ী বন্ধনে আবদ্ধ করে, যা অন্য প্রাণীর বেলায় তেমন করে না। এ দীর্ঘস্থায়ী বন্ধনই সন্তান লালন-পালনে বড় ভূমিকা রাখে। ভালোবাসা প্রকাশের এটাও একটা বড় দিক হয়ে উপস্থিত হয়। মানুষই একমাত্র প্রাণী, যা সন্তান লালন-পালনের দায়িত্বে নারী-পুরুষ যৌথ ভূমিকা নিয়ে থাকে। এর কারণ তার মস্তিষ্কপ্রসূত রাসায়নিকের তাগিদ। আর তখনই বন্ধনের প্রয়োজন হয়। বন্ধনের প্রক্রিয়ায় বড় ভূমিকা পালন করে ভালোবাসা। বিজ্ঞানীরা এখানে মনে করেন ভালোবাসা শুধু হৃদয় আবেগ নয়, জৈবিক তাড়নাও। ভালোবাসার এ বিবর্তন নিয়ে কাজ প্রখ্যাত মার্কিনী নৃতাত্ত্বিক গবেষক হেলেন ফিশার। তিনি এ বিষয়ে সাড়া জাগানো একটি গ্রন্থও লিখেছেনÑ অ্যানাটমি অব লাভ। সাধারণ ধারণা হচ্ছে, সত্যিকারের ভালোবাসা চিরকালের। এ নিয়ে সিনেমা, গল্প, গান, কবিতা তৈরি হয়েছে অসংখ্য। বাংলা যাযাবরের দৃষ্টিপাতের উপন্যাসটির কথা মনে পড়লেই ভালোবাসা হৃদয় পোড়ায় চারু দত্ত আধারকারের কথা মনে পড়ে। তিলোত্তমা মজুমদার বলেন, ‘গত এক দশকে নারী জীবনে এমন এক বিপল্প এসেছে যে, ভালোবাসার সংজ্ঞা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে সমাজবিজ্ঞানীদের এবং এর অনিবার্য ফলাফল হিসেবে জেগে ওঠে, মানুষ হিসেবে মর্যাদা অর্জনের লড়াই। নারীরা বলেন, লিভ উইথ আউটম্যান।

মুখ ফুটে বলা ভালোবাসার কথা এবং হৃদয়ে নিরুচ্চার প্রেমের কথার মাঝামাঝি কোথাও দাঁড়িয়ে আছে প্রেমপত্র। ভালোবাসার মানুষকে অনেক কথা সামনাসামনি বলা যায় না; যা নিভৃতে বসে গুছিয়ে লিখে ফেলা যায়, সেক্ষেত্রে নিষ্প্রাণ চিঠির পাতাটি প্রাণ পায় সখা বা সখীর মতো জীবন্ত একটা মাধ্যম হয়ে। প্রেমপত্রকে আঁকড়ে ধরেই একজন প্রেমিক-প্রেমিকা বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকতে চায়। প্রেমপত্র লেখার চেয়ে প্রেমপত্র পেতে আরো বেশি ভালো লাগে। কারণ প্রেমপত্র সাক্ষাৎ প্রেম। মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে দেখে কবি কিটস বান্ধবী ফ্যানিকে লিখেছেন, ‘প্রিয়তম বালিকা আজ সকালে বেড়াতে বেরিয়েছিলাম হাতে একটা বই নিয়ে, কিন্তু আমার মনটা বরাবরের মতো ভরে ছিল শুধু তোমাতে শুধু তোমাতে। এই কথাটাই আরো সুন্দর করে বলতে পারলে আমার ভালো লাগত। সারা দিন, সারা রাত একটা তাড়নার মধ্যে আছি। সবাই আমার ইতালি যাওয়ার কথা বলে সব সময়। এটা এখন সুনিশ্চিত যে, আমি আর কখনো সেরে উঠব না।... এর বেশি উদ্ধৃত করা কঠিন পড়তে পড়তে মৃত্যুপথযাত্রী কবিটির মুখ মনের পর্দায় ভেসে ওঠে ক্রমাগত। ধারণা হয় চিঠিটা ওর কালিতে নয়, রক্তে লেখা। কিটস চিঠির শেষ লাইনে লিখেছেন, ও ড়িঁষফ ংড়হহবৎ ফরব ভড়ৎ ধিহঃ ড়ভ ুড়ঁ ঃযধহ-ুড়ঁৎং ভড়ৎ বাবৎ,-ঔ কবধঃং.’

আনন্দবাজার পত্রিকায় (১৯৯৪ সালের ৩০ জানুয়ারি) নীরদ চৌধুরী এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘বর্তমান যুগের ব্যভিচার বর্তমান যুগের নারী জীবন হইতে আসিয়াছে। এই নারী জীবনের প্রবর্তন কর্তা ইবসেন। তাহার নাটক ঊঃ উাশশবযরলবস ( অ ফড়ষষং ঐড়ঁংব ) ১৮৭৯ সালে প্রকাশিত হয় এবং ১৮৮৯ সালে প্রথম লন্ডনে অভিনীত হয়। আমি উহার কথা অতি অল্প বয়সেই শুনিয়াছিলাম। আমার এক মামা অত্যন্ত সাহিত্যরসিক ছিলেন। তিনি আমাকে বলিলেন নীরু এখন ইউরোপ ইবসেনিরাসে আবিষ্ট হয়ে গেছে।’ এই শব্দটি অবশ্য বার্নাডশ প্রচলিত করেছিলেন। আমি ষোলো বছর বয়সে এ নাটক ইংরেজি অনুবাদে প্রথম পড়ি। উহার নায়িকা লোরা হেলমার বিবাহিত জীবনের তুচ্ছতা দেখিয়া স্বামীর বাড়িকে পুুতুল খেলার ঘর বলে মনে করে ও উহা ত্যাগ করে স্বাধীন এবং পূর্ণতর জীবনের সন্ধানে বাহির হলো। কোথায় পৌঁছাল তখন বোঝা যায়নি, এখন বোঝা যাচ্ছে। এসব নারী এখন অফিসে অফিসে বিরূপমানা অর্থাৎ ফড়ষষং ঐড়ঁংব থেকে বের হয়ে জড়নড়ঃং ঐড়ঁংব-এ জীবনযাপন করছে। উহা মানুষের মনকে বিনষ্ট করে দেহেও শুধু ইন্দ্রিয়পরতন্ত্রতা রাখে, নহিলে শূন্যতার অনুভূতি হতে অব্যাহতি পায় না। আমি বর্তমান যুগের বাঙালি যুবতীদের জড়নড়ঃং ঐড়ঁংব থেকে ঐবধৎঃষবংং ঐড়ঁংব থেকে ও ঐবধৎঃষবংং নৎবধশ থেকে অভিসারিকা হয়ে বর প্রণয়ীর খেলাঘরে ফিরে যেতে অনুরোধ করছি। সেখানে তারা সতী ও ব্যভিচারিণী দুই-ই হতে পারবেন ব্যভিচারের জন্য পর পুরুষের আবশ্যক হবে না।’

দাম্পত্য জীবন প্রসঙ্গে “আনন্দমঠৎ এ জীবানানন্দ ও শান্তির কথোপকথন রবীন্দ্রনাথের ‘দৃষ্টিদান’ গল্পের কুমুচরিত্র সর্বশেষ গোরা উপন্যাসে বিনয়ের গোরাকে বলা কথাগুলো “আমি তোমাকে নিশ্চয় বলিতেছি মানুষের সমস্ত প্রকৃতিকে এক মুহূর্তে জাগ্রত করিবার উপায় এই ভালোবাসা যে কারণেই হোক আমাদের মধ্যে এই ভালোবাসার আবির্ভাব দুর্বল-সেই জন্যই আমরা প্রত্যেকই আমাদের সর্ম্পূণ উপলদ্ধি হইতে বঞ্চিত-আমাদের কি আছে তা আমরা জানি না, যাহা গোপনে আছে তাহাকে প্রকাশ করিতে পারিতেছি না, যাহা সঞ্চিত আছে, তাহা ব্যয় করা আমাদের অসাধ্য। সেই জন্যই চারদিকে এমন নিরানন্দ এমন নিরানন্দ।”

ভালোবাসা দিয়ে যেমন অপরকে আপন করা যায়, তেমন ভালোবাসাই এনে দেয় শান্তি ও আনন্দ। ভালোবাসা বিষয়ে সত্তর বয়সের জহুরা আকতার কথা হলেÑ মায়ের সঙ্গে সন্তানের একটা এমনই বন্ধন যে সেটা অটুট। একটা বড় দড়ি দিয়ে বাঁধা একজন মা সে দড়ির রেশটা বড় দূর অবধি ছেড়ে দিয়েছে। সন্তান যেখানেই থাকুক প্রাণের টানে ঠিক কাছে চলে আসবে। আর দড়িটা যদি বেশি নিজের কাছে টেনে রাখতাম তাহলে তারাও ঘুরেফিরে পৃথিবীটা দেখতে পেত না। আজ আমি নাতি নাতনিদের ভালোবাসায় এমনই জড়িয়ে আছি যে, আমার মনটাও তাদের মতো কচি হয়ে আছে। অফুরন্ত সময় আমার হাতেই। তাই যেটা করতে মনে আনন্দ হয়, তাই করি। দিনের অর্ধেকটা কাটে বউদের রান্নার কাজের তদারকি করে। বাকি সময় নাতি নাতনির সঙ্গে খেলা-গল্প গুজবে মেতে। আমার এই সত্তর বছরে আজও আমি সুস্থ দাঁড়িয়ে আছি, তা কেবল এত ভালোবাসা পেয়েছি বলেই। আমার কোনো ক্ষাভ নেই, আমার সবাই আছে আমিও তাদের জন্য আছি। তাইতো ছোট ছেলের নাতির মুখ দেখার জন্য গত বছর পাড়ি দিয়েছিলাম সুদূর আমেরিকায়। নাতিকে বসতে শিখিয়েছি, খেতে শিখিয়েছি অবশেষে দীর্ঘ আট মাস পর দেশে ফিরে এসেছি। ভালোবাসা মনের মধ্যে এমন জায়গায় থাকে, যেটা দূরে থাকলেও কারো থেকে অক্ষুণœ হয় না। চোখের দেখা হয়তো নাইবা হলো অন্তরে তো সকলের জন্য স্থান রয়েছে। আমার মতো পরিণত বয়সে সংসারের দায়িত্ব অন্যকে দেওয়ার মধ্যে বোধহয় একটা ভয় থাকে। যা বয়সের ভার বা নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার আতঙ্ক। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, অফুরন্ত ভালোবাসা আমাকে সংসারকে আঁকড়ে থাকা এক ভয়ংকর ইচ্ছার জন্ম দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের প্রেমপত্র বলে সূচিত করতে হলে আমাদের ফিরে যেতেই হবে তার ভাই ছুটি পত্রাবলিতে কবি লিখেছেন স্ত্রী পুরুষের অল্প বয়সের প্রণয়ের মোহে একটা উচ্ছ্বাসিত মত্তা আছে, কিন্তু এ বোধহয় তুমি তোমার নিজের জীবনের থেকেও অনুভব করতে পারছ। বেশি বয়সেই বিচিত্র বৃহৎ সংসারের দোলার মধ্যেই স্ত্রী-পুরুষের যথার্থ স্থায়ী গভীর সংযত নিঃশব্দ প্রীতির লীলা শুরু হয়। নিজের সংসার বৃদ্ধির সঙ্গে বাইরের জগৎ ক্রমেই বেশি বাইরে চলে যায়। সেজন্য সংসার বৃদ্ধি হলে এক হিসাবে সংসারের নির্জনতা বেড়ে ওঠে এবং ঘনিষ্ঠতার বন্ধনগুলো চারদিক থেকে দুজনকে জড়িয়ে আনে। মানুষের আত্মার চেয়ে সুন্দর আর কিছু নেই। যখনই তাকে খুব কাছে থেকে নিয়ে এসে দেখা যায়, যখন তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ মুখোমুখি পরিচয় তখনই যথার্থ ভালোবাসার প্রথম সূত্রপাত হয়।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close