সোলায়মান মোহাম্মদ

  ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

স্মরণ

পেট্রিসিয়া কার ও জর্জ হ্যারিসন

‘বাবা-মায়ের আদর জানি না কেমন। তবে পেট্রিসিয়া ম্যাম আমাকে যেভাবে ভালোবাসা দিয়ে লালনপালন করেছেন, তাতে কখনো মনে হয়নি আমার মা-বাবা নেই। লেখাপড়া থেকে শুরু করে যখন যা প্রয়োজন তিনি তখন তাই দিচ্ছেন।’ খুব আকুতি নিয়ে ছলছল আঁখিতে উচ্ছ্বাস ভরে কথাগুলো বলল ১৪ কিংবা ১৫ বছরের মেয়ে নিপা আক্তার। জন্মদাতা বাবা-মায়ের কথা সে বলতে পারে না। এমনকি জানেও না কে তার মা-বাবা। মাত্র দুই বছর বয়সে তাকে গাজীপুরের শ্রীপুরে শিশুপল্লী প্লাসে রেখে যায় কোনো একজন। শুধু নিপা নয়, এখানে বর্তমানে ৩৪২ জন অনাথ ছেলেমেয়েকে লালনপালন করা হচ্ছে। যাদের অধিকাংশই জানে না কে তাদের মা-বাবা। ঠিক কী ভুলের কারণে তারা তাদের জন্মদাতা মা-বাবার আদর থেকে বঞ্চিত, এটিও হয়তো তারা জানে না। তারা অবশ্য জানতে চায়ও না। মা-বাবা থাকলে কীভাবে আদর করত, এটি হয়তো তারা জানে না। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠান তাদের কোনো কিছুর অভাববোধ করতে দেয়নি। ঠিক মা-বাবার মতোই সবাইকে আগলে রেখেছে। বরং বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যাবে, মা-বাবা সন্তানের জন্যও অনেক সময় শত ইচ্ছা থাকলেও অনেক কিছুই করতে পারে না। স্বাদ থাকলেও সাধ্যে কুলই না। কিন্তু শিশুপল্লী প্লাস খুব যতœ করেই অসহায় সন্তান ও স্বামীহারা নারীদের সব প্রয়োজনই কমবেশি মেটানোর চেষ্টা করছে। লেখাপড়া থেকে শুরু করে অসুস্থতায় সার্বক্ষণিক ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা প্রদান। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলারও যথেষ্ট সুযোগ রাখা হয়েছে। এমনকি এখানে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমেও ছেলেমেয়েদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে; যাতে কর্মজীবনে তাদের হোঁচট খেতে না হয়। ১৯৮৯ সালে অসহায়দের এ আশ্রয়স্থল প্রতিষ্ঠা করেন ব্রিটিশ নাগরিক পেট্রিসিয়া অ্যান ভিভিয়ানা কার। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৫৫৯ জন মেয়ে, ১৪৮০ জন ছেলে এবং ১ হাজার জন সহায়সম্বলহীন অসহায় নারীকে লালনপালন করেছে এখানে। যাদের সবাই এখন আত্মনির্ভরশীল এবং দেশের কল্যাণে সার্বিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আর এমন একটি মহতি কাজ দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে মনের মাধুরি মিশিয়ে সৃযতেœ করে যাচ্ছেন পেট্রিসিয়া কার। যদিও মানবিক ও অসামান্য এ মহৎ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ আমাদের দেশের সরকার ইতোমধ্যে ব্রিটিশ নাগরিক পেট্রিসিয়া অ্যান ভিভিয়ানা কারকে সম্মানসূচক বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেছে। নাগরিকত্ব পেয়ে পেট্রিসিয়া কার নিঃসন্দেহে যথেষ্ট আনন্দিত হয়েছেন। আমরাও তাকে নাগরিকত্ব প্রদান করে গর্বিত হয়েছি। একজন ব্রিটিশ নাগরিক যখন মহান এ ভাষার মাসে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে, ‘আমি বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসি’। তখন সত্যিই আনন্দে চোখে জল চলে আসে। একজন বাংলাদেশি হিসেবে এর চেয়ে আর গর্বের কী হতে পারে! পেট্রিসিয়া কারকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমার বারবার মনে হয় মানবতার মূর্ত প্রতীক জর্জ হ্যারিসনের কথা। একজন বিদেশি হয়েও যিনি ১৯৭১ সালে বিভীষিকাময় রক্তাক্ত বাংলাদেশ ও ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় এক কোটি বাংলাদেশিকে বাঁচাতে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর আয়োজন করেছিলেন। তিনি অস্ত্র হাতে নিয়ে হয়তো যুদ্ধ করেননি, কিন্তু গিটার আর গান দিয়ে যে যুদ্ধ করেছিলেন তা বাংলাদেশ অনন্তকাল শ্রদ্ধাভরে স্মরণ রাখবে। আজকে পেট্রিসিয়া কার যেটি করছেন সেটিও কিন্তু মানবতার এক অনন্য নজির।

খবরের কাগজ খুললেই চোখে পড়ে চারদিকে সন্ত্রাস, মাদক, খুন, নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, রাহাজানি, ছিনতাই ও অন্যান্য অপরাধসহ নানা ভয়ানক সব কার্যকলাপের দৃশ্য। আর এসব অপরাধের বেশির ভাগই হয়ে থাকে পরিবারহীন হতাশাগ্রস্ত অভাবী মানুষদের দ্বারাই। একটি শিশু যখন আশ্রয়হীন বা পরিবার ছাড়া বড় হতে থাকে; তখন স্বাভাবিকভাবেই তার মধ্যে কঠোরতার জন্ম নেয়। সমাজের বাস্তবতা ধীরে ধীরে একটি কোমল হৃদয়কে শক্ত পাথরে রূপ দেয়। আর তখন কোনো অপরাধই তার কাছে অন্যায় কিছু মনে হয় না। সেই দিক থেকে পেট্রিসিয়া কার একেবারে আমাদের দেশের মূল সমস্যা নিরসনেই কাজ করছেন বলে মনে করি। পরিবারহীন ওই সব শিশু দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে পরিবারের আদর ভালোবাসা দিয়ে ধীরে ধীরে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সম্ভাবনাময়ী মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। যে অনাথ সন্তানটির নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা ছিল ঠিক সেই সন্তানটিকেই এখান থেকে আদর্শবান মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে জেনেছি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের চেয়ে আমাদের নিজেদের দেশের লোকেরাই আমাদের বেশি ক্ষতি করেছে। ঠিক এখনো পাকিস্তানিদের সেই দোসররা বিভিন্নভাবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে ক্ষতি করতে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যেখানে আমরা নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুড়াল মারছি; সেখানে পেট্রিসিয়া কারের মতো বিদেশি মহৎ প্রাণ একজন মানুষ আমার দেশকে ভালোবেসে দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের মতো বৃহৎ সমাধানে মরিয়া হয়ে কাজ করছেন। কাজেই এমন একজন মহীয়সী নারীকে দাঁড়িয়ে বারবার স্যালুট জানালেও ভুল হবে না। সরকারকে শুধু নাগরিকত্ব প্রদান করেই দায়িত্ব নিভালে চলবে না। দারিদ্র্যবিমোচনে বিশেষ অবদান রাখায় একুশে পদকসহ রাষ্ট্রীয় অন্যান্য সম্মাননাও প্রদান করা উচিত বলে মনে করি। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতার হাতও প্রসারিত করতে হবে। দেশের ধনীশ্রেণির হৃদয়বান মানুষও যদি পেট্রিসিয়া কারের এমন কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে নারী ও শিশু পুনর্বাসনের জন্য নিজস্ব অর্থায়নে দেশের বিভন্ন জায়গায় এমন আরো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। তাহলে আগামী দিনের বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে তাতে সন্দেহের কিছু নেই।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close