এস এম নাজের হোসাইন

  ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আলোচনা

ভোক্তাধিকার ও তৃণমূলে সুশাসন

চতুর্থবারের মতো ও টানা তৃতীয়বার দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন শেখ হাসিনা। দায়িত্ব গ্রহণের প্রাক্কালে দেশের আপামর জনসাধারণের প্রত্যাশা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে বর্তমান মন্ত্রিসভা ও জাতীয় সংসদ সদস্যরা সরকারের দিনবদলের সনদ অনুযায়ী বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উপনীত করা, দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রশাসনিক কাঠামোতে সংস্কার আনতে সক্ষম হবেন। দেশের মানুষ নাগরিক হিসেবে যোগ্য সম্মান পাবে, একই সঙ্গে নাগরিকের মৌলিক অধিকার বিশেষ করে ভোক্তা অধিকার (সুশিক্ষা, সুচিকিৎসা, নিরাপদ খাদ্য, জ্বালানি নিরাপত্তা, বস্ত্র, নিরাপদ আবাসন, নিরাপদ সড়ক যাতায়াত, আইসিটি, ব্যাংকিং ও আর্থিক অধিকারগুলো) সুরক্ষিত হবে। নাগরিকের মুক্তচিন্তা ও মতামতের প্রতিফলন ঘটানোর অধিকারগুলো রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। যদিও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পরপরই ঘোষণা দিয়েছেন সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি প্রতিরোধই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদের ৬১ শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ী। নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় সরকারকে ব্যবসায়ীবান্ধব করার অঙ্গীকার করেছিলেন। সে অনুযায়ী মন্ত্রিসভায় বিপুলসংখ্যক ব্যবসায়ী স্থান পেলেও দেশের ভোক্তা অধিকার কর্মী ও সচেতন জনগণ আশা ছাড়েননি। এ ছাড়াও বর্তমান ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বেশ কিছু বিষয়ে প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষ করে প্রশাসনের সর্বস্তরে ই-গভর্ন্যান্স সেবা, সরকারি জনসেবার তথ্য জানতে প্রশাসনকে বাধ্যতামূলকভাবে তথ্য প্রদানে ‘তথ্য অধিকার আইন-২০০৯’ কার্যকর করা, আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর, দক্ষ, দুর্নীতিমুক্ত দেশপ্রেমিক গণমুখী প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, প্রশাসনের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, ন্যায়পরায়ণতা এবং জনসেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বাস্তবায়ন, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদসহ পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোকে শক্তিশালীকরণ, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা উন্নত ও প্রসারিত করা, নগর ও শহরে ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা, পরিকল্পিত উন্নয়ন এবং নগর ব্যবস্থাপনায় অধিকতর স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও জনগণের অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, বর্তমানে পরিচালিত সামাজিক সুরক্ষার আওতা ও পরিধি বাড়ানো, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে কৃষি উপকরণের ওপর ভর্তুকি বাড়ানো, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং কৃষিপণ্যের দক্ষ সাপ্লাই চেইন/ভ্যালু চেইন গড়ে তোলা, ছোট ও মাঝারি আকারের দুগ্ধ ও পোলট্রি খামার প্রতিষ্ঠা এবং মৎস্য চাষের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, প্রয়োজনমতো ভর্তুকি, প্রযুক্তিগত সহায়তা বৃদ্ধি করা, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনয়ন। আধুনিক বাস সার্ভিস চালু করা। তৃণমূলে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে প্রশাসনের সব পর্যায়ে ত্রিপক্ষীয় গণশুনানির আয়োজন করা। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত, ভর্তি ও কোচিং বাণিজ্য বন্ধ। ওষুধ, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, আইসিটিসহ সরকারি-বেসরকারি সেবাপ্রদানকারী কর্তৃপক্ষে গ্রাহক হয়রানি রোধ ও সেবার মান নিশ্চিতে ভোক্তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সরকারি নজরদারি নিশ্চিত করা অন্যতম।

দেশে সত্যিকারের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আর একটি জটিল সমস্যা হলো প্রচলিত শাসনব্যবস্থায় সমাজের সব শ্রেণি ও পেশার প্রতিনিধিত্ব এবং অংশগ্রহণ থাকে না। যদিও বর্তমান ক্ষমতাসীন দল জাতীয় সংসদে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে মনোনয়ন দিয়েছিল। যদিও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মালিক জনগণ বলা হলেও শাসনব্যবস্থায় সমাজের সব পর্যায়ের শ্রেণি-পেশার নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত। শুধু জনপ্রতিনিধি নির্বাচন বা ভোট দেওয়া ছাড়া আর কোনো ভূমিকা নেই। যদিও অনেক সময় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ভোট নেওয়ার পর আর জনগণের মুখোমুখি হতে চায় না। কথায় কথায় তারা বলেন, আমরা ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত। এটা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক আচরণের পর্যায়ে পড়ে না। এজন্য সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা আবশ্যক। এ সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চার বিষয়টি রাজনীতিতে অনুপস্থিতির কারণে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম, অবজ্ঞা ও সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী সংস্থার ব্যবস্থাপনায়। যেখানে অনেক খাতে শুধু সরকারি কর্মকর্তারাই নীতিনির্ধারণ করে থাকেন আবার অনেক জায়গায় সরকারি কর্মকর্তা ও ওই সেক্টরের ব্যবসায়ীরা মিলে যৌথভাবে নীতিনির্ধারণ করে থাকেন। অথচ এখানে নাগরিকদের অংশগ্রহণ বা যাদের জন্য এ সেবা সার্ভিস তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকে না। তবে অনেক জায়গায় এসব পদও সমাজের ওপরতলার লোকজন দখল করে নেন। নীতিনির্ধারক মহল চিন্তাও করে না, যাদের জন্য এ সেবা বা বিধান তাদের কোনো মতামতের প্রতিফলন দরকার আছে কি না? ব্রিটিশ আমলের ঘুণে ধরা আমলাতন্ত্রের সংস্কার ব্রিটিশরা করতে পারলেও বাংলাদেশ তা এখনো পারেনি। যার কারণে রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী সংস্থা ও নাগরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট কমিটি এখনো সেই ব্রিটিশদের নির্দেশিত পথেই হাঁটছে। ফলে ভোক্তা ও নাগরিক অধিকার সংশ্লিষ্ট কমিটি ও সেবাদানকারী সংস্থায় এখনো সত্যিকারের ভোক্তা প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়নি। যদিও কোনো জায়গায় নাগরিকদের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে, সেখানে সভাপতি কর্তৃক মনোনীত বলে আরো খাটো করা হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অনেক জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা এগুলো দখলে নিয়ে নেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিভাবকদের সত্যিকারের অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, ফলে অনেক জায়গায় ভর্তি বাণিজ্য যেমন প্রকট হচ্ছে; তেমনি অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতবিনিময়ের সুযোগ সীমিত হয়ে যাচ্ছে। যার সর্বশেষ বলি হলো ঢাকায় ভিকারুননিসা নূন স্কুলের অরিত্রী অধিকারীর আত্মঘাতী মৃত্যু।

তাই এখনই সময় নতুন সরকারের নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করার আগে এ বিষয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে। বিশেষ করে সরকারি সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। তাদের প্রশাসনিক ও আর্থিক জবাবদিহিকে নাগরিক তদারকি ও পরিবীক্ষণের আওতায় আনতে হবে। নাগরিক অধিকার ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিয়োজিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ভোক্তা অধিকার এবং নাগরিক সংগঠনগুলোকে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি সরকারি নাগরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট কমিটি ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে সব ধরনের নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দান এবং এসব নাগরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাড়ি ভাড়া, হোল্ডিং ট্যাক্স, গণপরিবহন, নগর ব্যবস্থাপনা, শিল্প ও বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয়ে নাগরিক ভোগান্তি নিরসনে গ্রাহক, সেবাদানকারী সংস্থা ও ভোক্তা প্রতিনিধি, প্রশাসনের সমন্বয়ে ত্রিপক্ষীয় গণশুনানির মাধ্যমে নাগরিক পরিবীক্ষণ, অংশগ্রহণ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে সুশাসন জোরদার করতে হবে।

লেখক : ভাইস প্রেসিডেন্ট

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close