মো. এমদাদ উল্যাহ

  ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

মুক্তমত

আকাশের আত্মহত্যা এবং কিছু কথা

কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও টুইটারে আলোচিত এক দম্পতির ‘বিয়ে’ নিয়ে পর্যালোচনা। আলোচিত সেই দম্পতি হলো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক মোস্তফা মোরশেদ আকাশ ও তার স্ত্রী তানজিলা হক চৌধুরী মিতু। বিশেষ করে চিকিৎসক আকাশের আত্মহত্যায় ফেসবুক এখন সরগরম। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েই তিনি গত ৩১ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার আত্মহত্যা করেন। এরপরই শুরু হয় তার স্ত্রী তানজিলা হক চৌধুরী মিতু ও তার পরিবারের কুকীর্তি নিয়ে নানা সমালোচনা। এরই মধ্যে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আকাশের স্ত্রী মিতু নানা তথ্য দিয়েছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, তিন বছর আগে প্রেম করে বিয়ে করেন চিকিৎসক আকাশ ও মিতু। বিয়ের পরপরই মিতু আমেরিকা চলে যান। আকাশ বিয়ের পর থেকেই মিতুকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। এ নিয়ে উভয়ের মধ্যে প্রায় মনোমালিন্য হতো। গত ১৩ জানুয়ারি মিতু দেশে আসার পর তা মারাত্মক আকার ধারণ করে। গত ৩০ জানুয়ারি বুধবার রাতে এ নিয়ে তাদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এরপর মিতুর বাবা এসে মেয়েকে নিজের বাসায় নিয়ে যান। বৃহস্পতিবার ভোরের দিকে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করেন আকাশ। ঘটনার পরদিন শুক্রবার চিকিৎসক আকাশের মা জোবায়দা খানম বাদী হয়ে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় আকাশের স্ত্রী তানজিলা হক চৌধুরী মিতু, বাবা আনিসুল হক চৌধুরী, মা শামীমা হক চৌধুরী, বোন তানজিলা হক চৌধুরী, আলিসা চৌধুরীসহ ছয়জনকে আসামি করা হয়।

আমেরিকাতেও মিতুর পরকীয়া ছিল এমনটি জানিয়ে চিকিৎসক আকাশ স্ট্যাটাসে লেখেনÑ ‘জানুয়ারি ২০১৯ জানতে পারি ও রেগুলার ক্লাবে যাচ্ছে, মদ খাচ্ছে, প্যাটেল নামে এক ছেলের সঙ্গে। আমি বারবার বলছি, আমাকে ভালো না লাগলে ছেড়ে দাও কিন্তু চিট করো না মিথ্যা বলো না। আমার ভালোবাসা সব সময় ওর জন্য ছিল শতভাগ। আমি আর সহ্য করতে পারিনি। আমাদের দেশে তো ভালোবাসায় চিটিংয়ের শাস্তি নেই। তাই আমিই বিচার করলাম এবং চির শান্তির পথ বেছে নিলাম।’

ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ছাব্বিশ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে মিতু নিজের মুখে স্বীকার করেছেন নিজের বিবাহবহির্ভূত একাধিক সম্পর্কের কথা। একজনের জেরার মুখে তিনি বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কথা স্বীকার করেন। ওই ভিডিওতে দেখা যায় মিতু অনেকটা অস্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন। তার মুখের এক কোণে ছিল রক্তের দাগ এবং মারধরের চিহ্ন। ভাইরাল হওয়া ভিডিওটিতে মিতুকে বলতে শোনা যায়, ‘প্যাটেলের সঙ্গে এক্সটা ম্যারিটাল অ্যাফায়ার ছিল, আমি শোভনের সঙ্গে, মাহবুবের সঙ্গে হোটেলে গেছি বিয়ের আগে। আকাশের সঙ্গে আমার সম্পর্ক থাকা অবস্থায়। এরপর পুরুষ কণ্ঠে একজনকে বলতে শোনা যায়, আকাশের সঙ্গে তোমার কয় বছরের সম্পর্ক? জবাবে মিতু বলেন, আকাশের সঙ্গে আমার ২০১০ থেকে সম্পর্ক। বিয়ে হয়েছে কত সালে? মিতু বলেন, ২০১৬ সালে। প্যাটেলের সঙ্গে... করছ? মিতু জবাব দেন, করছি।

এতেই অনুধাবন করা যায়, একাধিক পুরুষের সঙ্গে স্ত্রীর দিনের পর দিন অবৈধ সম্পর্কে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন চিকিৎসক আকাশ। যন্ত্রণা এতটা প্রকট হয়ে উঠেছিল, শেষ পর্যন্ত স্ত্রীকে পাপের পথ থেকে ফেরাতে না পেরে আকাশ নিজেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। আত্মহত্যার আগে তিনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেনÑ ‘ভালো থেকো আমার ভালোবাসা, তোমার প্রেমিকদের নিয়ে’। এ স্ট্যাটাস দিয়েই শরীরে বিষাক্ত ইনজেকশন পুশ করে আত্মহত্যা করেন চিকিৎসক আকাশ।

নিজ হাতে নিজের জীবনের সব কর্মকা-ের পরিসমাপ্তি ঘটানোর নামই আত্মহত্যা। অর্থাৎ, নিজ আত্মাকে চরম যন্ত্রণা ও কষ্ট দেওয়া। ইসলামি দৃষ্টিকোণে আত্মহত্যা একটি জঘন্য পাপ। পবিত্র কোরআনে সুরা নিসার ২৯-৩০নং আয়াতে আল্লাহ্? তায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু এবং যে কেউ জুলুম করে, অন্যায়ভাবে তা (আত্মহত্যা) করবে, অবশ্যই আমি তাকে অগ্নিদগ্ধ করবো, আল্লাহর পক্ষে তা সহজসাধ্য।’ মূলত ধর্মীয় অনুশাসন অমান্য করা এসব সামাজিক সংকটের অন্যতম কারণ। আকাশের আত্মহত্যা স্ত্রীকে বেহায়াপনা থেকে ফেরানোর কোনো পথ নয়। এ বিষয়ে ইসলামিক চিন্তাবিদরা বলেন, স্ত্রীর অপকর্মগুলো জানার পর চিকিৎসক আকাশ স্ত্রীকে শরিয়াহ মোতাবেক তালাক দিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি আত্মহত্যা করলেন। আত্মহত্যার মাধ্যমে তার নিজের ক্ষতি হয়েছে শুধু তা নয়, তার পরিবারও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাষ্ট্রও একজন চিকিৎসক হারিয়েছে। এ জন্য দাম্পত্য কলহ অসহনীয় হয়ে গেলে তখন তালাকের সুযোগ ইসলামে রয়েছে। আত্মহত্যা বা নির্যাতন কোনো সমাধান নয়।

পরকীয়ার কারণে চারদিকে বেড়েছে দাম্পত্য জীবনে কলহ। এই কলহে মানুষের জীবন পর্যন্ত শেষ হচ্ছে। স্বামী কর্তৃক স্ত্রী আবার স্ত্রী কর্তৃক স্বামী হত্যা অহরহ ঘটছে।

চিকিৎসক আকাশের ছোট ভাইয়ের বন্ধু তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী অভিযোগ করে জানায়, আকাশের আত্মহত্যার জন্য যতটুকু মিতু দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী তার পরিবার। তাদের অমানুষিক নির্যাতনের কারণেই আকাশ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেন, মিতুর ছোট ভাই আরমান লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর নিজেদের আর্থিক অবস্থা গোপন করে ৮০ লাখ টাকা উত্তোলন করেন। মিতুদের আর্থিক অবস্থা না জেনে ওই সময় তিনিসহ কয়েকজন টাকা উত্তোলনের নেতৃত্ব দেন। দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্ররা এ টাকা উত্তোলন করে। কিন্তু আরমানের চিকিৎসার অর্ধেক টাকা চিকিৎসায় ব্যয় না করে নিজেরাই আত্মসাৎ করেন।

চিকিৎসক আকাশের বিয়ের মোহরানা ৩৫ লাখ টাকা হওয়ায় স্ত্রীর অপরাধ দেখেও তালাক দেওয়ার সাহস করেনি। হয়তো একত্রে এত টাকা তার পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। যেহেতু বিয়ে মানবজীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ, তাই ইসলামে বিয়ের বিষয়টি খুবই সহজ করা হয়েছে। বিয়ের খরচসহ যাবতীয় বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা মেনে চললে সামাজিক বিশৃঙ্খলা এতটা প্রকট হতো না।

কুমিল্লার নাছিমা-মেহেদী দম্পতির বিয়েতেও ৩০ লাখ টাকা মোহরানা ধরা হয়। বিয়ের পর নাছিমা পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। স্বামী মেহেদী স্ত্রীর পরকীয়া জানতে পেরে তালাক দিতে চাইলে বিপত্তি ঘটে বিপুল পরিমাণ মোহরানায়। টাকা জোগাড় করতে না পেরে নাছিমাকে তালাক দেওয়া সম্ভব হয়নি মেহেদীর। পারিবারিক সম্পর্কে ঘাটতি শুরু হওয়ায় নাছিমা মেহেদীর বিরুদ্ধে যৌতুক মামলা দিয়ে জেল খাটায়। জেল থেকে বের হয়ে মেহেদী আবার নাছিমার সঙ্গে সংসার শুরু করে। চেষ্টা করেও নাছিমাকে ভালো করতে না পেরে মেহেদী হাসান গত ২১ জানুয়ারি সোমবার স্ত্রীকে হত্যা করে পালিয়ে যায়। বিয়ের মোহরের ক্ষেত্রেও আমরা দেখি অধিকাংশ ক্ষেত্রে শরিয়তের নির্দেশনা মানা হয় না। ইসলামে মোহরের ক্ষেত্রে যে সুন্দর নির্দেশনা রয়েছে, অনেক বড় অঙ্কের মোহর ধার্য করা যেমন শরিয়তে কাম্য নয়, তেমনই তা একেবারে তুচ্ছ ও সামান্য হওয়াও উচিত নয়। ছেলের সামর্থ্য অনুযায়ী মোহর নির্ধারণ করলেই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়ানো সম্ভব।

বর্তমান সমাজে মেয়ের অভিভাবকরা মনে করেন- মোহর বেশি করে পরিশোধ না করলেই চলে। এতে মেয়ের বিয়ে টিকবে। কারণ তালাকের সময় বিপুল পরিমাণ মোহরানা পরিশোধ করতে হবে। এটা অনেকের পক্ষেই অসম্ভব। তারা আরো মনে করেন, কম মোহর নির্ধারণ করলে তা পরিশোধ করলে যেকোনো মুহূর্তে মেয়েকে তালাক বা ছেড়ে দেওয়ার আশঙ্কা থাকে। কোরআন ও সুন্নাহ মতে এটা একটা ভ্রান্ত ধারণা। কিন্তু শরিয়তে বিয়ের সময়ই ছেলের সামর্থ্য অনুযায়ী মোহরানা ধার্য ও পরিশোধ করার হুকুম রয়েছে। সমাজে শরিয়াহ নীতি অমান্য করায় সামাজিক অবক্ষয় বেড়েই চলছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ ও সাহাবায়ে কিরামের সাধারণ রীতি বিয়ের ক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close