রেজাউল করিম খোকন

  ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

বিশ্লেষণ

‘একুশ’ আমাদের প্রাণের মেলা

শুরু হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে বছর ঘুরে বারবার আসে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন দীর্ঘদিন থেকেই আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। অনেক বইপ্রেমী সারা বছর ধরে ফেব্রুয়ারি মাস এবং এ মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলার জন্য অপেক্ষা করেন। কয়েক বছর ধরে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে মূল গ্রন্থমেলা কিছু সরে এসে পাশের ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বৃহৎ পরিসরে বিস্তৃৃত আয়োজনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি, স্বাধীনতার ইতিহাসে বাংলা একাডেমি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দুটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়েছিল। এরপর থেকে প্রতি বছর গ্রন্থমেলা বিশাল থেকে বিশালতর আকার ধারণ করেছে।

এখন প্রতিদিন বিকেলে মানুষজনের ভিড়ে মুখরিত হবে বাংলা একাডেমি প্রান্তর এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এ যেন লেখক-পাঠকের এক মহাসমাবেশ। সেই সঙ্গে তরুণ-তরুণীদের তুখোড় আড্ডায় জমে উঠবে গ্রন্থমেলা। আমাদের একুশের এ গ্রন্থমেলার ব্যাপ্তি আর আমাদের ভূখন্ডে সীমাবদ্ধ নেই, সমগ্র বিশে^ ছড়িয়ে পড়েছে। এটা আন্তর্জাতিকভাবেও আজ স্বীকৃত। যারা বইপ্রেমিক তারা সবাই এ গ্রন্থমেলার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। এ গ্রন্থমেলায় যারা সাহিত্যচর্চা করেন, যারা প্রকাশক এবং যারা বই পড়তে পছন্দ করেন; সেসব শিশু থেকে সব বয়সীর চমৎকার এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। বলা যায়, এ মেলা উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। এখন অনেক নতুন প্রকাশক এ শিল্পে এসেছেন। পাঠকের সংখ্যাও হু হু করে বাড়ছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ফেব্রুয়ারি মাসের পুরোটা সময় ধরে চলে। পৃথিবীতে আর কোনো গ্রন্থমেলাই এত দিন ধরে চলে না। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে এটি পৃথিবীর দীর্ঘ দিনব্যাপী আয়োজিত এক গ্রন্থমেলা।

এ মেলায় মানুষের আগ্রহ এতই বেশি যে, শুধু প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে নয়; বিশে^র বিভিন্ন স্থান থেকেও গ্রন্থপ্রেমী বাঙালিরা এতে অংশ নেন। ফলে অমর একুশের স্মৃতিবাহী এ মেলার ঐতিহ্যের বিস্তার ঘটেছে। যে মেলা একুশের মহান ঐতিহ্যকে ধারণ করে এত বিশাল আকার করেছে, তা এখন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও সম্প্রসারিত হয়েছে। এ স্থান থেকেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বাঙালির মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন। এখানেই রয়েছে স্বাধীনতাস্তম্ভ¢ ও শিখা চিরন্তন। আরো আছে মুক্তিযুদ্ধের ম্যুরাল ও স্বাধীনতা জাদুঘর। তাই এখানে গ্রন্থমেলা সম্প্রসারিত হওয়ায় বাংলাদেশের বাঙালির জাতিসত্তার উদ্বোধনের স্মৃতিবাহী একুশের ঐতিহ্যের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা যুক্ত হয়ে মেলাটি এখন নতুন আঙ্গিক, পরিসর ও মাত্রিকতায় স্থিত হয়েছে বলা যায়।

১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল ভাষা শহীদ বরকত, সালাম প্রমুখের বুকের তাজা রক্তে। স্বাধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রামে নামার উত্তাল সূচনা হয়েছিল তখন। যা ইতিহাসের নানা ক্রমধারাবাহিকতায় ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে গড়িয়েছিল। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয়েছিল, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ^ মানচিত্রে ঠাঁই করে নিয়েছিল। মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই দিনে দিনে স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন দেখিয়েছিল এ দেশের মানুষকে। ভাষা আন্দোলনের নানা স্মৃতিবাহী বাংলা একাডেমি চত্বর থেকে স্বাধীনতার লড়াই এবং স্বাধীনতা অর্জনের স্মৃতিবাহী ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রসার আমাদের অতীত ইতিহাসের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর। আমাদের প্রাণের মেলা অমর একুশে গ্রন্থমেলার প্রসার এবং স্থানান্তর সেই ইতিহাসেরই বহিঃপ্রকাশ যেন।

গত কয়েক বছরের চেয়ে এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন তুলনামূলকভাবে অনেক পরিপাটি, সুন্দর সুশৃঙ্খল। এবারের গ্রন্থমেলার আয়োজনে নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে; যা মেলায় আগতদের মাঝে মাঝে বিড়ম্বনার মধ্যে ফেললেও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলো সবাইকে আশ^^স্ত করেছে। কারণ কয়েক বছর আগে গ্রন্থমেলায় ঘটে যাওয়া বেশকিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। এবার সেই আতঙ্ক, অস্বস্তি ভাবটি নেই মেলায় আগত বইপ্রেমী ও দর্শনার্থীদের মধ্যে। প্রতিটি স্টলের সামনে-পেছনে চারদিকে যথেষ্ট জায়গা থাকায় পাঠক-দর্শনার্থীরা স্বাচ্ছন্দ্যে স্টলগুলোতে গিয়ে বই নাড়াচাড়া করে দেখতে পারছেন। বই কিনতে পারছেন ভালোভাবে দেখেশুনে। মেলায় আগে ধুলাবালির প্রকোপটা ছিল অসহনীয়। এখন তা অনেকটা কমে এসেছে। পরিসর বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা মেলায় তাদের স্টল বিন্যাস ও সাজসজ্জায় নান্দনিকতায় প্রকাশ ঘটাতে অনেকটা সচেষ্ট হয়েছেন। যে যার সামর্থ্য এবং রুচি অনুযায়ী স্টল সাজিয়েছেন, যা পাঠক ও দর্শনার্থীদের বিশেষ নজর কেড়েছে।

এত বড় আয়োজনের অমর একুশে গ্রন্থমেলা নিয়ে আমাদের গর্ব হলেও এখনো বেশকিছু বিষয় আমাদের বেশ পীড়া দেয়। প্রতিদিন মেলায় প্রচুর লোক সমাগম হলেও সে তুলনায় বিক্রি হয় অনেক কম। প্রত্যেকে যদি অন্তত একটি করে বই কিনতেন, তা হলে আমাদের প্রকাশনা শিল্পে দারুণ এক গতির সঞ্চার হতো। প্রকাশকরা সাধারণত বই প্রকাশ করতে গিয়ে নানা আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়েন। মেলায় বই বিক্রির পরিমাণ যদি বাড়ে, তা হলে প্রকাশকরা অনেকটা স্বস্তিতে, স্বাচ্ছন্দ্যে বই প্রকাশ করতে পারতেন। প্রতি বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে কয়েক হাজার নতুন বই প্রকাশিত হয়। এত বেশিসংখ্যক নতুন বই এলেও এর মধ্যে বেশির ভাগ বই থাকে মানহীন। কোনো রকম সম্পাদনা ছাড়াই বইগুলো মলাটবন্দি হয়ে আসে। যেখানে অসংখ্য ভুল বানান থাকে। বাক্য বিন্যাসও থাকে যাচ্ছেতাই, এ ধরনের অসামঞ্জস্যপূর্ণ নিম্নমানের লেখায় সমৃদ্ধ অগণিত অসম্পাদিত বই পাঠকদের ভালো কিছু দেওয়ার বদলে কেবলই বিভ্রান্ত করে। মানহীন, আজেবাজে বইয়ের সংখ্যাধিক্য আমাদের পীড়া দেয়, অস্বস্তি জাগায় মনে। এ বিষয়ে প্রকাশক ও সংশ্লিষ্ট সবার বিশেষভাবে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। বই প্রকাশের আগে এর সুসম্পাদনা প্রয়োজন। এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।

আমরা জানি, এ গ্রন্থমেলা অন্য কোনো মেলার মতো নয়, একেবারেই বাঙালির ভাষাপ্রীতি, ভাষার জন্য সংগ্রাম এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মাতৃভাষার প্রতিষ্ঠার স্মারক হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক মানোন্নয়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধিতেও এ মেলার গুরুত্ব অসাধারণ। সেজন্যই আমাদের প্রত্যাশা হলো, এ মেলায় বহু বই প্রকাশিত হলেও মানসম্পন্ন বইয়ের যে অভাব রয়েছে, তরুণ পাঠকরা সে বিষয়ে সচেতন হবেন এবং ভালো বই প্রকাশে প্রকাশকদের উৎসাহিত করবে। দেখেশুনে গুণগত মানে উন্নত ভালো বই তারা অধিক সংখ্যায় কিনবেন।

আমরা এটাই আশা করি, ভালো বইয়ের প্রতি তরুণরা যদি ঝুঁকে পড়েন, তা হলে প্রকাশকরা নিম্নমানের বই প্রকাশে যেমন উৎসাহিত হবেন না, তেমনিভাবে যারা প্রযতœ লালিত অনুশীলন ছাড়া কোনোক্রমে যা তা কিছু একটা লিখে বই আকারে প্রকাশ করেন, তারাও বই প্রকাশের সহজ সুযোগ পাবেন না। আমরা চাই, গুণগত মানের উন্নত বই এবং এ ধারার বিকাশের মধ্য দিয়ে বছরে অন্তত পাঁচ-ছয়টি ভালো বই প্রকাশে প্রকাশকদের উৎসাহিত করা। বাংলা একাডেমির এ গ্রন্থমেলা বাঙালির প্রাণের মেলা। বাঙালির উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনন্য প্রতীক এ গ্রন্থমেলা। মানবিক চৈতন্য, শুভবুদ্ধি, গণতান্ত্রিক মানস এবং ইহজাগতিক ধ্যান-ধারণার বিকাশের মধ্য দিয়ে একটি আলোকিত সমাজ গঠনই এ গ্রন্থমেলার লক্ষ্য। যে মেলা আমাদের সাহস দেয়, ডিজিটাল মাধ্যমের এই জয়জয়কারের মধ্যেও কাগজে বই হারিয়ে যাবে না। যারা গ্রন্থমেলায় যাবেন তাদের উদ্দেশে বলছি, একেকটা বই একেকটা জানালা। দরজা-জানালা বন্ধ আলোহীন বাতাসহীন ঘরে থাকতে গেলে দম বন্ধ হয়ে আসে। আমাদের বাঁচার জন্য, স্বস্তির জন্য, স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য জানালা খুলতে হয়, তেমনিভাবে সুন্দর পরিপূর্ণ সমৃদ্ধ জীবনের জন্য মনের জানালা খুলতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে বই-ই হতে পারে একমাত্র প্রধান অবলম্বন। অতএব আমাদের বই কেনার ক্ষেত্রে কার্পণ্য করলে চলবে না। বই হোক আমাদের নিত্যসঙ্গী- এটাই শপথ হোক আমাদের।

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close